images

সারাদেশ

চট্টগ্রামে ফলের বাজারে অস্থিরতা

চট্টগ্রাম ব্যুরো

১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:২০ পিএম

ডলার সংকটে এলসি (ঋণপত্র) খোলার জটিলতায় ফল আমদানিতে নিরুৎসাহের কথা বলেছেন বাণিজ্য মন্ত্রী।

গত ৮ ফেব্রুয়ারি বুধবার এ কথা বলার পর অস্থির হতে শুরু করে ফলের বাজার। আর এই কয়দিনে চট্টগ্রামে দেশি-বিদেশি ফলের দাম বেড়েছে প্রায় দুই থেকে তিনগুণ।

এই অবস্থায় রোজায় কী হবে তা নিয়ে অস্থিরতা প্রকাশ করেছেন চট্টগ্রাম মহানগরীর বিভিন্ন বাজারের খুচরা ও পাইকারি ফল ব্যবসায়ীরা। শনিবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) সকালে নগরীর বহদ্দারহাটসহ কয়েকটি বাজারে গেলে দেখা যায় ফলের দোকানগুলো প্রায় অর্ধেক খালি। যা এক সপ্তাহ আগেও ছিল পরিপূর্ণ।

বহদ্দারহাটের যুমনা ব্যাংক মার্কেটের নিচ তলার খুচরা ফল ব্যবসায়ী মো. কামাল উদ্দিন বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রী আমদানিতে নিরুৎসাহের কথা বলার পর থেকে বাজারে ক্রমান্বয়ে ফল সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে পাইকাররা। তারা বলছেন, বিদেশ থেকে নাকি ফল আসছে না। ফলে ব্যবসা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। নিজের পেট আছে, সংসার আছে, ব্যবসা বন্ধ হলে বাঁচব কিভাবে।

তিনি বলেন, বাজারে ফল সরবরাহ কমে যাওয়ায় সব রকমের দেশি-বিদেশি ফল এক সপ্তাহ আগের তুলনায় কেজি প্রতি ১০০-১৫০ টাকা বেড়ে গেছে। এমন ফলও আছে যার দাম প্রায় তিনগুণও বেড়েছে। ফলে ক্রেতারাও ফল কেনা কমিয়ে দিয়েছেন।

নগরীর চকবাজারের খুচরা ফল ব্যবসায়ী আহমদ নবী বলেন একই কথা। তিনি বলেন, বাজারে ফল কমে আসছে। তাই ফলের দাম প্রায় দুই থেকে তিনগুণ বেড়েছে। এক সপ্তাহ আগে যে মাল্টা প্রতিকেজি ১৮০-২০০ টাকা বিক্রি করেছি, তা আজ শনিবার সকালে ৩৬০-৪০০ টাকায় কেজিপ্রতি বিক্রি করছি। বিকেলে কি হবে সেটা বলা মুশকিল। হয়তো আরো বাড়তে পারে।

ctg

একইভাবে প্রতিকেজি সবুজ আঙ্গুর কেজিপ্রতি ৪০০, কালো আঙ্গুর ৬০০, আনার ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তাছাড়া কমলা বিক্রি হচ্ছে ৪০০ টাকা প্রতিকেজি। একইভাবে বেড়েছে আমদানি করা ম্যান্ডারিন, নাশপাতি, আপেলও। পাশাপাশি বেড়ে গেছে দেশি ফলের দামও।

ফলের দাম বেড়ে যাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন ফলমন্ডির পাইকারি বাজারের ব্যবসায়ীরাও। পাইকারি ফল ব্যবসায়ী তসকির আহমেদ জানান, চায়না থেকে আমদানি করা ফুজি আপেলের কার্টনে মাসের ব্যবধান (২০ কেজি) এক হাজার ৮০০ টাকা বেড়ে ৫ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। হানি ক্রাউন আপেলে (২০ কেজি) দেড় হাজার টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৪ হাজার ৮০০ থেকে ৫ হাজার টাকায়। মাল্টার কার্টনে (১৪ কেজি) ৭০০ টাকা বেড়ে বর্তমানে ২ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

অপরদিকে, চায়না ও দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আনা কমলার কার্টনে (১০ কেজি) ৫০০ টাকা বেড়ে ১ হাজার ৯০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাশাপাশি ফল আমদানি কমে যাওয়ায় দেশি ফলের উপর চাপ বেড়েছে। কিন্তু চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম হওয়ায় দেশি ফলের দামও বেড়ে গেছে। এই অবস্থায় রোজায় কী হবে তা আল্লাহই জানেন। কারণ রোজায় স্বাভাবিকের চেয়ে ফলের চাহিদা বেড়ে দ্বিগুণ হয়।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রতিবছর সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত বিদেশি ফলের চাহিদা সবচেয়ে বেশি থাকে। তবে সরকার এবার রোজার মৌসুমে দেশি ফলের ওপর নির্ভর। কিন্তু এবার রোজা যে মৌসুমে শুরু হবে তখন দেশি ফল খুব একটা থাকবে না। বাজারে আমদানি করা ফল না থাকলে শুধুমাত্র দেশি ফল দিয়ে রোজার চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে না। তখন বাজারে ফলের সংকট দেখা দিবে এবং দেশি-বিদেশি সব ধরনের ফলের দাম মাত্রাতিরিক্ত বাড়বে।

ctg

ব্যবসায়ীরা আরও বলেন, চট্টগ্রামসহ সারাদেশে ফলের মোট চাহিদার প্রায় ৩৫ শতাংশ দেশে উৎপাদিত হয়। পাশাপাশি দক্ষিণ আফ্রিকা, চীন, ভারত, ভুটান, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, মিসর, পোল্যান্ড, পর্তুগাল, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, আফগানিস্তান ও ফ্রান্স থেকে আপেল, মাল্টা, কমলা, নাশপাতি ও আঙ্গুর আমদানি করেন ব্যবসায়ীরা।

আমদানিকারকরা বলছেন, ডলারের সংকট ও এলসি জটিলতার প্রভাব পড়েছে ফল আমদানিতে। ফলে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ফল আমদানি ৩০ শতাংশের নিচে নেমে গেছে। বিদেশি ফলের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে রেফার কনটেইনারে করে বেশির ভাগ কমলা, আঙ্গুর, ম্যান্ডারিন, নাশপাতি ও আপেল আমদানি হয়। গত ছয় মাসে এসব ফলের আমদানি কমেছে প্রায় ৪১ হাজার টন।

চট্টগ্রাম কাস্টমসের তথ্যমতে, চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৬ লাখ ১৬ হাজার টন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৬ লাখ ৩১ হাজার টন, ফল আমদানি হয়েছে। অথচ গতবছরের শেষ ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) ৯৩ হাজার ৩৭২ টন কমলা, আঙ্গুর, ম্যান্ডারিন, নাশপাতি ও আপেল আমদানি হয়েছে। এই সময়ে সব মিলিয়ে আমদানি হয়েছে ১ লাখ ৩৯ হাজার ৩০৬ টন ফল।

চট্টগ্রাম ফল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলাম বলেন, চট্টগ্রামে প্রতিদিন প্রায় ১৭ লাখ কেজি ফল বেচাকেনা থেকে প্রতিদিন প্রায় ২৮ কোটি টাকা আয় আসে ফল ব্যবসায়ীদের। রোজার সময় দৈনিক ফলের চাহিদা দ্বিগুণ বেড়ে প্রায় ৩৪-৩৫ লাখ কেজিতে ঠেকবে। কিন্তু আমদানি কমে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এখন থেকেই ফলের বাজার অস্থির হতে শুরু করেছে।

ctg

তিনি বলেন, ডলার সংকট ও এলসি (ঋণপত্র) জটিলতার প্রভাব ছিল এতদিন। এখন সরকার বিদেশি ফল আমদানিতে নিরুৎসাহিত করায় আমদানি একেবারে কমে গেছে। ফলে বছরের ব্যবধানে ফল আমদানি প্রায় ৩০ শতাংশের বেশি কমেছে। তাই বিদেশ থেকে আনা ফলে আপেল, মাল্টা, কমলাসহ সব ধরনের ফলের দামও বেড়েছে। রোজার সময় আমাদের দেশে ফলের চাহিদা বাড়ে। তবে শুধুমাত্র দেশিয় ফলের উপর নির্ভর করে চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে না। এভাবে চলতে থাকলে সামনে ফলের দাম আরো বাড়বে।

বাংলাদেশ ফ্রেস ফ্রুটস ইম্পোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, প্রতিবছর রোজায় বিদেশি ফলের চাহিদা থাকে। রোজার সময় আমাদের দেশে উৎপাদিত পেঁপে, পেয়ারা, বরই, আনারসসহ বিভিন্ন দেশি ফল পাওয়া যাবে। কিন্তু এ যোগান দিয়ে কোনভাবেই চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে না। কারণ শীত শেষ, কিছুদিন পরে কলার ঘাটতি তৈরি হবে। তরমুজ পাওয়া যাবে। এক ফলের ওপর তো আর ভোক্তা নির্ভর করে থাকবে না। কাজেই বাজারে বিদেশি ফল না থাকলে বড় ধরনের অস্থিরতা তৈরি হবে। তখন সরবরাহ সংকটে দেশি-বিদেশি ফলের দাম বাড়বে।

টিবি