images

সারাদেশ

মাটি কেটে ধ্বংস করা হচ্ছে পুণ্ড্র নগরীর ইতিহাস

জেলা প্রতিনিধি

১৪ জানুয়ারি ২০২৩, ০৪:৩০ পিএম

পুণ্ড্র নগরীখ্যাত মহাস্থানের মথুরা গ্রামের আড়াই হাজার বছর আগের প্রাগৈতিহাসিক নির্দশন ‘পদ্মার ভিটা’ নামে পরিচিত নির্দশনের আশপাশের উচুঁ ঢিবিগুলোর মাটি গিলে খাচ্ছেন যুবলীগ ও যুবদল নেতারা। গত ছয় মাস ধরে সেখান থেকে মাটি কেটে পুরাকীর্তি ধ্বংস করা হলেও সবাই চুপচাপ।

মাটি কাটার মেশিন দিয়ে রাত-দিন মাটি কাটা হচ্ছে। এতে প্রতিনিয়ত বের হচ্ছে প্রাচীন আমলের পুরাকীর্তির ধ্বংসাবশেষ। স্থানীয় লোকজন এগুলো কুড়িয়ে নিয়ে বিক্রি করছেন।

পুরাকীর্তি রক্ষায় এই এলাকায় মাটি কাটা বন্ধের দাবি জানিয়েছেন সদর উপজেলা যুবলীগের ত্রাণ ও সমাজ কল্যাণ সম্পাদক জাকির হোসেন।

জাকির হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, আমার ভাই আবু হোসেন তার ব্যক্তিগত জমি থেকে মাটি কেটে বিক্রি করছেন। তার মতো অনেকেই মাটি ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছেন। এগুলো বন্ধ করার দাবি জানান তিনি।

Pundro

বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র গবেষক ড. এসএম ইকবাল ঢাকা মেইলকে বলেন, গড় বা উঁচু ঢিবিগুলো কেটে ফেলায় জীববৈচিত্রের অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে। বিলুপ্ত হয়ে যাবে বন বিড়াল, শিয়াল, বেজি, সজারুসহ অনেক বন্যপ্রাণী। পাশাপাশি ভূমি ক্ষয় এবং প্রাগঐতিহাসিক অনেক নির্দশন বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

গত দুই সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন গড়ে ৫০০ ট্রাক মাটি বিক্রি করা হচ্ছে মথুরা গ্রামের পদ্মার ভিটা ও কালিদহ সাগরের আশপাশের ঢিবি কেটে।

মাটি বিক্রির নেতৃত্বে রয়েছেন বগুড়া সদর উপজেলার গোকুল ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি সাফিউর রহমান স্বপন ও শিবগঞ্জ উপজেলা যুবদলের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক হাফিজার রহমান হিরু।

সরেজমিনে দেখা গেছে, বগুড়া সদর এবং শিবগঞ্জ উপজেলার সীমান্তে ঐতিহাসিক মহাস্থান গড়ের অবস্থান। গড়ের পশ্চিমে প্রবাহিত কালিদহ সাগর। কালিদহ সাগরের পূর্ব তীরে ‘বিষমর্দন’ বা ‘বিষপত্তন’ ভিটা। দক্ষিণ পাড়ে সর্পদেবী ‘পদ্মার বাড়ি’ বা ‘পদ্মার ভিটা’। আর সেই ভিটার দক্ষিণে পদ্মপুকুর নামে আর একটি ভিটার অবস্থান। এসব স্থাপনা মথুরা গ্রামেই অবস্থিত। কালের বির্বতনে এই পদ্মার ভিটার আশপাশে জনবসতি গড়ে উঠেছে। অনেক উঁচু ঢিবির পাশ দিয়ে প্রাবাহিত কালিদহ সাগরের বুক জুড়ে এখন চাষাবাদ হয়।

স্থানীয়রা বলছেন, পদ্ম পুকুর থেকে ১২ থেকে ১৫ ফুট গভীর করে মাটি কেটে নিচু ভূমিতে পরিণত করে সেখানে বিভিন্ন ফসল চাষ করা হবে।

Pundro

এই মথুরা গ্রাম নিয়ে রয়েছে অনেক পৌরাণিক কাহিনী। মহাভারতে বর্ণিত রাজা পুণ্ড্র বাসুদেব নিজেকে দেবতা বিষ্ণুর অবতার দাবি করেন। তিনি শ্রীকৃষ্ণের জন্মস্থানের ন্যায় পুণ্ড্র অঞ্চলেও গড়ে তোলেন নানা স্থাপনা। একারণেই মহাভারতে বর্ণিত বিভিন্ন স্থাপনার ন্যায় পুণ্ড্র অঞ্চলে রয়েছে মথুরা, গোকুল, বৃন্দাবনসহ নানা এলাকা। এসব এলাকায় রয়েছে বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন।

এছাড়া পৌরাণিক কাহিনীতে বর্ণিত রাজা রামচন্দ্র দেবী দুর্গার অকাল বোধনের জন্য যে জলাশয় থেকে নীলপদ্ম সংগ্রহ করেছিলেন তার নাম ‘কালিদহ সাগর’। এই সাগরের দক্ষিণতীরেই একটি ভিটা পরিচিত ‘পদ্মপুকুর’ নামে। আর কিংবদন্তির বেহুলার শ্বশুর চাঁদ সওদাগর যে দেবীর অভিশাপে সন্তানহারা হন। সেই সর্পদেবী পদ্মার বাড়ি এই কালিদহ সাগরেরই মাঝে। যেটি ‘পদ্মার ভিটা’ নামে পরিচিত। দেবী পদ্মা আবার সাপের বিষ জমা করে রাখতেন তার বাড়ির পাশেই ‘বিষমর্দন’ ভিটায়। স্থানীয়দের কাছে তা বিষমর্দন ও বিষপত্তন ভিটা নামে পরিচিত। একারণে এসব ঢিবি বা ভিটা এই অঞ্চলের প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাক্ষী।

মহাস্থান ডাকবাংলো সড়কে নৈশ প্রহরী আব্দুল মান্নান ঢাকা মেইলকে বলেন, প্রতিদিন রাত ৮টা থেকে ভোর পর্যন্ত ২০টি ট্রাকে মাটি বহন করা হয়। সারা রাতে একেকটি ট্রাক ২০ গাড়ি মাটি নিয়ে যায়। সেই হিসেবে প্রতি রাতে ৪০০ ট্রাক মাটি যাচ্ছে। রাতে কেটে নেওয়া মাটি মহাস্থান থেকে তিন কিলোমিটার দূরে বাঘোপাড়া এলাকায় ফেলা হচ্ছে। আর দিনে কমপক্ষে ১০০ ট্রাক মাটি যাচ্ছে আশপাশের বিভিন্ন ইট ভাটায়।

মথুরা গ্রামের বাসিন্দা সিদ্দিক ঢাকা মেইলকে বলেন, রাতের বেলা এই এলাকার উঁচু ঢিবি থেকে মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। বাধ্য হয়ে আমার ১৬ শতক ঢিবি জমির মাটি ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছি। সেখান থেকে ১২ হতে ১৫ ফুট গভীর করে মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে।

Pundro

তিনি আরও বলেন, ৫০ হাজার টাকা পাচ্ছি এটাই আমার লাভ। যারা মাটি কাটছে এই এলাকায় তাদের বাধা দেওয়ার মতো কেউ নেই।

মথুরা গ্রামের বেশ কয়েকজন বাসিন্দা ঢাকা মেইলকে বলেন, ঢিবিগুলো কেটে ধ্বংস করায় লোকালয়ে শিয়াল ও বনবিড়ালের আনাগোনা বেড়ে গেছে। ছোট শিশু এবং গরু-ছাগল ও হাঁস-মুরগী নিয়ে তারা চিন্তিত।

পদ্ম পুকুর থেকে মাটি কাটতে গিয়ে এপর্যন্ত ৬টি পাত কুয়ার সন্ধান মিলেছে। সেখান থেকে পুরাকীর্তি ভগ্নাংশ উদ্ধার করা হচ্ছে। সেগুলো যে যার মতো নিয়ে যাচ্ছে।

মথুরা গ্রামের বাসিন্দা আরিফ গত ১৫ দিনে লক্ষাধিক টাকার পুরাকীর্তির ভগ্নাংশ বিক্রি করেছেন। যার মধ্যে রয়েছে একটি পোড়া মাটির মূর্তির মুখ। যা তিনি ১৪ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন। গত বুধবার পেয়েছেন একটি পোড়া মাটির শঙ্খের ভগ্নাংশ।

আরিফ ঢাকা মেইলকে বলেন, সেখান থেকে পাওয়া একপিচ পুঁতি তিনি বিক্রি করেছে ৪০ হাজার টাকায়। এখনও তার কাছে সেসব পুঁতি রয়েছে সেগুলো কয়েক লাখ টাকায় বিক্রি করবেন বলে জানান আরিফ। আরিফের মতো এই গ্রামের অনেকই প্রতিনিয়ত মাটির নিচে পাচ্ছেন প্রাচীন আমলের অসংখ্য পুরাকীর্তির অংশ বিশেষ।

ঢিবি কেটে মাটি বিক্রির নেতৃত্বদানকারি যুবলীগ নেতা সাফিউর রহমান স্বপনের কাছে মাটি কাটার বিষয়ে কথা বলতে গেলেই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন তিনি। স্বপন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘যুবলীগ নাম শুনলেই আপনাদের (সাংবাদিক) জ্বালা শুরু হয়। আমি মাটি বিক্রি করি। আর বিএনপির লেকজন মাদক বিক্রি করে। সেগুলো নিয়ে রিপোর্ট করেন?’

যুবদল নেতা হাফিজুর রহমান হিরু মাটি বিক্রির সাথে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমি সবে মাত্র অনাবাদি জমির মালিকের কাছ থেকে কিনে নিয়ে মাটি বিক্রি শুরু করেছি। এখানকার ভিটাগুলো মাটি অনেক আগে থেকেই বিক্রি হচ্ছে।’

মহাস্থান অঞ্চলের পুরকীর্তি ও প্রত্মত্বাত্বিক নিদর্শন রক্ষার দায়িত্বে থাকা মহাস্থান জাদুঘরের কাস্টডিয়ান রাজিয়া সুলতানা ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘পদ্মার ভিটা’ আর ‘বিষপত্তন’ হলো সংরক্ষিত প্রত্ন এলাকা। এর আশপাশে অনেক স্থাপনাই আছে যা ব্যক্তি মালিকানাধীন।

তিনি ঢাকা মেইলকে আরও বলেন, বৃহস্পতিবার নিজে ওই এলাকা পরিদর্শন করেছি। ব্যক্তি মালিকানার জমি থেকে মাটি কাটতে আমরা বাধা দিতে পারি না। তবে মাটির নিচে পাওয়া পুরাকীর্তি সরকারি সম্পদ। যারা এগুলো নিয়ে গেছেন প্রশাসনের সহযোগিতায় তাদের কাছ থেকে সেগুলো উদ্ধার করা হবে।

Pundro

বগুড়া সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফিরোজা পারভীন ঢাকা মেইলকে বলেন, আমি সবে মাত্র এই উপজেলায় যোগদান করেছি। এবিষয়ে আমার বিস্তারিত জানা নেই। অবশ্যই গুরুত্ব সহকারে বিষয়টি দেখা হবে।

বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র সংরক্ষণ (বিবিসিএফ) এর সভাপতি বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. এসএম ইকবাল ঢাকা মেইলকে  বলেন, ঢিবিগুলো কেটে ফেলায় সবচেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে জীববৈচিত্রের। শিয়াল, খেক শিয়াল, সজারু, বেজি, বনবিড়াল, বিষধর সাপ ছাড়াও বিভিন্ন প্রজাতির বণ্যপ্রাণী সমতল ভূমিতে বসবাস করে না। এই প্রাণীগুলো উঁচু ঢিবিতে গর্ত করে তাদের আবাসস্থল তৈরি করে। ঢিবি কেটে ধ্বংস করায় প্রাণীগুলো লোকালয়ে চলে আসবে। আবাসস্থল না থাকায় তাদের প্রজনন হবে না। লোকালয়ে এলে মানুষ তাদের পিটিয়ে মেরে ফেলবে। ফলে প্রাণীগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এছাড়াও ঢিবির জঙ্গলে বিভিন্ন প্রজাতির ফড়িং ছাড়াও বিভিন্ন পোকামাকড় থাকে। সেগুলোও বিলুপ্ত হবে। ঢিবি কেটে ফেলায় গাছগাছালি নষ্ট এবং ভূমি ক্ষয় হচ্ছে। সর্বোপরি এই গড় বা ঢিবিগুলোতে প্রচুর প্রাগৈতিহাসিক নিদর্শন রয়েছে। এগুলো ধ্বংস হওয়ার ফলে ইতিহাস মুছে যাবে। আগামী প্রজন্ম আর ওইসব ইতিহাস সম্পর্কে কিছুই জানতে পারবে না।

প্রতিনিধি/এসএস