জেলা প্রতিনিধি
২২ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:৩৩ পিএম
পৌষ মাসের শুরুতেই উত্তরের জেলা ঠাকুরগাঁওয়ে জেঁকে বসেছে তীব্র শীত। ঘন কুয়াশা, হিমেল হাওয়া আর সূর্যের অনুপস্থিতিতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে স্বাভাবিক জনজীবন। টানা তিন দিন ধরে ভোর থেকে বেলা ১১টা–১২টা পর্যন্ত সূর্যের দেখা মিলছে না। ফলে শীতের তীব্রতায় সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছেন ছিন্নমূল মানুষ, খেটে খাওয়া শ্রমজীবী, শিক্ষার্থীসহ যানবাহন চালকেরা।
দেখা যায়, ভোরের ঠান্ডা বাতাস আর ঘন কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে ঠাকুরগাঁও শহরসহ আশপাশের গ্রামাঞ্চল। রাস্তাঘাটে নেমেছে নীরবতা, কুয়াশার কারণে যানবাহন চলছে ধীরগতিতে। হেডলাইট জ্বালিয়ে চলাচল করতে হচ্ছে। বাড়ছে দুর্ঘটনার ঝুঁকি।
আবহাওয়ার পরিস্থিতি অনুযায়ী, জেলায় দিনের তাপমাত্রা নেমে এসেছে প্রায় ১৪ থেকে ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে, আর রাতের তাপমাত্রা কমে দাঁড়াচ্ছে ১০ থেকে ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। সূর্যের দেখা না মেলায় শীতের অনুভূতি আরও তীব্র হয়ে উঠছে।
আরও পড়ুন
শীতের প্রকোপে সবচেয়ে বেশি কষ্টে পড়েছেন দিনমজুর, রিকশাচালক, ভ্যানচালক ও খেটে খাওয়া মানুষেরা। প্রয়োজনীয় গরম কাপড়ের অভাবে তারা কাজেও যেতে পারছেন না স্বাভাবিকভাবে। একই সঙ্গে কুয়াশা ও ঠান্ডার কারণে বিপাকে পড়েছেন স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থীরাও।
স্থানীয় শ্রমিক খয়রুল ইসলাম বলেন, ভোরে কাজের জন্য বের হতে খুব কষ্ট হয়। গরম কাপড় নেই, শরীর কাঁপে। কাজ না করলে খাবার জোটে না।
![]()
শীতের তীব্রতায় ছিন্নমূল ও অসহায় মানুষের কষ্ট আরও বেড়েছে। ফুটপাত, বাসস্ট্যান্ড ও খোলা জায়গায় থাকা মানুষেরা রাত পার করছেন চরম ঝুঁকিতে।
অটোচালক জামিনি রায় বলেন, কুয়াশায় স্পষ্ট দেখা যায় না। গাড়ি চালাতে হাত-পা অবশ হয়ে যাচ্ছে। আবার গাড়ি না চালালে সংসার চলে না। আগে দিনে যেখানে ৮০০–৯০০ টাকা ভাড়া মারতাম, এখন ঠান্ডার কারণে তেমন কেউ ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। তাই ভাড়াও কমে গেছে। এখন দিনে ৪০০–৫০০ টাকা আয় করা খুব কঠিন হয়ে পড়েছে।
মতিউর রহমানসহ অনেক ভুক্তভোগী দ্রুত সরকারি ও বেসরকারি শীতবস্ত্র সহায়তার দাবি জানিয়ে বলেন, এখন পর্যন্ত সরকার থেকে শীতের কোনো কিছু পাইনি। এই শীতে গরম কাপড় না পেলে টিকে থাকা খুব কঠিন। সরকার যদি শীতবস্ত্র দিত, তাহলে আমাদের জন্য উপকার হতো।
ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজের এইচএসসি প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী নাজনীন ইসলাম নাদিয়া ঢাকা মেইলকে বলেন, ঠাকুরগাঁওয়ে প্রচণ্ড ঠান্ডা পড়ছে। ঘন কুয়াশায় সকালবেলা রাস্তাঘাট দেখা যায় না, ফলে দ্রুত গাড়িও পাওয়া যায় না। বর্তমানে কলেজ বন্ধ থাকলেও সকালে প্রাইভেটে যেতে সমস্যা হচ্ছে।
শীতের প্রভাব পড়েছে কৃষিক্ষেত্রেও। ভূট্টা ও আলুর খেতে ইতোমধ্যে বিভিন্ন রোগ দেখা দিয়েছে বলে জানিয়েছেন কৃষকেরা। শীত আরও বাড়লে বড় ধরনের ফসলহানির আশঙ্কা করছেন তারা।
সদর উপজেলার নারগুণ এলাকার কৃষক ধলা বর্মন জানান, আলুর খেতে পাতা কুঁকড়ে ও ঝলসে যাচ্ছে। এছাড়াও গড়া পচে যাচ্ছে। শীত আরও বাড়লে বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে।
![]()
একই এলাকার কৃষক সামাদ বলেন, ভূট্টা গাছের পাতা হলুদ হয়ে যাচ্ছে। আর বর্তমানে বিষের যা দাম, তাতে এক বিঘা জমিতে একবার স্প্রে দিতে ২ হাজার টাকাও কম হচ্ছে না।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মৌসুমে আলু আবাদ লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৮ হাজার হেক্টর, আবাদ হয়েছে ২৭ হাজার ৮১০ হেক্টর। ভূট্টা আবাদ লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৪৬ হাজার ৩৮০ হেক্টর এবং আবাদ হয়েছে ৪২ হাজার ৫৮০ হেক্টর। বোরো বীজতলা করা হয়েছে ২৮১ হেক্টর জমিতে এবং শীতকালীন সবজি চাষ হয়েছে প্রায় ৬ হাজার ৪৫০ হেক্টর জমিতে।
শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঠাকুরগাঁওয়ের হাসপাতালগুলোতে ঠান্ডাজনিত রোগীর সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। সর্দি, কাশি, নিউমোনিয়া ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে প্রতিদিনই হাসপাতালে আসছেন রোগীরা।
২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত আরএমও ডা. মো. রকিবুল আলম (চয়ন) ঢাকা মেইলকে বলেন, শিশু ও বয়স্কদের ক্ষেত্রে শীতজনিত রোগের ঝুঁকি বেশি। সবাইকে গরম কাপড় পরা, মাস্ক ব্যবহার এবং আগুন পোহানোর সময় সতর্ক থাকার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের পক্ষ থেকে শীতকালীন রোগবালাই মোকাবেলায় কৃষকদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে এবং মাঠপর্যায়ে তদারকি জোরদার করা হয়েছে জানিয়ে জেলা প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা কৃষিবিদ মোছাম্মাৎ শামীমা নাজনীন জানান, ফসলের ক্ষতি কমাতে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। কৃষকদের আতঙ্কিত না হয়ে পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানান তিনি।
![]()
পৌষের এই কনকনে শীতে ঠাকুরগাঁওয়ের জনজীবন যেন থমকে গেছে। ভোর থেকে কুয়াশার চাদরে ঢাকা শহর, ঠান্ডায় কাঁপছে মানুষ ও প্রকৃতি। সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন ছিন্নমূল ও খেটে খাওয়া মানুষ, শিশু ও বয়স্করা। একই সঙ্গে দুশ্চিন্তায় কৃষক ও স্বাস্থ্যকর্মীরাও। এমন পরিস্থিতিতে শীতার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো, শীতবস্ত্র সহায়তা বাড়ানো এবং সচেতনতা জোরদার করাই এই সময়ের সবচেয়ে বড় মানবিক দায়িত্ব।
প্রতিনিধি/এসএস