জেলা প্রতিনিধি
২৪ অক্টোবর ২০২২, ০৭:১৪ পিএম
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট গভীর নিম্নচাপটি ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ে রূপ নিয়েছে। ক্রমশ এটি শক্তি বাড়িয়ে বাংলাদেশের উপকূলের দিকে এগিয়ে আসছে। সিত্রাংয়ে প্রভাবে গতকাল মধ্যরাত থেকে সাতক্ষীরায় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। একই সঙ্গে বইছে দমকা হাওয়া। ক্রমশ বাতাসের গতি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
জেলার শ্যামনগর ও আশাশুনি উপকূলীয় এলাকাজুড়ে জরাজীর্ণ বেড়িবাঁধ নিয়ে দেখা দিয়েছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা।
আইলা, সিডর ও আম্পানের পরে আবারও ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের আঘাতের খবরে জলোচ্ছ্বাসের শঙ্কায় রীতিমত আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে সাতক্ষীরার উপকূলের মানুষ। আম্পানের ক্ষতি এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি অনেকে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে জিও শিট দিয়ে শ্যামনগরের দুর্গাবাটি এলাকার ভাঙন কবলিত বাঁধের প্রায় ১৫০ মিটার ঢেকে দেওয়া হয়েছে। তবে, শ্যামনগরের দাতিনাখালী, পশ্চিম কৈখালীসহ জেলেখালী, নেবুবুনিয়া, পদ্মপুকুর ও গাবুরার অন্তত চারটি পয়েন্টের বাঁধ অত্যান্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এছাড়া আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের কুড়িকাউনিয়া, নাকনা, রুয়েরবিল, চুইবাড়িয়া, দৃষ্টিনন্দন ক্লোজার, হরিষখালী ও কামারখালী, আনুলিয়া ইউনিয়নের বিছট, নয়াখালী, কাকবসিয়ার দু’টি পয়েন্ট, মনিপুর, দক্ষিণ একসরা ও নাংলা, শ্রীউলা ইউনিয়নের কোলা ও হাজরাখালী, খাজরা ইউনিয়নের গদাইপুর ও খাজরা ইউনিয়ন পরিষদের সামনে, বড়দল ইউনিয়নের কেয়ারগাতি এবং আশাশুনি সদরের বেশ কয়েকটি স্থানে বেড়িবাঁধ ঝুকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।
ভাঙনকবলিত এসব এলাকা গুলো কপোতাক্ষ নদ ও খোলপেটুয়া নদী দ্বারা বেষ্টিত। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে এসব নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঝুকিপূর্ণ বাঁধ ভেঙে অথবা ছাপিয়ে এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়বে।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, রোববার মাঝরাত থেকে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সেই সঙ্গে বইছে দমকা হাওয়া। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাতাসের গতিবেগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঝড়ের সঙ্গে একই সময়ে জোয়ারের তীব্রতা বৃদ্ধি পেলে পাউবো’র বেড়িবাঁধ ভেঙে ও ছাপিয়ে লোকালয়ে জোয়ারের পানি প্রবেশের আশংকায় উৎকণ্ঠায় রয়েছে উপকূলীয় এলাকায় বসবাসকারি লোকজন।
ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কায় ইতোমধ্যে অনেকে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে শুরু করেছেন। অনেকে সরিয়ে নিচ্ছেন তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র।
শ্যামনগরের পোড়াকাটলা গ্রামের প্রভাষক পরীক্ষীত মন্ডল জানান, তাদের বাড়ির সম্মুখভাগে দুর্গাবাটি এলাকার বেড়িবাঁধ খুবই ঝুকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। কয়েক মাস আগে কোটি টাকা ব্যয়ে বাঁধ সংস্কার সত্ত্বেও চর দেবে গিয়ে সেখানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। নদীতে জোয়ারের সঙ্গে যদি ঝড় মারাত্মক আকার ধারণ করে তবে সমগ্র এলাকা প্লাবিত হয়ে যাবে।
নৈকাটি গ্রামের আনিছুর রহমান জানান, দীর্ঘদিন ধরে তাদের এলাকার বাঁধ জীর্ণশীর্ণ ও সরু আইলের আকৃতি নিয়ে আছে। সম্প্রতি ভাঙন কবলিত অংশের পাশে কিছু বালুভর্তি জিও ব্যাগ দেয়া হলেও সেখানকার পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়াবহ। সাগরে নিন্মচাপের কারণে তাদের এলাকার শতাধিক পরিবার ভাঙন আতংকে রয়েছে।
গাবুরা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মাসুদুল আলম জানান, চারপাশে নদীবেষ্ঠিত গাবুরাকে ঘিরে থাকা বাঁধ আইলার পর থেকে বেশ নিচু হয়ে আছে। এছাড়া ইয়াস ও আম্পানের পর থেকে বড়গাবুরা, হরিশখালীসহ কয়েকটি অংশের বাঁধও বেশ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে টেকসই বাঁধ নির্মাণের প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও অদ্যাবধি কাজ শুরু হয়নি। এমতাবস্থায় ইউনিয়নের ৪০ হাজারের বেশী মানুষ ঘূর্ণিঝড়ের আশংকায় শংকিত হয়ে পড়েছে।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড বিভাগ-২এর সেকশন অফিসার মাসুদ রানা জানান, পাউবো’র প্রধান প্রকৌশলীসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা শ্যামনগরের ভাঙন কবলিত নেবুবুনিয়াসহ বিভিন্ন এলাকা পরির্দশন করেছেন। পাউবোর পক্ষ থেকে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করে সেখানে জিও ব্যাগ স্থাপনসহ জিও শিট বিছানো এবং মাটি দেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে। সোমবারও ঝুকির্পর্ণ এসব স্থানে কাজ অব্যহত রয়েছে।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড বিভাগ-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডেও দু’টি বিভাগের আওতায় ৭৮০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। যার মধ্যে ২০০ কিলোমিটারের ৩৫টি পয়েন্ট ঝুঁকিপূর্ণ। ইতোমধ্যে আম্ফানে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধগুলো সংস্কার করা হয়েছে। তাছাড়া বাকি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় দুর্যোগ মোকাবিলায় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
সাতক্ষীরা আবহাওয়া অধিদফতরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জুলফিকার আলী রিপন জানান, ঘূর্ণিঝড়টি আজ রাতে সাতক্ষীরা উপকূলে আঘাত হানতে পারে। সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকার নদ-নদীতে জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে ৫ থেকে ৮ ফুট উচ্চতায় জলোচ্ছ্বাস হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হুমায়ূন কবির জানান, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং মোকাবেলায় ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে জেলা প্রশাসন। ইতোমধ্যে উপকূলীয় উপজেলা প্রশাসনকে দুর্যোগ মোকাবিলায় অগ্রিম প্রস্তুতি নিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। জেলায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুটি বিভাগের ৭৮০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে ৮০ কিলোমিটার বাঁধের মধ্যে ১০টি পয়েন্টে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। বেড়িবাঁধ ভাঙন এড়াতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে ২০ হাজার জিও ব্যাগ মজুদ রাখা হয়েছে।
জেলা প্রশাসক আরও জানান, সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি উপজেলায় ১০৮টি এবং শ্যামনগর উপজেলায় ১০৩টি আশ্রয় কেন্দ্রসহ ৪৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এছাড়া দূর্যোগ মোকাবেলায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শুকনো খাবার, প্রয়োজনীয় ওষুধ, সুপেয় পানিসহ প্রয়োজনীয় সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। প্রস্তুত রয়েছে ছয় হাজার স্বেচ্ছাসেবক। এছাড়া দুর্যোগকালীন জরুরি সেবার জন্য জেলায় খোলা হয়েছে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ।
প্রতিনিধি/এইচই