জেলা প্রতিনিধি
১৮ জুলাই ২০২২, ০৮:২৩ এএম
ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পেরেক মারার খট খট শব্দ। কোথাও বা কাঠ কাটা বা চেরাই নিয়ে ব্যস্ততা। কেউ কেউ কাঠের তলা বিছানো নিয়ে ব্যস্ত। সকাল থেকেই এমন কাজ নিয়ে মগ্ন থাকেন চর গোবিন্দপুর এলাকার নৌকার তৈরির কারিগররা। খোলা মাঠের একটি বড় অংশ জুড়ে দিনভর আপন মনে কাজ করে চলেন এই কারিগররা। আর তাদের তৈরি নৌকাগুলো দূর দূরান্ত থেকে ক্রেতারা এসে কিনে নেন।
নদীবেষ্টিত মাদারীপুরে বর্ষা মৌসুমের অধিকাংশ সময় বিলের পর বিল পানিতে তলিয়ে থাকে। তাই আদিকাল থেকে এই জেলার মানুষের চলাচলের প্রধান বাহন ছিল নৌকা। তাই অনেক আগে থেকেই এই অঞ্চলের লোকেরা তৈরি করতেন নৌকা। এখানকার তৈরি নৌকার কদর ছিলও খুব। বরিশালসহ ফরিদপুরের লোকেরা নৌকা কেনার জন্য চলে আসতেন মাদারীপুরে। তাই আগাম বর্ষা মৌসুমকে সামনে রেখে মাদারীপুরের খোয়াজপুর ইউনিয়নের চর গোবিন্দপুর গ্রামে নৌকা তৈরিতে ব্যস্ত সময় পাড় করছেন নৌকা তৈরির কারিগরা।
সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মাদারীপুরের সদর উপজেলার খোয়াজপুর ইউনিয়নের চর গোবিন্দপুর এলাকায় নৌকা তৈরির কাজ করছেন কারিগররা। খোলা মাঠে নৌকা তৈরির কারিগররা আপন মনে কাজ করেন। চারটি কাঠের পাটাতনের ওপর কাঠ জোড়া দিয়ে পেরেক ও পাতামের সাহায্যে গড়ছেন নৌকা। কেউ কেউ কাঠ কেটে ও ছেচে জোড়া দিচ্ছেন, কেউবা নৌকার উপরে উঠে তলা ঠিক করছেন। নৌকা তৈরির কারিগরদের পাশাপাশি তাদের পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও সাহায্য করে নৌকা তৈরিতে। একটি নৌকা তৈরি শেষ হওয়ার পর আবার আরেকটি নৌকার তৈরির জন্য বিছানো হয় কাঠের তলা। এভাবেই ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেশুরু হয়ে যায় তাদের এ কর্মব্যস্ততা এবং শেষ হয় সূর্য ডোবার মধ্য দিয়ে।
নৌকা তৈরির কারিগররা জানায়, মাঝারি আকারের নৌকা তৈরিতে ১ দিন সময় লেগে যায় তাদের। আগে নৌকা তৈরির গাছ অল্প টাকায় পাওয়া যাওয়ায় কম টাকায় বিক্রি করতেন তারা। তবে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় তাদেরও বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।
সেখানে বসে কথা হয় নৌকার মিস্ত্রী ইয়াকুব মোল্লার (৪৫) সঙ্গে। তিনি জানান, প্রায় ২২ বছর ধরে তিনি নৌকা তৈরির কাজ করছেন। প্রতিদিন গড়ে ১টি করে ও প্রতি মৌসুমে তিনি ১০০টির অধিক নৌকা তৈরি করে থাকেন। আকার ও কাঠ ভেদে এক একটি নৌকা ৮ হাজার থেকে ১২ হাজার টাকায় বিক্রি করেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘এ অঞ্চলে নৌকার অনেক চাহিদা। যারা ধান ও পাট করেন তাদের নৌকা ছাড়া চলেই না। আমি বর্ষা মৌসুম এলে নৌকা বানাই আর অন্য মৌসুমে অন্য কাজ করি। বেশ ভালো বেচাবিক্রি হয় এখানকার নৌকা।’
মো. বাদল হোসেন নামে নৌকা তৈরির কারিগর বলেন, ‘এখানে আমরা রেন্ডি, জিলাপি, জারুল, মেহগনী কাঠের নৌকা তৈরি করি। পানি বেশি হলে নৌকা বেশি চলে, আর পানি কমে গেলে তখন কম চলে। এক একটা নৌকায় কমপক্ষে ২ হাজার টাকা লাভ হয় আমাদের। তবে দিন দিন কাঠ ও পেরেকের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমাদের লাভ এখন কম হয়।’
স্থানীয় বাসিন্দা গিয়াসউদ্দিন জানান, অনেক আগে থেকেই এখানে নৌকা তৈরি হয়। এবছর এখানে ৫টা থল বসছে। প্রতিটা থলে ১৫ থেকে ২০ নৌকা তৈরি করে রাখা হয়েছে। ওরা বানিয়ে রাখে আর দূর দূরান্তর যেমন বরিশাল, ফরিদপুর, চাঁদপুর থেকে ক্রেতা এসে নৌকা কিনে নিয়ে যায়।
নৌকা কিনতে আসা সলেমান শিকদার বলেন, ‘এখন নৌকার দাম অতিরিক্ত বেশি। ৮ হাজার টাকার নিচে নৌকা নাই। নৌকা ছাড়া আমাদের চলে না, পাট, মেস্তা জাগ দিতে হয়, আবার জাগ উঠাতে হয়। গরুর জন্য ঘাস কাটার জন্য খুব দরকার নৌকার। আমি মাঝারি সাইজের একটা নৌকার ৭ হাজার বলছি কিন্তু নিতে হলে ৮ হাজার টাকা দিতে হবে।’
খোয়াজপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন মোল্যা জানান, বর্ষা মৌসুম আসলে আমাদের এখানে মঠেরবাজার, চর গোবিন্দপুরসহ বেশ কয়েকটি জায়গায় নৌকা তৈরি করে নৌকার কারিগররা। এখানকার নিচু অঞ্চলগুলোতে নৌকার খুব চাহিদা আছে। নৌকা তৈরির কারিগরদের কোনো প্রকার সাহায্যের দরকার হলে আমরা তাদের পাশে থাকবো।
টিবি