জেলা প্রতিনিধি
১৩ জানুয়ারি ২০২৩, ০৫:০৩ পিএম
পাহাড় থেকে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যের বেতশিল্প। অথচ বেতের তৈরি আসবাবপত্রের চাহিদা ব্যাপক। বেতশিল্পটি কেউ শিখতে আগ্রহী নয়। কারিগররা পেশা বদলাচ্ছেন। যারা কোনো রকমে টিকে আছেন তারা বলছেন প্লাষ্টিক পণ্যের ভিড়ে এখনও বেতের আসবাবের চাহিদা রয়েছে। এ শিল্পকে বাঁচাতে প্রয়োজন পৃষ্ঠপোষকতা।
আগেরমতো কারিগর পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক কারিগর বেতের আসবাপত্র তৈরি কাজ ছেড়ে অন্য পেশায় জড়িয়েছেন। প্লাষ্টিক পণ্যের ভিড়ে বর্তমানে শৈল্পিক কারুকাজ ও দৃষ্টিনন্দন নিপুণ হাতে বেতের আসবাপত্র ও ফার্নিচারের জনপ্রিয়তা বাড়লেও উৎপাদন বাড়ছে না। তবু কিছু ব্যবসায়ী ব্যক্তিগত উদ্যোগে শিল্পের প্রসারে ভূমিকা রাখছেন বলে জানান।

প্রচুর চাহিদা থাকার সত্বেও কারিগর সংকটের কারণে খাগড়াছড়িতে হারিয়ে যেতে বসেছে বেত শিল্প। বেতশিল্পে অর্থনৈতিকভাবে সহযোগিতা না পাওয়া ও শেখার আগ্রহ না থাকার কারণে শিল্পটি পাহাড় থেকে হারিয়ে যেতে পারে জানান বেতশিল্প মালিকরা।
স্থানীয়রা জানান, গোলাবেত, জালিবেত, কেরাতবেত, ভুতুমবেতসহ বিভিন্ন প্রজাতির বেত জন্মে পাহাড়ে। ব্যাবসায়ীরা পাড়াপাড়ায় ঘুরে কেরাতবেত ও ভুতুমবেত কিনে খাগড়াছড়ির বাহিরে নিযে যান।
বেত দিয়ে বাচ্চাদের দোলনা, সোফাসেট, মোড়া, ডাইনিং টেবিল, খাট, চেয়ারের মতো ঘরের বিভিন্ন ধরণের আসবাপত্র তৈরি করা হয়। ঘরের সৌন্দর্য্য বদলে বেতের আসবাপত্র এনে দেয় নান্দনিক শৈল্পিক ভিন্নতা।

শহরের শান্তিনগর এলাকার বেতের আসবাপত্র তৈরির প্রতিষ্ঠানের মালিক আচুমিয়া বলেন, খাগড়াছড়িতে বেতের আসবাপত্রের প্রচুর চাহিদা আছে। কিন্তু কারিগর পাওয়া না। শিখতে কেউ আগ্রহ দেখায় না। তাই রাত জেগে কাজ করতে হয়। সময়মতো কাস্টমারদের দিতে পারি না। অথচ কাজ না জানা মানুষদের একজন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত সহযোগিতা করলে পাঁচশ থেকে সাতশ টাকা পর্যন্ত উপার্জন করতে পারে। তারপরও মানুষ পাচ্ছি না। আর আমরা কাজ শিখেছি, টাকা ছাড়া নিজের বাসা থেকে ভাত খেয়ে। তিনি বলেন, চার বছর আগে বেতের আসবাপত্রের বাজার খারাপ ছিল। এখন ভালো আছে। আমার তৈরি আসবাপত্র ঢাকা, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কুমিল্লা, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নিয়ে যায়। ৩২ বছর ধরে বেতের শিল্প শিখি চট্টগ্রাম থেকে। এই কাজ করে আমার দুই ছেলেকে ঢাকায় পড়াশুনা করাচ্ছি।

আচুমিয়া বলেন, জালি বেতের আগে দাম ছিল ৭ টাকা। বর্তমানে দাম হয়েছে ২২ টাকা। আর গোলা বেত আগে ছিল ৩০ টাকা। বর্তমানে দাম হয়েছে ৮০ থেকে ১০০ টাকা। খাগড়াছড়িতে বেতের দাম বাড়ার কারণে হচ্ছে চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যায়।
বেত শিল্পর কারিগর আলী আযম বলেন, মাঝখানে প্লাষ্টিক বের হয়ে কিছুটা চাহিদা কমেছে। কিন্তু দুই এক বছর ধরে ভালো চাহিদা রয়েছে। আঠার বছর ধরে এই বেত দিয়ে ঘরের আসবাপত্র তৈরির কাজটি করছি। এই কাজ শিখে স্বাবলম্বী হওয়া সম্ভব। এই কাজ করে সংসার ভালো চলে।
খাগড়াছড়ি চেম্বার অব কর্মাসের পরিচালক মো. দিদারুল আলম বলেন, বেত একটি ঐতিহ্যবাহী শিল্প। এ শিল্পকে এখনও জাগিয়ে রাখা সম্ভব। খাগড়াছড়িতে পরিকল্পিতভাবে বেত শিল্পের কারখানা তৈরি হলে ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি ব্যাপক কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হবে।
তৃণমূল উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক রিপন চাকমা বলেন, পাহাড়ের হস্তশিল্প নিয়ে আমরা কিছু কাজ করি। বেত গাছ বড় গাছে ভর করে বেয়ে উঠে। অতি মুনফার লোভে বেত গাছ রাখছে না মানুষ। আম যেভাবে প্রতি বছর ফল দেয়। বেত ওইভাবে দেয় না। মানুষ অনেক দ্রুত আশা করে। বেতশিল্প পাহাড়ে কীভাবে আশা করা যায়।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) উপ-ব্যবস্থাপক অমিত বড়ুয়া বলেন, বেতশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছি। বিসিক বেতের আসবাপত্র তৈরির উপর প্রশিক্ষণ দিতে প্রস্তুত। কেউ শিখতে আগ্রহী নয়। কারণ এখন কম্পিউটারের যুগ। এখন আর কেউ বেতের কাজ শিখতে চাই না। তারা মনে করে এই কাজ শিখে কোনো কাজে আসবে না। অথচ বাজারে বেতের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। বিসিক চার মাসের বেতের আসবাপত্র তৈরির প্রশিক্ষণের সুযোগ রয়েছে। আমরা মানুষ পাচ্ছি না। কেউ আমাদের কাছে আসলে লোনের মাধ্যমে আর্থিক সহযোগিতা করার চেষ্টা করব।

খাগড়াছড়ি বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা মো. হুমায়ুন কবির বলেন, বেতের তৈরি আসবাপত্র শৌখিন হিসেবে ব্যবহার করেন। খুব শক্ত আসবাপত্র হয়। পার্বত্য অঞ্চলে মূলত কেরাকবেত ভুতুমবেত, গোলকবেত ইত্যাদি পাওয়া যায়। এই বেতগুলোর আসবাপত্র পাহাড়ে সম্ভাবনাময় শিল্প। এই ক্ষুদ্র শিল্পের মানুষ কর্মসংস্থান তৈরি করেছে। পার্বত্য অঞ্চলে এই শিল্পের ব্যাপক প্রসার গড়বে।
তিনি আরও বলেন, প্রতিমিটার বেত রাজস্ব নিধারণ করা আছে ৫০ পয়সা। জালিবেতসহ অন্যান্য বেত ২০ পয়সা করে।
প্রতিনিধি/এসএস