বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক
২২ ডিসেম্বর ২০২৫, ০১:০০ পিএম
সারি সারি আলমারিতে সাজানো নমুনা সাক্ষ্য দিচ্ছে রহস্যময় পৃথিবীর প্রাণী বৈচিত্র্যের। দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন জাদুঘরের দেখা মিললেও সেগুলো এত বড় পরিসরে নয়। ফলে গবেষণা কিংবা উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনে এ প্রাণী জাদুঘর শিক্ষার্থীদের জন্য খুবই সহায়ক। তবে সুবর্ণজয়ন্তী পার হলেও এমন প্রাণী জাদুঘরের কথা এখনো অনেকের অজানা।
বলছিলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা জাদুঘরের কথা। এখানে দেখা মিলবে দুর্লভ ফসিল, বনরুই, শজারু, উদবিড়াল, বিলুপ্ত হওয়া নানা প্রজাতির সাপ, মানবদেহের নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, পরিফেরা থেকে ম্যামালস প্রজাতির হাজার হাজার নমুনা। কোনোটি সংরক্ষিত আছে শুকনো অবস্থায় মমি করে, আবার কোনোটিকে ফরমালিনে ডুবিয়ে সংরক্ষণ করা হয়েছে। স্বচ্ছ কাচের বাক্স ও জারে সারিবদ্ধভাবে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে তাদের। জাদুঘরের দেয়ালে ফ্রেমে বাঁধা রয়েছে বিভাগের শিক্ষকের তোলা বিভিন্ন প্রজাতির পাখির ছবি।
![]()
রাবির স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু একাডেমিক ভবনের দ্বিতীয় তলায় প্রাণিবিদ্যা বিভাগের এক বিশাল কক্ষজুড়ে জাদুঘরটি। ১৯৭২ সালে প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রয়াত শিক্ষক মুস্তাফিজুর রহমানের উদ্যোগে জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠিত হয়। তার নামানুসারেই এটির নাম রাখা হয় ‘অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান মেমোরিয়াল মিউজিয়াম’।
প্রাণিবিদ্যা বিভাগের এ জাদুঘর শুক্র ও শনিবার ছাড়া বাকি পাঁচদিন সকাল ৮টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত খোলা থাকে। জাদুঘরটি দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত। কিন্তু সমৃদ্ধ এ জাদুঘরটি রয়ে গেছে লোকচক্ষুর অন্তরালে। জাদুঘরটি সম্পর্কে দেশের অনেক গবেষকই জানেন না। শুধু তা-ই নয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছেও এটি রয়েছে অজানাই।

এ জাদুঘরে একই সঙ্গে দেখা মিলবে নানা প্রজাতির বিলুপ্তপ্রায়সহ ১ হাজার ৫৪৩টি প্রাণীর প্রক্রিয়াজাত দেহ। এসব প্রাণীর পাশাপাশি ১৪২টি ফসিলও রয়েছে এ জাদুঘরে, যা বর্তমানে দুর্লভ। সরীসৃপ, পাখি, স্তন্যপায়ী প্রাণীর পাশাপাশি রয়েছে নানা জাতের সামুদ্রিক মাছ, বিরল প্রজাতির জীবন্ত ফসিল, পেট্রোমাইজন ও মেক্রিনসহ ১৯ প্রজাতির ৩৩টি কোরাল এবং ৪৫ ধরনের মলাস্কার সেল।
শুধু বন্য ও গৃহপালিত পশু নয়, দুটি মানবকঙ্কালও রয়েছে এখানে। একটি পুরুষের আর অপরটি নারীর। আরও আছে হাতি, ঘোড়া, কুমিরের কঙ্কাল, শুশুক ও ডলফিনের মমি। ছোট ছোট কীটপতঙ্গ থেকে শুরু করে শজারু, বনরুই, বিভিন্ন প্রজাতির বিড়াল, মাছরাঙা, মিঠাপানির মাছ, সামুদ্রিক মাছ, কোরাল (প্রবাল) এমনকি মানবভ্রূণও। মলাস্কা, পরিফেরা, নিডারিয়া, কর্ডাটা, আর্থ্রোপোডা, নেমাটোডাসহ প্রায় সব পর্বের বিচিত্র রকমের প্রাণীর সমাহার জাদুঘরটিতে। শুধু বাংলাদেশেরই নয়, দেশের বাইরে থেকেও নিয়ে আসা হয়েছে কিছু দুর্লভ প্রাণী। এছাড়া শুধু রাজশাহী নগর ও সংলগ্ন এলাকা থেকে এ পর্যন্ত ৯৬ প্রজাতির মাছ সংগ্রহ করা হয়েছে।

জাদুঘর হলেও কক্ষটির মাঝখানে টেবিল-চেয়ার ও রাসায়নিক পরীক্ষার সামগ্রীও রয়েছে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচটি বিভাগের ব্যবহারিক ও গবেষণার কাজ করা হয় এখানে।
মিউজিয়াম অ্যাটেনডেন্ট কেতাব বলেন, বর্তমানে জাদুঘরটিতে পাঁচ শতাধিক প্রজাতির প্রাণী সংরক্ষিত আছে, যা বাংলাদেশের অন্য কোনো প্রাণিবিদ্যা জাদুঘরে নেই। জাদুঘরটি এতটাই সমৃদ্ধ যে এটিকে বাংলাদেশে প্রাণিবিদ্যার ক্ষেত্রে অদ্বিতীয় জাদুঘর বলা হয়ে থাকে। দেখে জীবন্ত মনে হলেও এ প্রাণীগুলোকে মূলত রাসায়নিক দিয়ে রাখা হয়েছে। তবে বিচিত্র প্রজাতির প্রাণীর দেহ সংরক্ষণের জন্য মিলছে না পর্যাপ্ত ফরমালিন। এছাড়া প্রাণী সংরক্ষণের জন্য নেই কোনো দক্ষ ট্যাক্সিডার্মিস্ট এবং বিচিত্র প্রজাতির প্রাণীগুলো প্রদর্শনের জন্য পর্যাপ্ত জায়গাও নেই।
পাখি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করা প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. আমিনুজ্জামান মো. সালেহ্ রেজা বলেন, মিউজিয়ামটির সংগ্রহ অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও বিস্তৃত। এখানে বিপুলসংখ্যক বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ছাড়াও নানা ধরনের স্থলজ, জলজ ও সামুদ্রিক প্রাণী সংরক্ষণ করা হয়েছে। এমনকি বিলুপ্তপ্রায় কিছু জীবাশ্মও এ মিউজিয়ামে সংগ্রহে রয়েছে। সার্বিকভাবে এ মিউজিয়াম সংগ্রহের দিক থেকে দেশের অন্যতম সমৃদ্ধ মিউজিয়াম।

প্রাণীজগতের যে পর্ব পরিফেরা থেকে মলাস্কা, ফিশ ও ম্যামালস—সব পর্বের ব্যাপক সংগ্রহ এ জাদুঘরে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে বলে দাবি করেছেন প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. নজরুল ইসলাম। এছাড়া দেশের প্রাণী বিজ্ঞানীসহ বন্যপ্রাণী বিশারদরাও এ জাদুঘরটিকে সমৃদ্ধ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। শুধু শিক্ষার্থীরাই নয়, বহিরাগত দর্শনার্থীরাও অনুমতি সাপেক্ষে এটি পরিদর্শন করতে পারবেন।
অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম বলেন, আমাদের বিভাগের এ মিউজিয়ামের দেশব্যাপী খ্যাতি রয়েছে। সংগ্রহের দিক থেকে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় এখানকার মিউজিয়াম সবচেয়ে বড় ও সমৃদ্ধ। এখানে প্রয়োজনীয় সব সুযোগ-সুবিধা থাকায় শিক্ষার্থীরা মিউজিয়ামেই নিয়মিত ক্লাস করার পাশাপাশি গবেষণার কাজও করতে পারছেন। বিভিন্ন সময় দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও শিক্ষার্থীরা এ মিউজিয়াম দেখতে আসেন। মিউজিয়ামটির জায়গার সংকটে রয়েছে। তাছাড়া আরো সমৃদ্ধ ও আধুনিক করতে পর্যাপ্ত ফান্ড ও প্রকল্পের প্রয়োজন রয়েছে।
প্রতিনিধি/টিবি