জেলা প্রতিনিধি
১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০:৪০ এএম
অনেক ত্যাগ ও রক্তদানের পর স্বাধীনতা অর্জনের চূড়ান্ত মুহূর্তে ১৪ ডিসেম্বর হানাদার মুক্ত হয় যমুনাপাড়ের শহর সিরাজগঞ্জ। ডিসেম্বরের শুরু থেকেই অন্যান্য উপজেলাগুলো হানাদার মুক্ত হতে থাকে। ১৪ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জ মহকুমা শহর থেকে চূড়ান্তভাবে বিতাড়িত হয় হানাদার হানাদার বাহিনী। ১৯৭১ সালের ওই দিন প্রিয় শহরকে দখল মুক্ত করার পর উল্লাসে ফেটে পড়েন মুক্তিযোদ্ধা-জনতা। পতাকা হাতে হাজার হাজার মুক্তিকামী কৃষক-শ্রমিক-জনতা শহরে প্রবেশ করেন। পুরো শহর জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে।
মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৭১ সালের এপ্রিলের দিকে পাকবাহিনী সিরাজগঞ্জে প্রবেশ করে। তখন বিভিন্ন স্থানে প্রতিরোধ গড়ে তুললেও ব্যর্থ হন মুক্তিযোদ্ধারা। সিরাজগঞ্জ চলে যায় পাকসেনাদের দখলে। এরপর থেকে অনেক সম্মুখযুদ্ধ হয়। বড়ইতলী, বাগবাটি, ব্রহ্মগাছা, নওগা, বারুহাস, কৈগাড়ি ও ভদ্রঘাটসহ বিভিন্ন স্থানে সম্মুখযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বিপুলসংখ্যক পাকসেনা নিহত হয়। পরবর্তীতে সিরাজগঞ্জকে হানাদারমুক্ত করার জন্য ৯ ডিসেম্বর শহরের উত্তরে শৈলাবাড়ী পাকিস্তানি ক্যাম্পে হামলা করে মুক্তিযোদ্ধা। সেদিন তুমুল যুদ্ধে পাকবাহিনীর অস্ত্রের সঙ্গে টিকতে না পেরে পিছু হটেন মুক্তিযোদ্ধার। ওই যুদ্ধে সুলতান মাহমুদ শহীদ হন। ১০ ডিসেম্বর বিশ্রাম নেওয়ার পর ১১ ও ১২ ডিসেম্বর দফায় দফায় পাক বাহিনীর ক্যাম্পে হামলা চালায় মুক্তিযোদ্ধারা। এ যুদ্ধে অংশ নেয় আশপাশের এলাকার প্রায় হাজার খানেক মুক্তিযোদ্ধা। সংগঠিত হয়ে ১৩ ডিসেম্বর পাকসেনাদের ওপর তিনদিক থেকে আক্রমণ শুরু করে ঘিরে ফেলে তারা। এদিন রাত ৩টা পর্যন্ত যুদ্ধ হয়। স্থল ও নৌপথ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয় মুক্তিযোদ্ধারা। একমাত্র রেলপথ পাক হানাদারদের দখলে থাকে। অবশেষে মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা আক্রমণে টিকতে না পেরে তাদের নিশ্চিত পরাজয় জেনে সিরাজগঞ্জ ছেড়ে ট্রেনে ঈশ্বরদীর দিকে পালিয়ে যায় পাক হানাদাররা। এ যুদ্ধে শহীদ হন ইঞ্জিনিয়ার আহসান হাবিব, সুলতান মাহমুদসহ পাঁচজন। হানাদারদের পালিয়ে যাওয়ার খবর নিশ্চিত হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা জয় বাংলা ধ্বনি ও ফাঁকা গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজে এসে প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়ান। এ সময় মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে দেশ গঠনের শপথ নেন। এখানে আমীর হোসেন ভুলুকে মুক্তিবাহিনীর আঞ্চলিক অধিনায়ক ও ইসমাইল হোসেনকে প্রশাসনিক প্রধান হিসাবে ঘোষণা করা হয়।
![]()
মুক্তিযুদ্ধকালীন বেসরকারি সাব সেক্টর কমান্ড পলাশডাঙ্গা যুবশিবিরের প্রতিষ্ঠাতা বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যক্ষ আজিজ সরকার, বীর মুক্তিযোদ্ধা গাজী আবু তাহের খান, বীর মুক্তিযোদ্ধা গাজী হাসিনূর ইসলাম খান ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মির্জা ফারুক আহম্মেদ বলেন, ১৪ ডিসেম্বর সকালে মিত্র বাহিনীর প্লেন সিরাজগঞ্জ জেলার ওপর টহল দেয়। পরিত্যক্ত শত্রুশিবির লক্ষ্য করে প্লেন থেকে গুলি ছোড়া হয়। বেলা সাড়ে ১২টার দিকে মুক্তিযোদ্ধারা সিরাজগঞ্জ শহরে প্রবেশ করেন। ওয়াপদা অফিসে হানাদার বাহিনীর প্রধান ক্যাম্পও দখলে নেন মুক্তিযোদ্ধারা। শহরের বিএ কলেজ ক্যাম্পাসের শহীদ মিনারে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে দিয়ে ওড়ানো হয় বাংলাদেশের মানচিত্র অঙ্কিত জাতীয় পতাকা। মহকুমা প্রশাসকের কার্যালয়, কওমি জুটমিলসহ সব সরকারি-বেরসকারি প্রতিষ্ঠানে ওড়ানো হয় বাংলাদেশের পতাকা। মুক্ত সিরাজগঞ্জের মহকুমা প্রশাসকের দায়িত্ব দেওয়া হয় ইসমাইল হোসেনকে এবং সিরাজগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধের অধিনায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয় আমির হোসেন ভুলুকে।
![]()
সেদিন যারা মুক্তিযোদ্ধাদের এক কাতারে সংগঠিত করেছেন তাদের মধ্যে প্রয়াত আমির হোসেন ভুলু, শহীদ মহকুমা প্রশাসক শামসুদ্দিন, পলাশডাঙ্গা যুবশিবিরের পরিচালক প্রয়াত আব্দুল লতিফ মির্জা, গাজী সোহরাব আলী সরকার, আমিনুল ইসলাম চৌধুরী, প্রয়াত আবু মোহাম্মদ গোলাম কিবরিয়া, মরহুম লুৎফর রহমান অরুন, জহুরুল ইসলাম, গাজী শফিকুল ইসলাম শফি, আলাউদ্দিন শেখ, ইসহাক আলী, আব্দুল হাই তালুকদার, বিমল কুমার দাস অন্যতম।
মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সিরাজগঞ্জ জেলা ইউনিটের যুগ্ম-আহবায়ক গাজী মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, সিরাজগঞ্জ মুক্ত দিবস উপলক্ষে দিনটি স্মরণীয় করতে নানা কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। সকালে পতাকা উত্তোলন ও সকাল ১১টায় শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। এরপর একটি র্যালি শহর প্রদক্ষিণ করবে। একই সঙ্গে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।
প্রতিনিধি/টিবি