জেলা প্রতিনিধি
২৩ আগস্ট ২০২২, ১২:১৯ পিএম
বাংলাদেশের অন্য যেকোনো জেলার ইতিহাসের চেয়ে রাজশাহীর ইতিহাস একটু বেশিই আকর্ষণীয়। সেই মহাকাল গড় রাজ্য, দেওরাজের শাসন-শোষণ, কালো জাদুর চর্চা, নরবলি— এককথায় একটা জনপদ নির্যাতন ও শোষণের চরম পর্যায়ে চলে যাওয়া বলতে যা বোঝায়, তার সবটুকুই ছিল সেই সময়ের রাজশাহীতে।
পীর সাধকের পুণ্যভূমি হিসেবে খ্যাত রাজশাহী নগরী। এ অঞ্চলে কুসংস্কার আর অপপ্রথার নিবিড় অন্ধকারের অতল গহ্বরে ডুবে থেকে নানা অপকর্ম, দেব-দেবীর নামে নরবলি, মানুষে মানুষে প্রকট ভেদাভেদ যখন ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। তখনই সূদুর মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে ঘটতে থাকে পীর সাধকের আগমন।
অবোধ মানুষের মাঝে জ্ঞানের শিখা ছড়ানোর মহৎ উদ্দেশ্যে ও বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ের প্রতিজ্ঞায় ও মনুষ্য সম্প্রদায়ের কল্যাণে জীবনের সব সময়টুকু বিলিয়ে দেন তারা। পথ পরিক্রমায় ডিঙ্গাতে হয় নানা প্রতিকূলতার দেয়াল। এমনকি প্রাণ বিসর্জনও দিতে হয় অনেককে। এদেরই একজন পদ্মা পাড়ে চিরশায়িত হযরত শাহ্ মখদুম রূপোশ (রহ)।
কথিত আছে, কৃষিকাজ ও মাছ উৎপাদন তৎকালীন অর্থনীতির মূলভিত্তি হওয়ায় জেলে আর কৃষকদের কব্জা করায় মূল লক্ষ্য ছিল শাসকদের। তাদের হাতের মধ্যে রাখতে অনুসরণ করতো নানা অপকৌশল। অংশুদেব চান্দভণ্ডী বর্মভোজ ও অংশুদেব খের্জুর চান্দ নামক দুই ভাই ছিলেন তৎকালীন রামপুর বা মহাকালগড় রাজ্যের শাসক।

অসংখ্য দেব-দেবীর নামে উপাসনা, নরবলি চড়ানো আর নানা কুসংস্কারে আচ্ছন্ন এ রাজ্য পরিচিত ছিল দেওরাজ্য হিসেবে। আর দেওরাজ্যের রাজাদের বলা হতো দেওরাজ। দেওরাজ নিয়ম করে প্রতি বছর পূজার সময়ে একজন মানুষকে দেবতার উদ্দেশ্যে বলি দিতো। সেই পূজা কোন সময় হবে বা কী ধরনের বলি দেওয়া হবে সেটা নির্ধারন হতো গণনার মাধ্যমে।
ধর্মের নামে অধর্মের আঁখড়া হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল দেওরাজ্য। সে সময়কার অশিক্ষিত যুক্তিহীন প্রজারাও এসব বর্বর সিদ্ধান্ত মেনে নিতো নির্দ্বিধায়। প্রতিটি পূজার ঘোষণা কানে যেতেই শিউরে উঠতো প্রতিটি প্রজার অন্তরাত্মা। ঢেঁড়া পিটিয়ে শুরু হতো বলির উপযুক্ত নরের অন্বেষণ। নর মনোনীত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাঁপ ছেড়ে বাঁচতো সবাই। আপদ বিদায় হলো, আরও কিছুদিন সবাই মিলে নিরাপদে থাকা যাবে এই ভাবনায়। তবে কান্নার রোল উঠতো নর মনোনীত হওয়া পরিবারে।
রাজশাহী নগরীর দরগাপাড়া সংলগ্ন পদ্মার কোল ঘেঁষে নির্মিত হযরত শাহ মখদুম রূপোশ (রহ) এর মাজারে সরেজমিনে দেখা যায়, মাজারের মূল প্রবেশদ্বার দিয়ে ঢুকে উত্তর-পশ্চিম কর্ণারে তাকালেই চোখে পড়ে নরবলি দেওয়ার জায়গাটি। এখনও চারদিকের নিচের অংশে ইট-সিমেন্ট আর টাইলসে বাঁধাই করে সংরক্ষণ করা মূল জায়গাটি। আর ওপরের দিকে লোহার গ্রীল দিয়ে ঘেরা।
পুরো জায়গাটি টিনের ছাউনি দিয়ে বেষ্টনী দেওয়া। পরিচিতি হিসেবে আবদ্ধ জায়গার এক পাশের নাম ফলকে লেখা, ‘মহান সূফী সাধক হযরত শাহ মখদুম রূপোশ (রহ.) এর যুদ্ধ জয়ের পূর্বে তান্ত্রিক দেওরাজ কর্তৃক নরবলির ব্যবহৃত পাথরের যূপকাষ্ঠ ও লালাযুক্ত রক্তপাত্র’।

এই যূপকাষ্ঠ প্রসঙ্গে জানতে মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংগ্রাহক ও সাংবাদিক ওলিউর রহমান বাবুর সঙ্গে কথা হয় ঢাকা মেইলের। তিনি বলেন, ‘একসময় এই এলাকা মহাকালের গড় হিসেবে পরিচিত ছিল। দীর্ঘদিন এই এলাকায় হিন্দু রাজাদের অবস্থান ছিল। এখান থেকেই তারা রাজ্য শাসন করতো।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখানে যে দেওরাজা ছিল সে প্রচুর মানুষকে ধরে এনে এখানে নরবলি দিতো। সেই চিহ্ন এখনও রয়ে গেছে। পরে তুরকান শাহ এসে সেই রাজাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। তার মাজারও এখানেই রয়েছে।’
‘পরবর্তীতে শাহ মখদুম রূপোশ (রহ.) এসে ইসলাম প্রচার করেন। যারা দেওরাজের পক্ষে ছিলেন তারাও ধীরে ধীরে মনোভাব পরিবর্তন করেন। শাহ মখদুম ছিলেন সবার কাছে প্রিয় মানুষ। তিনি শুধু ইসলাম প্রচারই করেননি, মানুষের শিক্ষা-দীক্ষা, সামাজিক কাজকর্মেও তিনি অনেক অবদান রেখেছেন। সেই কারণে শুধু মুসলমানরা না বিভিন্ন ধর্মের মানুষ এসে তার কাছে দোয়া নেয়।’
দেওরাজা প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, বড়দের কাছ থেকে বা বিভিন্ন তথ্য শুনেছি, ‘যে দেওরাজা ছিল সে নিজের ক্ষমতা বজায় রাখার জন্য মানুষজনকে ধরে এনে এখানে নরবলি দিতো। এই এলাকাটি ছিল জঙ্গল। এখানে মূর্তিপূজা ছাড়াও তারা বিভিন্ন ধরনের অনাচারের সঙ্গে লিপ্ত ছিল।’

এছাড়াও শাহ মখদুম রূপোশ (রহ.) এর মাজারের খাদেম আব্দুল মতিনের সঙ্গেও কথা হয় ঢাকা মেইলের। তিনি বলেন, ‘হযরত শাহ মখদুম রূপোশ (রহ.) এর আগমনের পূর্বে রাজা দেওরাজ অত্যাচারী রাজা ছিলেন। তার অত্যাচারের কিছু অংশ হচ্ছে, ছোট নর বাচ্চাদের বলি দিয়ে পূজা করতেন। বর্তমানে পাঠা বলি দিয়ে হিন্দুরা যেমন পূজা করে তেমনিভাবে ওই সময় তিনি মানুষ বলি দিয়ে পূজা করতেন।’
কথিত আছে— হযরত শাহ মখদুম রূপোশ (রহ.) আসার আগ মুহূর্তে এক নাপিতের প্রথম সন্তানকে বলি দেওয়ার পরে দ্বিতীয় সন্তানকেও বলি দেওয়ার জন্য নির্ধারণ করা হয়। তখন সেই নাপিত তার সন্তান দেওরাজকে না দিয়ে পদ্মা নদীতে বিসর্জন দেওয়ার সময় হযরত শাহ মখদুম রূপোশ (রহ.) এর সঙ্গে দেখা হয়। তিনি নাপিতকে বলেন, ‘হে আল্লাহর বান্দা! যিনি প্রাণ দিয়েছেন, তিনিই প্রাণনাশের মালিক। তুমি প্রাণনাশের মালিক না।’
আগন্তুকের (শাহ মখদুম) কথা শুনে অবাক হয়ে তার কথা মতো নাপিত সন্তানকে রাজদরবারে নিয়ে যায়। সেখানে জল্লাদ বলি দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েছে আর বলা হয়েছে, ‘হে আল্লাহর বান্দা! যিনি প্রাণ দিয়েছেন, তিনিই প্রাণনাশের মালিক। তুমি প্রাণনাশের মালিক না।’ জল্লাদের খর্গ ওভাবেই থেকে গেছে। উপস্থিত সকলে কালিমা পড়ে মুসলমান হয়ে গেছেন।
তিনি আরও বলেন, ‘এ ঘটনা শোনার পরে রাজা দেওরাজের সঙ্গে হযরত শাহ মখদুম রূপোশ (রহ.) পরপর তিনবার যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে দেওরাজ পরাজিত হয়। আর এভাবেই হযরত শাহ মখদুম রূপোশ (রহ.) এর দ্বীন প্রচার শুরু হয়।’
প্রতিনিধি/এইউ