জেলা প্রতিনিধি
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০১:১৭ পিএম
Failed to load the video
ঘরে বাইরে সবখানেই তারা এক সময় ‘ডালু’ ভাষায় কথা বলতেন। গত শতাব্দির আশির দশকের গোড়ার দিকেও তারা সব জায়গায় ব্যবহার করতেন মায়ের ভাষা। ছিল নিজস্ব আচার, অনুষ্ঠান ও সংস্কৃতি। তবে ‘ডালু’ ভাষা জানা সর্বশেষ লোকটি বছর দুয়েক আগে মারা গেছেন। এখন ডালু ভাষায় কেউ আর কথা বলে না। কারণ সবাই মাতৃভাষা ভুলে গেছে। কালের হাওয়ায় হারিয়ে গেছে নিজস্ব আচার, অনুষ্ঠান ও সংস্কৃতিও।
একই অবস্থা গারো পাহাড়ে বসবাসরত বানাই, হদি ও বর্মণ সম্প্রদায়ের। পারিবারিক পরিচর্যা ও সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ না থাকায় এ পরিস্থিতি হয়েছে বলে জানান ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর নেতারা। যদিও ভাষা ও সংস্কৃতি ধরে রাখতে দ্রুত কালচারাল একাডেমি স্থাপন করা হবে বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন।
বেসরকারি সংস্থা আইইডির আদিবাসী সক্ষমতা উন্নয়ন প্রকল্পের তথ্য মতে, জেলায় বর্মণ ১৭ হাজার, হদি ১০ হাজার ৬০০, ডালু ১ হাজার ১০০ এবং বানাই ১১০ জন রয়েছেন।
নিশীতা রাণী ডালু। শেরপুরের নালিতাবাড়ি শহরের একটি বেসরকারি স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়েন। বাংলা বলতে পারলেও ডালু ভাষায় সে কিছুই বলতে পারে না। কারণ স্কুল কিংবা বাড়ি- কোথায়ও চর্চা না থাকায় সে শিখেনি তাদের নিজস্ব ভাষা।
বর্ষা রাণী ডালু ঢাকা মেইলকে বলেন, আমার এক বড় আব্বা (জেঠা) ডালু ভাষা কিছুটা জানতেন। কিন্তু করোনার সময় তিনি মারা গেছেন। এখন আমাদের পাড়ায় কেউ আর ডালু ভাষা পারে না। কোথাও প্রয়োজন হয় না, তাই আমাদের মাতৃভাষা কেউ জেঠার কাছ থেকে শিখেনি। আমরা স্কুল ও বাড়িতে সবসময় বাংলা ভাষাতেই কথা বলি। বন্ধুবান্ধব ও মেহমানদের সঙ্গেও বাংলাতেই কথা বলি।
নালিতাবাড়ি উপজেলার শহরের পাশে বেশকিছু ডালু পরিবার আছে। তাছাড়া নাকুগাঁও স্থলবন্দরের পাশে ২০-২৫টি ডালু বাড়ি রয়েছে। নালিতাবাড়ির কাকরকান্দি ইউপির সাবেক মহিলা সদস্য সুরেশা দেবী বলেন, ছোটবেলায় বাপ দাদার মুখে ডালু ভাষায় কথা শুনতাম। চান্দ্র মাসের সঙ্গে মিল রেখে আয়োজন হতো বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান। সারারাত ডালু ভাষায় গান হতো, আড্ডা হতো। এখন আর ডালু ভাষায় কথা বলার কেউ নেই। সবাই ভুলে গেছে ভাষাটি। তাছাড়া এখন আর আগের মতো সেসব অনুষ্ঠানও হয় না।
নাকুগাঁও বন্দরের পাশে বসবাস করা মুক্তা রাণী ডালু ঢাকা মেইলকে বলেন, আশির দশকেও আমাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি ছিল। আমাদের পূর্বপুরুষরা ডালু ভাষায় কথা বলতেন। বিভিন্ন চন্দ্ররাতে আমাদের নিজস্ব ভাষার গানের আসর হতো, সারারাত গান চলত। কিন্তু কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে মায়ের মুখের ভাষা ও সংস্কৃতি।
কলেজ শিক্ষার্থী সৃজিতা রাণী ঢালু বলেন, আমাদের নালিতাবাড়ি শহরে ও নয়াবিল ইউনিয়ন, রামচন্দ্রকুড়া এবং মরিচপুরান ইউনিয়নে ডালুরা থাকেন। আগে আমাদের বাপ দাদারা নিজেদের ভাষায় টুকটাক কথা বললেও এখন আমাদের ভাষা পুরোপুরি হারিয়ে গেছে।
একই অবস্থা বানাই সম্প্রদায়ের। ঝিনাইগাতী উপজেলার সীমান্ত ঘেঁষা একটি ছোট্ট গ্রাম বানাইপাড়া। গারো পাহাড়ের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র গজনী অবকাশ কেন্দ্রে যাওয়ার আগেই পাড়াটির অবস্থান। সেখানে বাস করে বানাই সম্প্রদায়ের লোকজন। তবে তারা কেউ নিজেদের ভাষায় কথা বলতে পারে না। তাদের ধর্মীয় আচার, অনুষ্ঠান, রীতিনীতি সবকিছু সময়ের পালাবদলে বদলে গেছে। তারা জানায়, পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে তারা জানতে পেরেছে, তাদের নিজস্ব ভাষা ছিল অনেকটা বরেন্দ্র অঞ্চলের ভাষার মতো।
নালিতাবাড়ি ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান কোপিন্দ্র নকরেখ বলেন, দেশের সব নাগরিকই যাতে মাতৃভাষা শেখার ও চর্চা করার সুযোগ পায়, তা নিশ্চিত করতে সরকারকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। আমাদের গারো পাহাড়ে বসবাসরত ডালু ও বানাই সম্প্রদায়ের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি হারিয়ে গেছে। ডালু ও বানাইসহ আর যেসব ভাষা হারিয়ে গেছে তা উদ্ধারের চেষ্টা করতে হবে।
ঝিনাইগাতীর বনকুড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিরুণ চন্দ্র বর্মণ ঢাকা মেইলকে বলেন, গারো পাহাড়ে বসবাসরত যেসব সম্প্রদায়ের ভাষা হারিয়ে গেছে। আমি দীর্ঘদিন থেকে এসব ভাষা উদ্ধারের চেষ্টা করছি।
কোচ আদিবাসী ইউনিয়নের শেরপুর জেলার সাধারণ সম্পাদক মিঠুন চন্দ্র কোচ বলেন, ২০১৭ সালে প্রাক-প্রাথমিকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুদের হাতে নিজ নিজ ভাষার বই দেওয়া হয়। সে সময় পাঁচটি ভাষায় বই বিতরণ করা হয়। কিন্তু ওই ভাষার শিক্ষক বা প্রশিক্ষিত শিক্ষক না থাকায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুদের মাতৃভাষা শিক্ষা কার্যক্রম পুরোপুরি কাজে আসেনি। তাই সরকারের কাছে পাহাড়ি এলাকাগুলোর স্কুলে মাতৃভাষার শিক্ষকের পাশাপাশি নেত্রকোনার বিরিশিরির আদলে একটি কালচারাল একাডেমি করার দাবি জানাচ্ছি।
ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান প্রাঞ্জল এম সাংমা ঢাকা মেইলকে বলেন, একটি জাতি বা গোষ্ঠীর অস্তিত্ব টিকে থাকে তাদের ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর। তাই আদিবাসীদের ভাষা সংরক্ষণ জরুরি। তাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি ধরে রাখতে মাতৃভাষায় বই ও শিক্ষক এবং পাহাড়ে একটি কালচারাল একাডেমি স্থাপন করতে হবে।
বেসরকারি সংস্থা আইইডির আদিবাসী সক্ষমতা উন্নয়ন প্রকল্পের ফেলো সুমন্ত বর্মণ ‘ডালু’ ও ‘বানাই’ ভাষা উদ্ধারে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগ ভাষার নেই লিখিত অক্ষর। তাই আধুনিকতার দাপটে ভাষাগুলো কালের সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে হারিয়ে যাচ্ছে। গারো পাহাড়ে ইতোমধ্যে ডালু, বানাই, বর্মণ ও হদিদের মাতৃভাষা হারিয়ে গেছে। নিজস্ব কোনো বর্ণমালা না থাকায় এগুলো সংরক্ষণ করা যায়নি। এরই মধ্যে ডালু ও বানাই ভাষাভাষীর প্রবীণ লোকগুলোও মারা গেছে। এ দুই সম্প্রদায়ের নতুন প্রজন্ম তাদের মায়ের ভাষা আর শিখতে বা ব্যবহার করতে পারছে না। আমি ইতিমধ্যে জেলার বর্মণ, ডালু ও বানাই সম্প্রদায়ের বিভিন্ন লোকদের নিয়ে ভাষা উদ্ধারের চেষ্ঠা করছি। একটি বিশ্বদ্যিালয়ের ভাষা বিভাগের সঙ্গেও কথা বলেছি।
জেলা প্রশাসক সাহেলা আক্তার ঢাকা মেইলকে বলেন, শেরপুর জেলায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী যারা রয়েছেন তাদের মাতৃভাষা রক্ষার্থে জেলা প্রশাসন তৎপর রয়েছে। ইতিমধ্যে তাদের মাতৃভাষায় বই দেওয়া হয়েছে। তবে মাতৃভাষা পড়ানোর জন্য শিক্ষকের কিছুটা সঙ্কট রয়েছে। এ সমস্যা দূর করার জন্য দ্রুতই পদক্ষেপ নেওয়া হবে। আর তাদের সংস্কৃতি ধরে রাখার জন্য একটি কালচারাল একাডেমি স্থাপন করা হবে।
প্রতিনিধি/এসএস/একেবি