images

সারাদেশ

সিলেটে বন্যা আসে বন্যা যায়, প্রতিকার হয় কতটুকু?

জেলা প্রতিনিধি

২৬ জুন ২০২২, ০২:০০ পিএম

সিলেট অঞ্চল বর্তমানে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা অতিক্রম করছে। এই অঞ্চলে বন্যার এত ভয়ংকর রূপ আগে কখনও দেখেনি মানুষ। ভয়াবহতার দিক দিয়ে অতীতের সকল রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে এবারের বন্যা। পানিবন্দি করেছে লাখ লাখ মানুষকে, আর ঘরবাড়ি ছাড়া করে আশ্রয় কেন্দ্রে তুলেছে আরও কয়েক লাখ মানুষকে। এ বছরের বন্যায় মানুষের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অতীতের তুলনায় সর্বাধিক, জনদুর্ভোগের শেষ ছিল না।

সিলেটের বাসিন্দারা বলছেন, প্রায় দেড় যুগেও তারা এত ভয়াবহ বন্যার মুখোমুখি হননি। সিলেটে সর্বশেষ ২০০৪ সালে বড় বন্যা হয়েছিল, কিন্তু এ বছরের ভয়াবহতা অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি যা ছিল কল্পনার বাইরে। আর ২০০৪ সালের পরে যাদের জন্ম তাদের জন্য নতুন এক অভিজ্ঞতা। 

এ বছরের বন্যার ভয়াবহতা এমন তীব্র ছিল যে সিলেটের ৮০ ভাগ আর সুনামগঞ্জের ৯০ ভাগ জায়গার মানুষ ছিল পানিবন্দি। শুধু প্রশাসনিক হিসেবে এই দুই জেলায় প্রায় ৩০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর বাইরে তো বেহিসাব। বন্যার পানিতে তলিয়ে সুনামগঞ্জ শহর পুরো দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।

সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ফ্লাইট ওঠানামা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। পরিস্থিতি উন্নতি হলে তা আবার চালু হয়। এমনকি বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় সারাদেশে এসএসসি এবং সমমানের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। পরীক্ষা কেন্দ্রগুলো এখন আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। পানিবন্দি মানুষদের উদ্ধারে সেনা ও নৌবাহিনীর সদস্যরা কাজ করছে। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ সিলেট ও সুনামগঞ্জের বন্যায় মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন। 

সিলেটের অনেক প্রবীণ ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ছোট ছোট অনেক বন্যার পাশাপাশি সিলেটে স্মরণকালের ভয়াবহ ৩টি বন্যা হয়েছে ১৯৮৮, ২০০৪ ও ২০২২ সালে। তবে ক্ষয়ক্ষতি আর ভয়াবহতার হিসেবে ২০২২ সালের এই বন্যাকে এগিয়ে রাখছেন তারা। 

১৯৮৮ সালের বন্যা
এটি ছিল সিলেটের ইতিহাসের এক ভয়াবহ বন্যা। এখনও অনেকে কথা প্রসঙ্গে ৮৮-এর ভয়ংকর বন্যার উদাহরণ টানেন। বর্ষার প্রায় শেষ ভাগে আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বর প্রায় মাসখানেক স্থায়ী এই বন্যায় সমস্ত সিলেটে জুড়ে জনদুর্ভোগ আর ভোগান্তির সৃষ্টি করেছিল। সেই জনদুর্ভোগ বিশ্ব গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ায় সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সিলেটের গোলাপগঞ্জের বাসিন্দা মিনু মিয়া চৌধুরী বলেন, ১৯৮৮ সালের বন্যার ভয়াবহতা আজও চোখে ভাসে। আমি তখন যুবক ছিলাম। আমার এখনও মনে পড়ে ৮৮-এর বন্যার পানি প্রচণ্ড ময়লা ও কালো ছিল। বন্যা পরবর্তী পানিবাহিত রোগে অনেক মানুষ মারা যায়। তখনও অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের কারণে এই বন্যার সৃষ্টি হয়েছিল। 

২০০৪ সালের বন্যা
এখন পর্যন্ত ২০০৪ সালের অন্যতম এক ভয়াবহ বন্যা হয়েছিল। জুলাই মাসে মাত্র ৮ দিনের ব্যবধানে দু’দফায় হয়েছিল সেই বন্যা। প্রথম দফা পানি মাত্র দু’দিনের ভেতরে চলে গেলেও দ্বিতীয় দফায় চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছিল জনসাধারণকে। জানমালের ক্ষতি হয়েছিল অনেক। পানির নিচে তলিয়ে গিয়েছিল সম্পূর্ণ নিম্নাঞ্চল। সিলেট নগরীর শিবগঞ্জের বাসিন্দা শিক্ষানবিশ আইনজীবী নুরুল আলম আলমাস বলেন, ২০০৪ ও ২০২২ সালের বন্যার অনেক পার্থক্য লক্ষণীয়। তিনি বলেন, ২০০৪ সালের বন্যার পানি ধীরে ধীরে বাড়লেও ২০২২ সালের বন্যার পানি কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘরবাড়ি প্লাবিত করে ফেলে। এত দ্রুত পানি বৃদ্ধির ঘটনা এর আগে কখনও দেখা যায়নি বলেও জানান তিনি। নুরুল আলম আলমাস বলেন, মাত্র ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আমার বাসার ভেতর বুক সমান পানি জমে যায়। এতে করে ফার্নিচার, ফ্রিজসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় প্রায় তিন লক্ষাধিক টাকার ক্ষয়ক্ষতির শিকার হতে হয়।

২০২২ সালের বন্যা
২০২২ এর চলমান বন্যা অতিতের সকল রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে বলে জানান সিলেটের অনেক প্রবীণ নাগরিকেরা। এ বছরের ভয়াবহতা অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি যা ছিল কল্পনার বাইরে। এত ভয়াল বিপর্যয় এর আগে কখনও হয়নি বলে জানান অনেকে। নদীর তীরবর্তী গ্রাম গোলাপগঞ্জের লালনগর। কোনো বন্যাই তাদের ছেড়ে যায়নি। গ্রামের প্রবীণ নাগরিক মো. রাজ্জাক (৬০) গোলাপগঞ্জের একটি আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান করছেন। তিনি বলেন, আমি নিজ চোখে ১৯৮৮, ২০০৪ ও ২০২২ সালের বন্যা দেখেছি। অতীতের সকল রেকর্ড ভেঙেছে ২০২২-এর এই বন্যা। তিনি আরও বলেন, আমি বর্তমানে যে আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান করছি এখানে, ৮৮ ও ২০০৪-এর বন্যায়ও আশ্রয় নিয়েছিলাম। তখন এখানে এত উঁচু কোনো দালান-কোটা ছিল না। সে সময় বিদ্যুৎও ছিল না।

২০২২ এর চলমান এই ভয়াবহ বন্যায় সৃষ্টি হয়েছে এক মানবিক বিপর্যয়। চলমান এই বন্যায় ভোগান্তি ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অতীতের সকল রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। চলমান এই বন্যায় মানুষের পারস্পরিক যে সহমর্মিতা দেখা গিয়েছে তা অকল্পনীয়। বিশেষ করে সিলেটের সামাজিক সংগঠনগুলো নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে মানুষ জন্য। সিলেটের মানুষের জন্য সিলেটের প্রবাসীরা ফান্ড সংগ্রহ করে বন্যার্তদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। শুধু প্রবাসীরা নয়, সিলেটের এই দুর্যোগে দেশের বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন, রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন সমাজকর্মী, সেলিব্রিটি, ক্রিকেটার ও তরকারাও বন্যার্তদের সহযোগিতায় হাত বাড়িয়েছেন। সিলেটের এই বন্যায় একদিকে যেমন আর্তমানবতার সেবায় নিবেদিত মানুষ দেখা যাচ্ছে ঠিক এ কথাও সত্য যে অপরদিকে দেখা যাচ্ছে লুটেরা চিন্তার মানুষের দৌরাত্ম্যও!

মানুষের এই ক্রান্তিকালে নৌকা ভাড়া কেউ কেউ করেছে ২০ থেকে ৫০ হাজার। ৫ টাকার মোমবাতির দাম বেড়ে হয়েছে ৫০ টাকা। কৃত্রিম সংকট তৈরি করে চিড়ার দাম বাড়িয়েছে যা ছিল অপ্রত্যাশিত। 

সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের বাসিন্দা এম এ হান্নান সিলেট শহরে বসবাস করেন। বন্যার প্রথমদিকে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করতে না পারায় তিনি সদস্যদের দেখতে কোম্পানীগঞ্জে গিয়ে পরিবারের খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু নৌকার ভাড়া বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে তাকে। সিলেট থেকে কোম্পানীগঞ্জের ভাড়া হিসেবে ২০ হাজার টাকা চাওয়া হয় যা ছিল অপ্রত্যাশিত। পরবর্তীতে তার আর যাওয়া হয়নি তার। পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হওয়ার পর তিনি বাড়িতে গিয়েছেন পূর্বের চেয়ে সামান্য বেশি ভাড়া দিয়ে। 

কেন বার বার সিলেটে বন্যা হয়?
এবারের এরকম আকস্মিক বন্যার পেছনে ভারতের আসাম ও মেঘালয়ে অতিবৃষ্টি একটি বড় কারণ হলেও এর বাইরে আরও কিছু উপাদান কাজ করেছে বলে ধারণা করছেন গবেষকেরা।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আবু সাঈদ আরেফিন খাঁন ঢাকা মেইলকে বলেন, আমরা দেখেছি সিলেটে সর্বশেষ ২০০৪ সালে বড় বন্যা হয়েছিল। নগরীর উপ-শহরে মাঝে মধ্যে যেটা হয় সেটি জলাবদ্ধতা, সেটাকে বন্যা বলা যায় না। তিনি এ বছরের বন্যার জন্য নদীর নাব্যতাকে দায়ী করছেন না। নদীর নাব্যতা থাকলেও এই বন্যার সৃষ্টি হতো। কিন্তু ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হয়তো কিছু কম হতো। 

অধ্যাপক ড. মো. আবু সাঈদ আরেফিন খাঁন বলেন, চেরাপুঞ্জিতে এ বছর অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে। সিলেট ভৌগোলিক অবস্থানে যেহেতু মেঘালয়ের নিচে সুতরাং এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সিলেটকে বহন করতে হবেই। কারণ চেরাপুঞ্জির এই পানি সিলেটে বিভিন্ন নদ-নদী হয়ে মেঘনা নদীতে যায়। তিনি এই বন্যার পানি কয়েকদিন থাকবে বলে ধারণা করছেন। তিনি বলেন, আসাম এখনও বন্যায় নিমজ্জিত। এটা আমাদের মাথায় রাখতে হবে এই পানি সিলেট হয়েই যাবে। চেরাপুঞ্জিতে অতিরিক্ত বৃষ্টি মানেই সিলেটে বন্যার সম্ভাবনা। সুতরাং এ বিষয় আমাদের মাথায় রেখে পূর্ব প্রস্তুতি নিয়ে রাখলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম হবে। এখন থেকে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সাতক্ষীরা ও কক্সবাজারের মতো বন্যাতে আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে যাতে যেকোনো সময় ব্যবহৃত হয় সেভাবে তৈরি করা উচিত। 

সিলেটের এই বন্যার জন্য জলবায়ুর পরিবর্তন কতটুকু দায়ী?
শাহজালাল বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহকারী প্রধান অধ্যাপক রনি বসাক ঢাকা মেইলকে বলেন, ভয়াবহ এই বন্যার পেছনে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টা স্পষ্ট। কারণ চেরাপুঞ্জিতে যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে তা তো অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। অবশ্যই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে। তবে এ বছরের বন্যার জন্য জলবায়ুর বাইরে আরও অনেক বিষয় জড়িত। যেমন, আমাদের নদীগুলোর তলদেশ একেবারেই ভরাট হয়ে গেছে এবং এর সঙ্গে আমাদের কোনো উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়ার পূর্বে অনেক কিছু মাথায় রাখতে হবে কারণ এখানে  ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাপারের সাথে এনভায়রনমেন্টাল ম্যানেজমেন্ট রিলেটেড ব্যাপারও আছে কিন্তু। সিলেটের পানি নামতে যদি কোনো জায়গায় বাধা সৃষ্টি হয় তাহলে সে জায়গায়টি উদ্ধার করতে হবে। 

সিলেটের বন্যা না হওয়ার জন্য রাষ্ট্রের করণীয়
সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাবের সভাপতি মুহিত চৌধুরী ঢাকা মেইলকে বলেন, গত ১০০ বছরেও সিলেটে এমন বন্যার নজীর নেই। আমরা আগে দেখতাম সিলেটের কানাইঘাট, জকিগঞ্জ, কোম্পানীগঞ্জে বন্যা হতো। কিন্তু ইদানিং সে সকল জায়গার পূর্বে সিলেট শহর ডুবে যায়। যার মূল কারণ আমাদের কোনো শহর রক্ষা বাঁধ নেই। ফলে কোনো কারণে নদীতে পানি বাড়তে শুরু করলে তা খুব দ্রুত শহরে বা আবাসিক এলাকায় ঢুকে পড়ে। 

স্থানীয় এই সংবাদকর্মী বলেন, ভারতের উজানে পাথর উত্তোলনের ফলে মাটি আলগা হয়ে নদীতে চলে আসে। ফলে নদীর তলদেশ ভরে যায়। সেখানে নাব্যতা সংকট তৈরি হচ্ছে। রাষ্ট্রের কাছে এ মুহূর্তে সুরমার নাব্যতা ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানাই। কারণ শীতের মৌসুমে সুরমা নদীতে ক্রিকেট খেলা যায় আর বর্ষাতে একটু বৃষ্টিতেই বন্যা। এনিয়ে ভারতের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করা দরকার। তা না হলে এরকম অসংখ্য বন্যা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।

এইউ