images

সারাদেশ

আঁচাফারাম আখের জন্য বিখ্যাত রাণীনগরের শতবর্ষী ত্রিমোহনী হাট

জেলা প্রতিনিধি

১০ আগস্ট ২০২২, ০৫:০৮ পিএম

ছোট-বড় বিভিন্ন সাইজের আখ বিশেষ উপায়ে আঁটি বেঁধে হাটে নিয়ে এসেছেন চাষিরা। যেগুলোর আকার অনুযায়ী প্রতি পিস ১০ থেকে ২৫ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। খুচরা ও পাইকারি দুইভাবেই বিক্রি হচ্ছে এসব আখ। ক্রেতারা চাহিদা ও পছন্দমতো আখ ক্রয় করে কেউ নসিমনে, কেউ ভ্যানে, কেউ বা পিকআপে করে নিয়ে যাচ্ছেন।

এমন দৃশ্য নওগাঁর রাণীনগর উপজেলার ত্রিমোহনী আখের হাটের। প্রায় ১০২ বছরের এই হাটে জমে উঠেছে আখ বেচা-কেনা। জেলায় আখের সবচেয়ে বড় হাট হিসেবে পরিচিত এটি। প্রতিদিনই হাটটি থেকে দেশী জাতের আখ কিনে রাণীনগর ও তার আশেপাশের অঞ্চলগুলোতে বিক্রি করছেন খুচরা ও পাইকারী ব্যবসায়ীরা।

কথা বলে জানা গেছে, রাণীনগর উপজেলায় উৎপাদিত দেশী জাতের (আঁচাফারাম জাত) আখের চাহিদা অনেক বেশি। কারণ এই জাতের আখ শুধুমাত্র রাণীনগর ও তার আশে-পাশের কিছু এলাকাতেই চাষ হয়ে থাকে। অন্যান্য আখের চেয়ে বেশি মিষ্টি এই জাতের আখ। বিভিন্ন স্থানে ফেরি করেও বিক্রি হচ্ছে এসব আখ। ভ্রাম্যমাণ ভ্যান গাড়িতে মেশিনের মাধ্যমে বের করা আখের রসের চাহিদা তো রয়েছেই। মেশিন দিয়ে বের করা প্রতি গ্লাস আখের রস ১০ টাকা করে বিক্রি করা হয়ে থাকে।
akh naogonউপজেলার বাহাদুরপুর, চকমনু, চকাদিন, ত্রিমোহনীসহ বেশ কিছু গ্রাম একসময় আখ চাষের গ্রাম হিসেবে পরিচিত ছিল। বর্তমানে এই গ্রামগুলোতে হাতে গোনা কয়েকজন চাষি আখের আবাদ ধরে রেখেছেন। তবে আখের জমিতে বিকল্প আবাদ হিসেবে অধিক লাভজনক ফসলের বাগান তৈরি করা, আখের জমিতে লাভজনক ভুট্টার আবাদের পরিমাণ বেশি হওয়াসহ বিভিন্ন কারণে উপজেলায় আখের চাষ কমছে। এছাড়া আখ চাষে খরচ বেশি হওয়ায় বাজারে বেশি দামে আখ বিক্রি করার কারণে ক্রেতার সংখ্যাও কমে যাচ্ছে। যার কারণে আখের চাষও কমে যাচ্ছে। 

রাণীনগর উপজেলার চকমুনু গ্রামের আখ চাষি রবিউল ইসলাম বলেন, এবার আখের ফলন ভালো হয়েছে। আমি ৩ বিঘা জমিতে আখের চাষ করেছি। আমি ইতিমধ্যেই ৪০ হাজার টাকার আখ বিক্রি করেছি ত্রিমোহনী হাটে। ক্ষেতের সব আখ বিক্রি করে আরও অন্তত ৪০ হাজার টাকা পাওয়া যাবে। তবে গত বছর আখে পোকার আক্রমণ বেশি হওয়ার কারণে আমরা কিছুটা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিলাম।
akh naogonউপজেলার চুনাগাড়ি গ্রামের আখ চাষি সামাদ আলী বলেন, আমরা ক্ষেত থেকে আখ তুলে উপজেলার ত্রিমোহনী আখের বাজারে আনি। খুচরা ও ব্যবসায়ীরা আকার অনুযায়ী দাম দিয়ে আখ কিনে নিয়ে যায়। জয়পুরহাট, বগুড়া, নীনফামারীসহ বেশ কয়েকটি জেলা থেকে পাইকারী ব্যবসায়ীরা এই হাটে আখ কিনতে আসেন।

বেতগাড়ী গ্রামের আখ চাষি মুঞ্জুর হোসেন বলেন, ক্ষেতে উৎপাদিত আখ ছোট-বড় আখগুলো বিভিন্ন উপায়ে আঁটি বেঁধে হাটে নিয়ে নিয়ে আসি আমরা। আখের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নির্ধারিত হয় দাম। আখের আকার অনুযায়ী ১০ টাকা থেকে শুরু করে ২৫ টাকা পর্যন্ত দাম আসে প্রতি পিস আখের। এই হাটে পাইকারি ও খুচরা বিক্রি হয় আখ। 

‘২৫টি আখ একত্রিত করে একটি আঁটি বানানো হয়। ক্রেতারা চাহিদা ও পছন্দমতো আখ কেনেন।’

মুঞ্জুর হোসেন আরও বলেন, ‘কৃষি অফিস থেকে যদি আখ চাষে আরও সহযোগিতা পাওয়া যেত, তাহলে আখ চাষ কমতো না। এটি অত্যন্ত লাভজনক আবাদ। আখের সবকিছুই ব্যবহারযোগ্য।
akh naogonজয়পুরহাট থেকে আখ কিনতে আসা পাইকারি ব্যবসায়ী দিদারুল দেওয়ান বলেন, গত প্রায় ৫ বছর ধরে ত্রিমোহনী হাট থেকে আখ কিনে নিয়ে যাই। এরপর রাজধানী ঢাকাসহ কয়েকটি স্থানে আখগুলো বিক্রি করে থাকি। ভালো মান ও দামের কারণেই এখানে আসা।

কালাম হোসেন নামের আরেক ব্যবসায়ী বলেন, আমি প্রতি বছরই ত্রিমোহনী হাট থেকে আখ কিনে নিয়ে বিভিন্ন জেলায় বিক্রি করে থাকি। রাণীনগর উপজেলায় উৎপাদিত আখ অনেক মিষ্টি। আর আখগুলোর আকারও অনেক মানসম্মত। এগুলো চাষিদের কাছ থেকে কিনে পিকআপে করে নিয়ে যাই। চাষিদের চাহিদা অনুযায়ী দাম সমন্বয় করেই আখ কিনে থাকি। প্রায় ৭ বছর যাবৎ এই হাট থেকে আখ কিনছি।

স্থানীয় কাশিমপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মকলেছুর রহমান (বাবু) বলেন, ত্রিমোহনী হাট একটি ঐতিহ্যবাহী হাট। ১৯২০ সালে এই হাট যাত্রা শুরু করে। এই হাটে গবাদীপুশুসহ নিত্যপণ্য কেনাবেচা করা হয়। এছাড়া আখের মৌসুমে চাষিরা জমি থেকে আখ নিয়ে এসে এখানে খুচরা ও পাইকারি বিক্রি করে থাকেন। আশপাশের অনেক এলাকা থেকে ক্রেতারা এখানে আসেন তাদের পছন্দের পণ্যগুলো ক্রয় করতে।
akhরাণীনগর উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে উপজেলায় ১০ হেক্টর জমিতে আখের চাষ করা হয়েছে। 

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ শহীদুল ইসলাম বলেন, আখ চাষ পুরোটাই লাভজনক। আখের পাতা গবাদিপশুর জন্য স্বাস্থ্যসম্মত এবং উন্নত মানের খাদ্য, আখের ছাল শুকানোর পর জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করা যায়, আখ চাষে সীমিত পরিমাণ সার ও কীটনাশক প্রয়োগ করতে হয়, জমিতে আখ চাষ করলে সেই জমির উর্বরতা শক্তিও বৃদ্ধি পায়। এক কথায় আখ চাষ অত্যন্ত লাভজনক একটি ফসল। কিন্তু বিগত কয়েক বছর আখে পোকার আক্রমণ বেশি হওয়ায় ও কাঙ্খিত দাম না পাওয়ায় আখের চাষ চলতি মৌসুমে কিছুটা কমেছে। তবে আখ চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে কৃষি অফিসের কর্মকাণ্ড অব্যাহত রয়েছে। 

তিনি আরও বলেন, চলতি বছর আবহাওয়া আখ চাষের অনুকূলে থাকায়, দক্ষতা, পরিচর্যা, সঠিকভাবে সার ও কীটনাশক প্রয়োগের কারণে উপজেলায় আখের ফলন ভালো হয়েছে। কৃষকরা বাজারে আখের দাম ভালো পাচ্ছেন। আগামীবছর উপজেলায় আখের চাষ আরও বৃদ্ধি পাবে বলে আমি আমি আশাবাদী।

প্রতিনিধি/এএ