images

সারাদেশ

অস্তিত্ব সংকটে চৌমুহনীর খাল: চলছে দখলের মহোৎসব

জেলা প্রতিনিধি

৩০ আগস্ট ২০২২, ০২:৫০ পিএম

চৌমুহনী—বৃহত্তর নোয়াখালীর ঐতিহ্যবাহী প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র। একসময় এখানে ছিল নদীবন্দর—চারটি প্রবাহমান খালের মিলনকেন্দ্রকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল প্রসিদ্ধ নদীবন্দর। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এখানে আসতো নানা ধরনের পণ্যসামগ্রী। পণ্যবাহী নৌকাতে সারাদিন চলতো মালামাল উঠা-নামা, ব্যবসায়ীদের হাঁক-ডাক। সারাক্ষণ সরগরম হয়ে থাকতো নদীবন্দরটি। 

দেশীয় ও মাড়োয়ারিদের ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল চৌমুহনী বাজারে। চৌমুহনীর সঙ্গে দেশের সকল নদ-নদীর সংযোগ ছিল। চাঁদপুর, ভৈরব ও নারায়নগঞ্জের সঙ্গে পণ্য পারাপারে নৌ পরিবহন ছিল একমাত্র ভরসা। এসব অঞ্চল থেকে বড় বড় সাম্পান ও ডিঙ্গি নৌকায় মালবোঝাই করে চৌমহনী বাজারে সরবরাহ হতো। 

বাণিজ্যিকভাবে চৌমুহনী বাজার এতোটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল—১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম বিভাগের মধ্যে চৌমুহনী রেলওয়ে স্টেশন বাণিজ্যিকভাবে প্রথম স্থান অর্জন করে।

চৌমুহনী বাজারের সঙ্গে নৌ-যোগাযোগের সুবাদে এখানে প্রকাশনা শিল্প গড়ে ওঠে। ১৯৪৫ সালে চৌমুহনী বাজারে চিত্তরঞ্জন সাহা একটি ছাপাখানা স্থাপন ও পরবর্তীতে পুঁথিঘর স্থাপনের মাধ্যমে প্রকাশনা শুরু করেন। পরবর্তীতে চৌমুহনী বাজার ছিল প্রকাশনা শিল্পের জন্য দেশজোড়া খ্যাতি। ১৯৬৩ সালে চৌমুহনীতে বেসরকারি উদ্যোগে দেশের বৃহৎ পাটকল ডেল্টা জুট মিল চালু হবার পর চৌমুহনী বাজারের গুরুত্ব রাতাারতি বৃদ্ধি পায়। সে সময় চৌমুহনী থেকে নৌপথে পাটজাত পণ্য দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ হতো। নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও ফেনী থেকে বিপুল পাট নৌপথে ডেল্টা জুটি মিলে সরবরাহ হয়।

chowmuhani

চৌমুহনী বাজারে দুইদিন অর্থাৎ শনিবার ও মঙ্গলবার সাপ্তাহিক হাট বসে। এক সময় হাটের দিনে চৌমুহনীর নৌঘাটে মালামাল পারাপারের অপেক্ষায় শত শত সাম্পান ও পালতোলা নৌকা ভিড় করতো। সন্ধ্যার পর দেশের বিভিন্ন স্থানের উদ্দেশ্যে নৌযানগুলো পালতুলে যাত্রা শুরু করতো।

কর্মচাঞ্চল্য সেই নদীবন্দরটি এখন অনেকটা রূপকথায় পরিণত হয়েছে। বিশাল নদীবন্দর এখন সুরু খাল। আগাছা আর ঝোপের ভিড়ে বোঝাই যায় না এখানে খাল ছিল। দখল আর দূষণের কবলে খালগুলো রয়েছে অস্তিত্ব সংকটের মুখে। প্রভাবশালীদের দৌরাত্ম্যে খালের পাড়ে গড়ে উঠেছে অবৈধ সব স্থাপনা। গড়ে তোলা হয়েছে দোকানপাট, আবাসিক ভবন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। 

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চৌমুহনী-আটিয়াবাড়ি, চৌমুহনী-ছাতারপাইয়া, চৌমুহনী-তুলাতলী ও চৌমুহনী-চন্দ্রগঞ্জ খালের মোহনার সংযোগকে কেন্দ্র করে ‘চৌমুহনী’ নামকরণ হয়। 

চৌমুহনী বাজারের আশপাশে খালগুলোর বিভিন্ন অংশে মাটি ভরাট করে পানি চলাচলের উৎস বন্ধ করা হয়েছে। বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান মাটি ভরাট করে খালের অস্তিত্ব মুছে ফেলছে। খাল দখল করে গড়ে উঠেছে আবাসিক ভবন ও দোকানপাট। ফলে বর্ষা মৌসুমে পানি নিস্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় বেগমগঞ্জ, বজরা, সোনাইমুড়ি, চাটখিল উপজেলার বিশাল এলাকা মাসের পর মাস পানিতে ডুবে থাকে।

chowmuhani

নোয়াখালী পানি উন্নয়ন বোর্ডের দাবি ২০১৯-২০ অর্থ বছরে তিন কোটি টাকা ব্যয়ে প্রায় ১৬ কিলোমিটার খাল পুনঃখনন করা হয়েছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, চৌমুহনী বাজারের গুরুত্বপূর্ণ খালগুলো পুনঃরুদ্ধারে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন এখন পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। এতে খাল দখলের মহোৎসব চলছে সমান গতিতে। 

স্থানীয় প্রবীণ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চৌমুহনী বাজার থেকে দক্ষিণে মেঘনা নদী পর্যন্ত নৌযোগাযোগ ছিল। স্বাধীনতা পরবর্তীতেও নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও ফেনী জেলার মধ্যে নৌ-যোগাযোগ ছিল। বিশেষ করে চৌমুহনী বাজার থেকে নৌপথে পণ্য পারাপার হতো।

তবে তাদের অভিযোগ চৌমুহনী বাজারের গুরুত্বপূর্ণ খালগুলো পুনরুদ্বারে জেলা প্রশাসন এখন পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
চৌমুহনী বাজারের হার্ডওয়্যার ব্যবসায়ী সুবীর নন্দী ঢাকা মেইলকে বলেন, চার যুগ ধরে এ বাজারে ব্যবসা করে আসছি। আগে খালগুলোতে নৌকায় করে মালামাল আসতো। বড় বড় ডিঙ্গি ভর্তি করে চট্টগ্রাম থেকে মালামাল আনতাম। এখন নৌকা চলা তো দূরের কথা, বাজারে আগুন লাগলেও খালে পানি পাওয়া যায় না। গত রমজানে চৌমুহনীতে অগ্নিকাণ্ডের সময় খালে পানি না থাকায় আগুন নেভাতে প্রায় পুরো ১ দিন লেগেছে।

একই বাজারের চালের আড়ৎদার শ্রীকৃষ্ণ পাল ঢাকা মেইলকে বলেন, ছোটবেলায় যখন বাবার সঙ্গে দোকানে বসতাম, তখন দেখতাম বাবা ডিঙ্গি নৌকায় ভরে অন্য জায়গায় পাঠাতেন। এখন সেসব স্বপ্ন। কালের বিবর্তনে এখন যদিও আগের মতো নৌযান চলাচল সম্ভব না। তবুও অন্তত খালগুলো দখলমুক্ত থাকলে কিছু এলাকা অন্তত বর্ষাকালে জলাশয়মুক্ত থাকবে।

chowmuhani

চৌমুহনী করিমপুর এলাকায় বাসিন্দা জোনায়েদ মিয়া ঢাকা মেইলকে জানান, খালগুলো অবৈধভাবে দখল হয়ে এখন সেখানে বড় বড় অট্টালিকা উঠেছে। প্রশাসন দেখেও না দেখার মতো থাকছে। চৌমুহনী বাজারের পুকুরগুলোও সব বেদখল হয়ে গেছে। বাজারে আগুন লাগলেও পানি পাওয়া যায় না। এখনই যদি খালগুলো দখলমুক্ত না করা হয় তবে ভবিষ্যতে খালগুলোর কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না।
দখল হওয়া খালগুলোকে দ্রুততার সাথে পুনরুদ্ধার না করা গেলে অদূর ভবিষ্যতে অগ্নিকাÐসহ যেকোনো দুর্যোগে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে এবং তার জন্য সংশ্লিষই দায়ী থাকবেন বলে মনে করেন সমাজকর্মী মুনিম ফয়সাল। ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, আমরা চাই খালগুলো দখলমুক্ত হোক, খালগুলোতে আবার নৌযান চলাচল করুক।

১৯৬৩ সালে চৌমুহনীতে বেসরকারি উদ্যোগে দেশের বৃহৎ পাটকল ডেল্টা জুট মিল চালু হবার পর চৌমুহনী বাজারের গুরুত্ব রাতাারতি বৃদ্ধি পায়। সে সময় চৌমুহনী থেকে নৌপথে পাটজাত পণ্য দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ হতো। নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও ফেনী থেকে বিপুল পাট নৌপথে ডেল্টা জুটি মিলে সরবরাহ হয়।

খাল ভরাট ও অবাধে দখল হয়ে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে চৌমুহনী পৌরসভার মেয়র খালেদ সাইফুল্যাহ ঢাকা মেইলকে বলেন, চৌমুহনী পৌর এলাকার খালগুলো খননের ব্যাপারে পৌরসভার সঙ্গে কোনো সমন্বয় করা হয় না। খালগুলো বিভিন্ন জবরদখলকারীদের দখলে রয়েছে।

তিনি অভিযোগ করে বলেন, খালের পাড়গুলো বিভিন্ন দোকানপাট বাসাবাড়ি করা হলেও জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। তিনি পৌরসভা এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল পরিস্কারসহ অবৈধভাবে গড়ে ওঠা স্থাপনা উচ্ছেদের দাবি জানান।

নোয়াখালী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মুন্সী আমির ফয়সাল ঢাকা মেইলকে বলেন, নোয়াখালী জেলার জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ডেলিগেটেড পদ্ধতিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে। ২০১৯-২০ অর্থ বছরে প্রায় দুই কোটি টাকা ব্যয়ে চৌমুহনী-ছাতারপাইয়া খালের ১৩ কিলোমিটার খাল পুনঃখনন করা হয়। এছাড়া এক কোটি টাকা ব্যয়ে তুলাতলী খালের তিন কিলোমিটার খাল খনন করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে নোয়াখালী জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, খালগুলোর কিছু জেলা প্রশাসন ও কিছু অংশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতাধীন। প্রশাসন অবৈধ দখলদারদের থেকে সরকারি পুকুর-খাল দখলমুক্ত করতে বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে আসছে।

চৌমুহনী খালে কেউ অবৈধভাবে দখলে থাকলে সেটা উচ্ছেদের ব্যবস্থা করা হবে বলেও জানান তিনি।

প্রতিনিধি/এইচই