জেলা প্রতিনিধি
২৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:৩১ পিএম
লালমনিরহাটে থানা পুলিশ ও গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পৃথক দুই দফা তল্লাশির পরে ছেড়ে দেওয়া কুরিয়ার সার্ভিসের কাভার্ড ভ্যান থেকে বিপুল পরিমাণ ভারতীয় পণ্য জব্দ করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। কিন্তু, পুলিশের তল্লাশির পর বিজিবি কাভার্ড ভ্যানটি জব্দ করার আগেই কসমেটিকস পণ্যের দুটি কার্টন এবং দশ বস্তা জিরা ‘গায়েব’ হয়ে গেছে বলে অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। তল্লাশির পরেও কাভার্ড ভ্যানটি ছেড়ে দেওয়ার বিষয়টি খতিয়ে দেখতে জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহাদাত হোসেনকে তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছেন পুলিশ সুপার আসাদুজ্জামান।
বুধবার (২৪ ডিসেম্বর) রাতে লালমনিরহাট শহরের স্টেশন রোডের সোহরাওয়ার্দী মাঠ এলাকা থেকে জব্দ করা এসব পণ্যের মধ্যে ভারতীয় জিরা ও চাদর আছে বলে প্রেস ব্রিফিংয়ে জানিয়েছে বিজিবি।
বৃহস্পতিবার (২৫ ডিসেম্বর) বিকেলে লালমনিরহাট ১৫ বিজিবির পক্ষ থেকে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে বুধবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে এজেআর কুরিয়ার সার্ভিসের একটি কাভার্ড ভ্যান আটক করা হয়। তল্লাশি চালিয়ে গাড়িটি থেকে ৯০টি বস্তা থেকে ২ হাজার ৫১১ কেজি ভারতীয় জিরা ও ১৮০টি চাদর উদ্ধার করা হয়। ভারত থেকে আনা এসব পণ্য চোরাকারবারের সঙ্গে জড়িতদের পরিচয় শনাক্তে তদন্ত চলছে। এ ঘটনায় আইনগত ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন বলেও জানিয়েছে বিজিবি।
![]()
এর আগে, মঙ্গলবার রাতে কুড়িগ্রাম থেকে আসা এজেআর কুরিয়ার সার্ভিসের ওই কাভার্ড ভ্যানটি রংপুর-কুড়িগ্রাম মহাসড়কের লালমনিরহাটের বড়বাড়ী এলাকায় আটক করে লালমনিরহাট সদর থানা পুলিশ।
এএসআই আক্তার হোসেনের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল গাড়িটি তল্লাশি করে। তবে, গাড়িটি থানায় না নিয়ে শহরের আলোরূপা মোড় এলাকায় রাখা হয়। এর পরদিন বুধবার রাত ৯টার দিকে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ডিবি পুলিশ অভিযান চালিয়ে গাড়িটি আবার আটক করে তল্লাশি চালায়। প্রায় দেড় ঘণ্টা তল্লাশির পর রাত সাড়ে ১০টার দিকে গাড়িটি ছেড়ে দেওয়া হয়।
এর কিছুক্ষণ পর শহরের স্টেশন রোড এলাকা থেকে বিজিবি গাড়িটি আটক করে এবং পরে সেখান থেকে ভারতীয় পণ্য উদ্ধার করে।
এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্রের দাবি, কাভার্ড ভ্যানটি প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা তৃতীয় একটি পক্ষের নিয়ন্ত্রণে ছিল। আবার অনেকেই কাভার্ড ভ্যানটিকে শহরের সোহরাওয়ার্দী মাঠে দীর্ঘ সময় ধরে পড়ে থাকতে দেখেছেন। তবে কারা এর সঙ্গে জড়িত সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করে কিছু জানা যায়নি।
![]()
কুড়িগ্রামের একাধিক ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওই গাড়িতে প্রায় তিন হাজার কেজি ভারতীয় জিরা ও চাদরের পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ ভারতীয় কসমেটিকস সামগ্রী ছিল। তবে বিজিবির তল্লাশিতে ২ হাজার ৫ শত ১১ কেজি শুধু জিরা এবং শাল চাদরই উদ্ধার হয়েছে।
কুড়িগ্রামের জিয়া বাজারের কসমেটিকস ব্যবসায়ী মারুফ এন্টারপ্রাইজ এর স্বত্বাধিকারী মারুফ হোসেন বলেন, ওই গাড়িতে আমার প্রায় এক লাখ টাকার কসমেটিকস সামগ্রীর দুটি কার্টন ছিল। যে পণ্যগুলো ঢাকায় ফেরত পাঠাতে চেয়েছিলাম। আমার মতো আরও কয়েকজন ব্যবসায়ীর পণ্য ছিল। গাড়িটি আটক হওয়ার পর আমি পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি। কেন আমার মতো ছোট ব্যবসায়ীকে হয়রানি করা হচ্ছে তা বোধগম্য নয়।
একই বাজারের মশলা ব্যবসায়ী মদিনা এন্টারপ্রাইজের প্রতিনিধি তানভির হোসেন বলেন, আটক গাড়িতে আমার তিন টন (তিন হাজার কেজি) ভারতীয় জিরা ছিল। এগুলো আমরা বিভিন্নভাবে কিনে বৈধভাবে ঢাকায় পাঠাচ্ছিলাম। তবে কাগজপত্র থাকার পরেও কেন আপনারা পণ্যগুলো নিজেদের দাবি করে ফেরত চাইছেন না- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, শুক্রবারসহ বন্ধের দিন হওয়ায় আমরা বিজিবির সঙ্গে যোগাযোগ করিনি। সময় হলেই যোগাযোগ করব।
![]()
এ বিষয়ে লালমনিরহাট ১৫ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল মেহেদী ইমাম বলেন, আমরা কাভার্ড ভ্যানটি আটকের পর তল্লাশির সময় কোনো কসমেটিকসের পণ্য পাইনি। তবে কিছু ওষুধের কার্টন ছিল, যেগুলো সংশ্লিষ্টদের সামনে খুলে তল্লাশির পর আবার প্যাক করা হয়েছে। কিন্তু কুরিয়ার সার্ভিসের চালানে একশত বস্তা জিরার উল্লেখ থাকলেও আমরা ৯০ বস্তা পেয়ে সেটাই জব্দ করেছি এবং ভারতীয় চাদরগুলো জব্দ করেছি। আর পণ্যগুলোর মালিকদের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখাতে ২৪ ঘণ্টা সময় দেওয়া হলেও তারা এখনও যোগাযোগ করেনি। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, তাদের বৈধ কাগজপত্র থাকলে এতক্ষণে তারা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন।
এ বিষয়ে এজেআর কুরিয়ার সার্ভিসের কুড়িগ্রাম জেলা শাখার ম্যানেজার উজ্জ্বলের সাথে যোগাযোগ করলেও তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে লালমনিরহাট জেলা শাখার ম্যানেজার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আমাদের গাড়ি পুলিশ তল্লাশি করে ছেড়ে দিলেও পরে বিজিবি আটক করেছে। গাড়ি থেকে ভারতীয় পণ্য উদ্ধার করা হয়েছে। গাড়িটি ছাড়ানোর বিষয়ে আমরা বিজিবি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করছি।
লালমনিরহাট সদর থানার এএসআই আক্তার হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, গাড়িটি আটকের পর থানায় এনে তল্লাশি করেছি। তবে তল্লাশি করে কোনো অবৈধ পণ্য পাইনি। ওসি স্যারের নির্দেশে প্রায় তিন ঘণ্টা পর গাড়িটি ছেড়ে দেওয়া হয়। গাড়িতে ভারতীয় জিরা, শাল, চাদর কিংবা কসমেটিকস দেখিনি।
তবে লালমনিরহাট সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ আব্দুল মতিন বলেন, গাড়িটি থানায় আনা হয়নি। থানার বাইরে তল্লাশি করে অবৈধ কোনো পণ্য পাওয়া যায়নি— এমন তথ্য জানানো হলে গাড়িটি ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছি।
ডিবি পুলিশের ওসি সাদ আহমেদ বলেন, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গাড়িটি আটক করে তল্লাশি চালানো হয়। তবে তল্লাশিতে যেসব পণ্য ছিল সেসবের বিপরীতে বৈধ কাগজপত্র ছিল, কোনো অবৈধ পণ্য পাওয়া যায়নি। সে কারণেই গাড়িটি ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) মো. আসাদুজ্জামান বলেন, বিষয়টি জানার পর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) শাহাদাত হোসেনকে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কারও সংশ্লিষ্টতা বা গাফিলতির প্রমাণ পাওয়া গেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
প্রতিনিধি/এসএস