images

সারাদেশ

ভাষা আন্দোলনে বরিশালের বীর সন্তানদের অবদান অবিস্মরণীয়

জেলা প্রতিনিধি

২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৬:১৯ পিএম

১৯৫২ ভাষা আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র ছিল বরিশাল। আর ভাষা আন্দোলনে অবিস্মরণীয় অবদানও রেখেছেন বরিশালের বীর সন্তানেরা। মায়ের ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় ঢাকার রাজপথের সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলন সংগ্রাম শুরু হয় বরিশালেও। কারণ রাষ্ট্রভাষার জন্য গঠিত কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন বরিশালের গৌরনদীর সন্তান কাজী গোলাম মাহবুব। এছাড়াও ওই কমিটিতে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন ভোলার সন্তান শামসুল আলম, বরিশালের আবদুর রহমান চৌধুরী (বিচারপতি), আখতার উদ্দিন আহমেদ, এম ডব্লিউ লকিতুল্লাহ এবং অনিল দাস চৌধুরীসহ বৃহত্তর বরিশালের আরও অনেক ভাষাসৈনিক।

শুধু তাই নয়, একুশে ফেব্রুয়ারির সাংস্কৃতিক চেতনাকে হৃদয়ে ধারণ করেছিলেন বৃহত্তর বরিশালের কবি সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও শিল্পীরা। ভাষা আন্দোলনের পর যেসব গান-কবিতা সারাদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল তার অধিকাংশেরই প্রতিষ্ঠাতা হলেন এই বরিশালের সন্তান। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানের রচয়িতা তৎকালীন জগন্নাথ কলেজের ছাত্র আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, প্রথম সুরকার আবদুল লতিফ, পরবর্তী ও বর্তমান সুরকার আলতাফ মাহমুদ সবাই এই বরিশালের কৃতি সন্তান।

তবে তাদের স্মরণে কোনো আয়োজন নেই এই অঞ্চলে। ভাষা আন্দোলনে শহীদদের নাম ছাড়া তরুণ প্রজন্ম জানেন না মাতৃভাষা আদায়ের আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীরা বরিশালের।

এভাবে চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস কংক্রিটে নির্মিত শহীদ মিনারে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বে বলে মনে করেন বরিশালের বিশিষ্টজনরা। তারা মনে করেন, কংক্রিটে নির্মিত মিনারের চেয়ে মননে নির্মিত শহীদ মিনার দীর্ঘস্থায়ী করতে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ভাষা সংগ্রামী, প্রেক্ষাপট ও এর সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে হবে।

নগরীর অমৃত লাল দে মহাবিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক দেবাশীষ চক্রবর্ত্তী বলেন, একুশের অমর গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানটির গীতিকার আব্দুল গাফফার চৌধুরী, সুরকার আব্দুল লতিফ এবং শহীদ আলতাফ মাহামুদের বাড়ি বরিশালে। এছাড়া আন্দোলনে অনন্য অবদান রাখা দার্শনিক সরদার ফজলুল করিমের বাড়িও বরিশালে। ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সারাদেশের সাংস্কৃতিক, প্রগতিশীল, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং ছাত্রসমাজ একাত্মতা পোষণ করেছিল। তবে ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বদানে বরিশালের মানুষদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে।

কবি হেনরী স্বপন বলেন, ভাষা আন্দোলনে বরিশালের নেতৃবৃন্দের যে অবিস্মরণীয় অবদান রয়েছে তার কিছুই জানে না নতুন প্রজন্ম। আমি মনে করি, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে বরিশালের যেসব মানুষ কেন্দ্রীয়ভাবে অবদান রেখেছেন তাদের স্মৃতিস্তম্ভ কিংবা তাদের নাম ফলক তৈরি করা উচিত। কিন্তু আজ পর্যন্ত এখানকার নেতৃবৃন্দ, স্থানীয় প্রশাসন, শিল্প-সংস্কৃতির মানুষ তার কিছুই করেনি। এটি আমাদের ব্যর্থতা, কারণ আজ পর্যন্ত তরুণ প্রজন্মের কাছে ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া মানুষদের পরিচয় করাতে পারিনি কিংবা ইতিহাস তুলে ধরতে পারেনি।

প্রবীণ সাংবাদিক ও সংস্কৃতিজন এসএম ইকবাল বলেন, ভাষা আন্দোলনে বরিশালের একটি অনন্য অবদান রয়েছে। ভাষা আন্দোলন সারা বাংলাদেশের আন্দোলন, কিন্তু নেতৃত্বে ছিল বরিশাল। নেতৃত্বে যারা ছিলেন, তাদের নাম এখন অনেকেই জানেন না। ফলে অনেক ভুল নাম উচ্চারিত হয়। অনেক ভাষা সংগ্রামী দীনহীনভাবে মৃত্যুবরণ করেছেন।

তিনি আরও বলেন, আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি গানটি বরিশালেই প্রথম গাওয়া হয়েছিল। কিন্তু এসব কিছুই সংরক্ষণ কিংবা তাদের এই প্রজন্মের কাছে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়নি, এটি অবশ্যই আমাদের ব্যর্থতা। নতুন এই প্রজন্মের কাছে ভাষা আন্দোলনের প্রকৃত ইতিহাস এবং আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীদের সর্ম্পকে জানানো দরকার।

সাবেক ছাত্রনেতা শামিল শাহরোখ তমাল বলেন, ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন যারা তার মধ্যে পাঁচজন বরিশালের সন্তান। সেই শ্রদ্ধেয় মানুষদের স্মরণ তো পরের কথা, আমরা তাদের চিনিই না। তরুণ প্রজন্ম জানে না, ইতিহাসেও এই মাহান মানুষগুলো অবহেলিত। এই ব্যর্থতা যেমন বরিশালবাসীর তেমনি রাষ্ট্রের, আবার তরুণ প্রজন্মও ব্যর্থতা এড়াতে পারেন না।

গবেষক আনিসুর রহমান খান স্বপন বলেন, ভাষা আন্দোলন যে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে শুরু হয়েছিল তা কেবল ১৯৫২ সালে নয়, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই কিন্তু রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সূচনা। এই সূচনাকে যারা তীব্রতর করেছিলেন তার মধ্যে সর্বদলীয় যে সংগ্রাম কমিটি হয়েছিল সেখানে আহ্বায়ক থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি পদে ছিলেন বরিশালের সন্তান। যা ঐতিহাসিকভাবে সত্য। কিন্তু আমাদের দুঃখের বিষয় হচ্ছে এই সর্ম্পকে এই প্রজন্মের জানা-শোনা খুবই কম। এমনকি ওই আন্দোলন কমিটির আহ্বায়ক কাজী গোলাম মাহবুবের নামের তোরণ ভেঙে ফেলা হয়েছে। এইভাবে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস জানাতে যে বিষয়গুলো আমাদের ছিল তা তুলে ধরতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি।

প্রতিনিধি/টিবি