জেলা প্রতিনিধি
০৮ নভেম্বর ২০২২, ০৯:৩২ এএম
বাড়ির ছোট্ট উঠোন। সেই উঠোনের এক কোনো পাতানো মাদুর, সেই মাদুরে বসেই স্বামী স্ত্রী মিলে আপন মনে বেত দিয়ে তৈরি করে চলেছেন হরেক রকমের জিনিস। হাতের নিপুণ ছোঁয়া আর বেতের সঙ্গে পেরেক ঠোকার অল্প সময়ের মধ্যেই তৈরি হয়ে যাচ্ছে এসব নান্দনিক জিনিস।
সারাদিন এই কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকেন তারা, যেন এক মুহূর্তের জন্যও দম ফেলার সুযোগ নেই তাদের। তাদের তৈরি এ শিল্প এখন দেশ ছাড়িয়ে পৌঁছে যাচ্ছে বিদেশেও। বিদেশে দারুণ কদর আছে এসব নান্দনিক পণ্যের। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রেখে নেওয়া যাবে এক অন্যন্য উচ্চতায়, এমটাই আশা সংশ্লিষ্টদের।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মাদারীপুর সদর উপজেলার খোয়াজপুর ইউনিয়নের চর গোবিন্দপুর উত্তর কান্দি গ্রামের বাসিন্দা পঞ্চাশোর্ধ শাহ-আলম আকন। অর্থাভাবে মাধ্যমিকের গন্ডি পেরোনোর সুযোগ হয়নি তার। ছোট কাকা ওলিউর আকনের কাছ থেকেই প্রথম এ কুটিরশিল্পে হাতে খড়ি হয় শাহ-আলম আকনের। অল্প দিনেই শাহ-আলম রপ্ত করে নেন এ কারুশিল্পের কাজ। বর্তমানে তিনি একজন দক্ষ কারিগর। তার এ কারুশিল্পের মধ্যে রয়েছে খাট, দোলনা, পালকি, ওভাল গোল চেয়ার, স্কয়ার সোফা সেট, রকিং চেয়ার, নৌকা, মোরগ, মাইক, প্রজাপতি, আনারস, বাপুরাম সাপুরে, রিকশা, সাইকেল, ঘোড়া, কলমসহ কমপক্ষে ৫০ আইটেম। একটি জিনিস দেখা মাত্রই বেতের সাহায্যে অনায়াসেই তৈরি করে ফেলতে পারেন সে জিনিসটি।
তার এ কাজে সাহায্য করেন তার স্ত্রী রেবেকা সুলতানা। এছাড়াও পড়াশোনার পাশাপাশি বড় ছেলে হৃদয় রায়হান, ছোট ছেলে রিজভী রায়হান ও ছোট মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌসও কাজে হাত লাগায়। হাতে তৈরি কারুকাজের অপূর্ব এ শিল্পের সঙ্গে গভীর যোগসূত্র রয়েছে তাদের। তাদের তৈরি নান্দনিক এ জিনিসপত্র চলে যাচ্ছে ঢাকা, বরিশাল, খুলনা, চট্টগ্রাম সহ বাহিরের দেশ কানাডা, সিংগাপুর, লন্ডনেও। প্রথমে নারায়ণগঞ্জ, বরিশাল, শরীয়তপুরের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বেত সংগ্রহ করেন তিনি। পরে নানা আকৃতিতে কাটা হয় সেই বেত। এসব কাটা বেত দিয়ে ধাপে ধাপে পেরেক আর বেতের সুতার সাহায্যে এসব জিনিস তৈরি করেন থাকেন তিনি। বানানোর পরে করা হয় হালকা রঙের পালিশ। এখান থেকেই শাহ-আলম প্রতি মাসে আয় করেন ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। আর এ আয় দিয়েই চলছে তার ৭ সদস্যের পরিবার।
একসময় তার এখানে কাজ করতেন বেশ কয়েকজন কর্মচারী, তবে মহামারি করোনা ভাইরাসের কারণে অর্থ সংকটে পড়ায় ছাড়তে হয়েছে সেসব কর্মচারীদের। সেই অর্থ সংকট এখনো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি তার। বর্তমানে টাকার অভাবে মালামাল কিনতে না পাড়ায় অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়েছে তার এই কুটিরশিল্পের কাজ। এখন শুধু পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এ কাজ করে থাকেন তিনি। তবে সরকারের সুদৃষ্টি পড়লে এ শিল্পকে ধরে রেখে হাজারো বেকারের কর্মসংস্থানের সুযোগ করতে পারবে বলে মনে করেন তিনি।
সরেজমিনে শাহ-আলম আকনের বাড়িতে দেখা যায়, উঠোনের মাদুর বিছিয়ে স্বামী স্ত্রী দুজন মিলে তৈরি করছেন বেতের তৈরি নানা রকমের জিনিস। তাদের পাশাপাশি এ কাজে সাহায্য করছেন ছোট ছেলে রিজভী রায়হান। শাহ-আলম হাতুরি হাতে পেরেক ঠুকে ঠুকে এসব জিনিস তৈরি দিচ্ছেন স্ত্রী রেবেকা সুলতানার হাতে। রেবেকা সুলতানা আবার বেতের তৈরি সুতার সাহায্যে দিচ্ছেন বাঁধন। বাঁধনের শেষে পালিশের কাজ করা হচ্ছে। এভাবেই সকাল থেকে শুরু হয়ে তাদের এ কর্মব্যস্ততা শেষ হয় সূর্য ডোবার মধ্য দিয়ে।
চর গোবিন্দপুর উত্তর কান্দি এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা শামসুল হক মাতুব্বর (৬৫) জানান, শাহ-আলম একসময় কয়েকজন কর্মচারী নিয়ে কাজ করতো। এখন পুঁজি কমে যাওয়ার নিজেরাই কাজ করে। সরকার থেকে ওরে যদি আর্থিকভাবে সাহায্য করতো, তাহলে ও এই কাজটা ধরে রাখতে পারতো।
পাশের বাড়ির দশম শ্রেণির স্কুল পড়ুয়া শিক্ষার্থী জান্নাতুল নেসা বলেন, ‘আমি পড়াশোনার পাশাপাশি শাহ-আলম কাকার কাছে এখানে হাতের কাজ শিখি। এখন টাকার অভাবে কাকার কাজ কমে গেছে। তাই আমারও কম আসা হয়। সরকার থেকে এখানে যদি একটা কারখানার ব্যবস্থা করা হতো, আমার মতো অনেক ছেলে মেয়েরা পড়াশোনার পাশাপাশি এখানে কাজটা শিখে স্বাবলম্বী হতে পারতো।’
শাহ-আলম আকনের স্ত্রী রেবেকা সুলতানা (৩৫) বলেন, ‘আমার স্বামী বেতের তৈরি কুটির শিল্পের কাজ করে। আমি ঘরের কাজের পাশাপাশি তার কাজে এ কাজে সাহায্য করি। আমাদের ঘরের এখন সবাই এই কাজটা পারে। এ কাজটা অনেক পুরান ঐতিহ্যের। এ কাজ করতে অনেক টাকার চালান দরকার। বর্তমানে আমাদের চালান পুঁজি কম থাকায় কাজটা দিন দিন কমে যাচ্ছে। আমরা এ কাজটা ধরে রাখতে চাই।’
কথা হয় কারুশিল্পী শাহ-আলম আকনের সঙ্গে। তিনি ঢাকা মেইলের এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘৩০ বছর ধরে আমি এ কাজটির সঙ্গে আছি। দেশে বিদেশে আমার এ কাজের অনেক চাহিদা আছে। কানাডা, সিংগাপুর, লন্ডন থেকে আমার হাতের তৈরি মালামালের অর্ডার আসে। এখন চালানের অভাবে আমার কাজটা দিন দিন কমে যাচ্ছে। সরকার থেকে আমাকে যদি একটা কারখানা তৈরি করে দেয় আর কিছু আর্থিক সাহায্য করে তাহলে এ শিল্পটাকে ধরে রাখতে পারবো।’
মাদারীপুর জেলা প্রশাসক ড. রহিমা খাতুন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমি জানতে পেরেছি খোয়াজপুর ইউনিয়নের চর গোবিন্দপুর এলাকার শাহ-আলম আকন বেত ও বাঁশ দিয়ে চমৎকার সব জিনিস তৈরি করতে পারেন। আমাদের দেশে এখন এমন যোগ্য লোকের প্রয়োজন। তার সঙ্গে কথা বলে তাকে কীভাবে সাহায্য করা যায় ও তার দক্ষতাকে কাজে লাগানো যায় আমরা সেই চেষ্টা করবো।’
টিবি