images

সারাদেশ

বগুড়া-১ আসনে চলছে প্রার্থীদের তৎপরতা

জেলা প্রতিনিধি

২৯ ডিসেম্বর ২০২২, ০৫:১৪ পিএম

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এখনও এক বছর বাকি রয়েছে। ইতোমধ্যে বগুড়া-১ (সারিয়াকান্দি-সোনাতলা) আসনে শুরু হয়েছে আলোচনা। নির্বাচনে প্রার্থী হতে আগ্রহী রাজনৈতিক দলের নেতারাই বিভিন্নভাবে ভোটারদের মনে করিয়ে দিচ্ছেন জাতীয় সংসদ নির্বাচন এগিয়ে আসছে।

ভোটাররাও এই সুযোগে প্রার্থীদের কাছ থেকে আদায় করে নিচ্ছেন তাদের কাজ-বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি। তবে এই আসনে আগ্রহী প্রার্থীদের অধিকাংশই ‘ভিআইপি’ বলে জানিয়েছেন স্থানীয় ভোটাররা। 

ভিআইপি এসব প্রার্থীদের অনেকে ঢাকায় অবস্থান করে ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। তারা তাদের মনোনীত ব্যক্তির মাধ্যমে ভোটারদের কাছে সালাম পৌঁছানোর পাশাপাশি চাওয়া-পাওয়া মেটানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন।  

বগুড়া জেলার ১২টি উপজেলা নিয়ে ৭টি সংসদীয় আসন। এরমধ্যে সোনাতলা এবং সারিয়াকান্দি উপজেলা নিয়ে গঠিত বগুড়া-১ আসন। 
ভৌগলিকভাবে এই দুইটি উপজেলা দিয়ে যমুনা নদী প্রবাহিত হওয়ায় চরাঞ্চল রয়েছে বেশ কিছু এলাকা। এসব চরাঞ্চলে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম নৌকা। যার কারণে নির্বাচনের আগ মুহূর্ত ছাড়া প্রার্থীদের অনেকেই চরাঞ্চলের ভোটারদের সঙ্গে সরাসরি দেখা-সাক্ষাত করেন না বলে অভিযোগ রয়েছে।

এই আসনে গত ইউপি নির্বাচনের তথ্য অনুযায়ী, ভোটার রয়েছেন ৩ লাখ ৩৬ হাজার ২৯৮ জন। এরমধ্যে সোনাতলা উপজেলায় ১ লাখ ৫৫ হাজার ৪৯৪ জন এবং সারিয়াকান্দি উপজেলায় ১ লাখ ৮০ হাজার ৮০৪ জন। 

দুই উপজেলা ঘুরে ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগামী সংসদ নির্বাচনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বেশ কয়েকজন প্রার্থীর নাম শুনেছেন তারা। কিন্তু মাঠে তৎপর রয়েছেন বর্তমান সরকার দলীয় সংসদ সদস্য সাহাদারা মান্নান ও বিএনপি-র সৈয়দ আহসানুল তৈয়ব জাকির। 

সোনাতলা উপজেলার মধুপুর ইউনিয়নের ভোটার আসাদুর, মাজেদুর বলেন, আগামী নির্বাচনে মানুষ ভোট দেওয়ার সুযোগ পেলে বিএনপি থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবেন। 

সারিয়াকান্দি উপজেলার কড়িতলা এলাকার ভোটার মজিদ, হাতেম আলী, কালিতলা এলাকার সামসুল, হকসহ আরও কয়েকজন ভোটার বলেন, গত ১৪ বছরে এই এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন করেছে আওয়ামী লীগ। আগামীতেও মানুষ আওয়ামী লীগকে ভোট দিবেন। 

ভোটাররা বলেন, সাহাদারা মান্নান সংসদ সদস্য হিসেবে এলাকায় কাজ করছেন আর সৈয়দ আহসানুল তৈয়ব জাকির সাংগঠনিক দায়িত্বের ফাঁকে নিজেকে প্রার্থী হিসেবে প্রচার করছেন।

বগুড়া-১ আসন বিএনপির দুর্গ হিসেবে পরিচিত ছিল। এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ছিলেন আব্দুল মান্নান। ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির সেই দুর্গ ভেঙে তিনি আওয়ামী লীগ থেকে প্রথমবারের মতো বগুড়া-১ আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি নৌকা মার্কায় ভোট পেয়েছিলেন ১ লাখ ২৭ হাজার ১ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির মোহাম্মদ শোকরানা ধনের শীষ মার্কায় পেয়েছিলেন ১ লাখ ২১ হাজার ৯৬৫ ভোট। 

২০১৪ সালে দশম সংসদ নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বে চার দলীয় জোট ভোট বর্জন করে। সেই সময় অন্য দলের প্রার্থীদের সঙ্গে সমঝোতা করে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আব্দুল মান্নান আবারও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপি আওয়ামী লীগসহ চারজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। বিএনপি তাদের প্রার্থী পরিবর্তন করে সাবেক সংসদ সদস্য কাজী রফিকুল ইসলামকে মনোনয়ন দিলে তিনি আব্দুল মান্নানের কাছে পরাজিত হন। 

সংসদ সদস্য আব্দুল মান্নান ২০২০ সালে ১৮ জানুয়ারি মারা যান। পরে ওই আসনে উপনির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন আব্দুল মান্নানের স্ত্রী সাহাদারা মান্নান। তিনি ২০০৮ সালে রাজনীতিতে নামেন এবং সারিয়াকান্দি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। আগামী নির্বাচনেও তিনি আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন নিয়ে সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি হিসেবে সোনাতলা-সারিয়াকান্দি উপজেলার তৃণমূল পর্যায়ে চষে বেড়াচ্ছেন। 

এছাড়াও আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশায় এলাকায় যোগাযোগ রাখছেন কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি ঢাকায় বসবাসকারী ঠিকাদার ম. রাজ্জাক, সারিয়াকান্দি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান রেজাউল করিম মন্টু, সারিয়াকান্দি পৌরসভার মেয়র ও সারিয়াকান্দি উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মতিউর রহমান মতি, ঢাকায় বসবাসকারী বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য কাজী রফিকুল ইসলাম, সোনাতলা উপজেলা বিএনপির সভাপতি সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান সৈয়দ আহসানুল তৈয়ব জাকির, জাতীয় পার্টির সারিয়াকান্দি উপজেলার সাবেক সভাপতি মকছুদুল আলম এবং জামায়াতে ইসলামীর সাবেক জেলা আমির অধ্যক্ষ শাহাবুদ্দিন আহম্মেদ। 

প্রার্থী হিসেবে উল্লেখিত ব্যক্তিদের নাম শোনা গেলেও মাঠে নেই অনেকেই। জামায়াত ইসলামী কয়েক মাস আগেই শাহাবুদ্দিন আহম্মেদকে বগুড়া-১ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করলেও অসংখ্য নাশকতা মামলা মাথায় নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে তিনি পলাতক। ম. রাজ্জাক প্রার্থী হওয়ার জন্য বেশ কয়েক বছর এলাকায় কখনও নিজে আবার কখনও মনোনীত ব্যক্তি এবং নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। কিন্তু তিনি সবার ফোন রিসিভ করেন না। মনোনীত ব্যক্তিদের মাধ্যমে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও ম. রাজ্জাক ফোন রিসিভ করেননি।

সারিয়াকান্দি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান রেজাউল করিম মন্টু বলেন, গত ২০২০ সালে উপনির্বাচনে আমি দলীয় মনোনয়ন চেয়ে পাইনি। এবার আবারও চাইব। 

তিনি বলেন, বর্তমান সংসদ সদস্য সাহাদারা মান্নান পুরাতন নেতাদের মাইনাস করে কাজ করছেন। উপজেলা পরিষদ ভোটের আগে চেয়ারম্যান পদে মনোনয়নের জন্য সাহাদারা মান্নান আমার নাম কেন্দ্রে পাঠায়নি। তিনি তখন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। কিন্তু তারপরেও দল আমাকেই চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন দিলে আমি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছি।  

তিনি আরও বলেন এসব কারণে সংসদ সদস্যের সঙ্গে আমার দুরত্ব তৈরি হলেও প্রকাশ্যে কোনো বিরোধ নাই। 

রেজাউল করিম মন্টু বলেন, আওয়ামী লীগ এখনও ভাল অবস্থানে আছে, আগামী নির্বাচনে আবারও জনগণ নৌকা মার্কার প্রার্থীকে জয়ী করবেন।

সারিয়াকান্দি পৌরসভার মেয়র মতিউর রহমান মতি বলেন, সোনাতলা-সারিয়াকান্দিতে আওয়ামী লীগের বিকল্প নাই। গত ১৪ বছরে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। পাশাপাশি আওয়ামী লীগের ভোটও বেড়েছে। 

তিনি বলেন, আমি নিজেও প্রার্থী হতে আগ্রহী। দলের কাছে আমিও মনোনয়ন চাইবো।

দল ক্ষমতায় থাকার কারণে আওয়ামী লীগ থেকে অসংখ্য প্রার্থীর নাম শোনা গেলেও বিএনপির প্রার্থী হতে পারে এমন দুইজনের নামই শোনা যাচ্ছে। ২০০৮ সালে বিএনপি থেকে নির্বাচন করা মোহাম্মদ শোকরানা অনেক আগেই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন রাজনীতি থেকে। তিনি আর নির্বাচন করবেন না বলে জানিয়েছেন। 

আরেক প্রার্থী সৈয়দ আহসানুল তৈয়ব জাকির বলেন, ২০২০ সালে উপনির্বাচনে বিএনপি থেকে আমাকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছিল। ভোটগ্রহণের আগ মুর্হূতে করোনা এবং বন্যা পরিস্থিতির কারণে দল নির্বাচন থেকে সরে আসে। 

সুষ্ঠু ভোট হলে বিএনপি আবারও আসন ফিরে পাবে উল্লখ করে তিনি বলেন, ২০০৮ সালে পার্শ্ববর্তী ধুনট উপজেলার গোসাইবাড়ি এবং ভান্ডারবাড়ি ইউনিয়নের ভোটারদেরকে বগুড়া-১ আসনের সঙ্গে সস্পৃক্ত করায় প্রায় ৫ হাজার ভোটে আওয়ামী লীগ প্রার্থী জয়ী হন। এবার ওই দুই ইউনিয়ন বগুড়া-১ আসনের সঙ্গে নেই। 

তিনি আরও বলেন, আমাকে দল থেকে সোনাতলা এবং সারিয়াকান্দি উপজেলার সাংগঠনিক দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এ কারণে আমি বিএনপি ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, পৌরসভা, উপজেলা কমিটি গঠনের দায়িত্বে ছিলাম। এ কারণে দুই উপজেলার তৃণমূল পর্যায়ের লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে। 

মনোনয়ন প্রত্যাশী সাবেক সংসদ সদস্য কাজী রফিকুল ইসলাম বলেন, ২০০১ সালে নির্বাচিত হয়ে আমার মেয়াদকালে ১ হাজার ২শ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছি। রাস্তা, ব্রিজ, কালভাট, বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধ, নদী তীর সংরক্ষণ থেকে শুরু করে দৃশ্যমান যত উন্নয়ন বিএনপির আমলে হয়েছে। বিএনপির সময় সারিয়াকান্দি উপজেলার পারতিতপরল নামকস্থানে যমুনা ও বাঙ্গলী নদী একিভূতরোধ কল্পে বাঁধ নির্মাণের ফলে মানুষের যে উপকার হয়েছে, তা এখন কেউ ভুলে যায়নি। 

তিনি বলেন, এখন যা হচ্ছে সেগুলো রুটিনওয়ার্ক। বর্তমান সময়ে উন্নয়নের চাইতে সংসদ সদস্য তার পরিবারের লোকজন লুটপাট করছেন বেশি।

ওই আসনের সংসদ সদস্য সাহাদারা মান্নান বলেন, দলে কোনো বিরোধ নাই। প্রতিযোগিতা থাকবেই। নির্বাচনের আগে এধরনের প্রতিযোগিতা দেখা যায়।

তিনি বলেন, গত ১৪ বছরে আমার প্রয়াত স্বামী এবং আমি সোনাতলা-সারিয়াকান্দিতে চার হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ করেছি। চরাঞ্চলে ব্যাপক উন্নয়ন কাজ হয়েছে এবং হচ্ছে। যমুনা নদীর তলদেশ দিয়ে বিদ্যুতের লাইন পার করে চরের মানুষকে বিদ্যুৎ ব্যবহারের সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। 

সংসদ সদস্য বলেন, আমি এই জনপদের মাটিও মানুষের সঙ্গে আছি। আগামীতে নির্বাচনে আমি মনোনয়ন পাব বলে আশা করি। তারপরেও নৌকা মার্কা যে পাবে, আমি তার সঙ্গেই থাকব।

প্রতিনিধি/এইচই