জেলা প্রতিনিধি
২৫ আগস্ট ২০২৫, ০৩:২৯ পিএম
পিরোজপুরে নারী শিক্ষার অগ্রযাত্রায় অন্যতম মাইলফলক পিরোজপুর সরকারি মহিলা কলেজ। দীর্ঘ ইতিহাস, ঐতিহ্য আর ধারাবাহিক সাফল্যে কলেজটি আজ জেলার শিক্ষাঙ্গনের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ১৯৭৯ সালের মাঝের দিকে পিরোজপুর জেলার নারী শিক্ষার সুযোগ সীমিত ছিল। ঠিক তখনই জেলার শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিরা ও স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় পিরোজপুর মহিলা কলেজ। প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য ছিল মেয়েদের উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করা এবং তাদেরকে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তোলা। শুরুটা ছিল অল্প ক’জন শিক্ষার্থী নিয়ে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে কলেজটি উন্নত অবকাঠামো, আধুনিক পাঠক্রম ও দক্ষ শিক্ষকদের মাধ্যমে শিক্ষার মানে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
বর্তমানে কলেজটির তিনটি ভবন। যার মধ্যে একটি তিন তলা, একটি চার তলা ও একটি দুই তলা ভবন ও চারতলা বিশিষ্ট একটি আবাসিক হল ভবন রয়েছে। কিন্তু আবাসিক হলটিসহ কলেজের তিনটি ভবনের অবস্থা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। উঠে গেছে দেওয়ালের রং, খসে পড়ছে পলেস্তারা। ফাটল দেখা দিয়েছে দেওয়াল, ছাদ, পিলার ও বিমে। কিন্তু কোনো উপায় না থাকায় ঝুঁকিপূর্ণ ভবনেই চলছে শিক্ষার্থীদের পাঠদান।
জেলার গুরুত্বপূর্ণ এ মহিলা কলেজের ১ হাজার ৮০০ জন শিক্ষার্থীর ১ হাজার জনকেই পাঠদান করতে হয় ঝুঁকিপূর্ণ এ ভবন দু’টিতে। এছাড়াও ঝুঁকিপূর্ণ আবাসিক হলে থাকছেন শিক্ষার্থীরা। এদিকে কলেজের জায়গা সংকটের কারণে নির্মাণ করা যাচ্ছে না নতুন ভবন।

পিরোজপুর শহরের মূল সড়কের পাশেই কলেজটির অবস্থান। কলেজ চত্বরের পশ্চিম ও উত্তর দিকে দু’টি ভবনই সড়ক ঘেঁষা। দু’টি ভবনই ঝুঁকিপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও এতেই চলে পাঠদান। একটি চার তলা ভবন ও অপরটি দ্বিতল মূল ভবন। বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় চার তলা বিশিষ্ট ভবনের চতুর্থ তলার কয়েকটি শ্রেণিকক্ষ বন্ধ রয়েছে। ভবন দু’টিতে ৯টি শ্রেণি কক্ষ, তিনটি অনার্স বিভাগ ও সেমিনার কক্ষ এবং রসায়নসহ চারটি গুরুত্বপূর্ণ ল্যাবরেটরি রয়েছে। এছাড়াও ছাত্রী কমনরুম, গ্রন্থাগারসহ ৯টি প্রশাসনিক কক্ষ রয়েছে যার সবগুলোই প্রায় ঝুঁকিপূর্ণ। তবে এসবে কক্ষে ঝুঁকি নিয়েই নিয়মিত পাঠদানসহ চলে সব কার্যক্রম। দু’টি ভবনেরই একই হাল। দেয়ালের রঙের প্রলেপ উঠে গেছে অনেক আগে। প্রায়ই খসে পড়ে পলেস্তারা। শ্রেণিকক্ষের মেঝের কোথাও কোথাও উঠে গেছে ঢালাই। দোতলা ভবনটির পশ্চিম দিকের শ্রেণিকক্ষের বিমের ঢালাই করা বেশ কিছু অংশ ভেঙে রড বের হয়ে গেছে। ফাটল দেখা গেছে ভবনের দেওয়াল, ছাদ, পিলার ও বিমে। কলেজটির আবাসিক হালেরও একই দশা।

১৯৭৯ সালের ১ জুলাই পিরোজপুর শহরের ৮১ শতাংশ জায়গার উপর কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর ১৯৮৫ সালের ১ জুলাই কলেজটি সরকারীকরণ করা হয়। পরে ১৯৯০ সালে ২ তলা বিশিষ্ট একটি এবং ২০০০ সালে ২ তলা বিশিষ্ট আরও একটি ভবন নির্মাণ করা হয়। ধীরে ধীরে ২ তলা ফাউন্ডেশন বিশিষ্ট ২য় ভবনটি চারতলায় সম্প্রসারণ করা হয়। ঝুঁকিপূর্ণ ভবন দু'টিসহ কলেজটির সবগুলো ভবনে সবশেষ ২০১৫ সালে আবাসিক হল সহ কলেজের সকল ভবনের রঙের কাজ করা হয়। এরপর থেকে ভবনগুলোতে আর কোনো সংস্কার কাজ করা হয়নি। সময়ের সঙ্গে এগুলো এখন নড়বড়ে।
সম্প্রতি কলেজটিতে ৬ তলা বিশিষ্ট একটি বিজ্ঞান ভবন নির্মাণের জন্য অনুমোদন হয়েছে। ভবনটি নির্মাণের জন্য জায়গা প্রয়োজন কমপক্ষে ৩০ শতাংশ। তবে জায়গা সংকটের কারণে ভবনটি নির্মাণে তৈরি হয়েছে শঙ্কা। এর আগেও কলেজটিতে ২০১৯ সালে ১০ তলা একটি ভবনের অনুমোদন হলেও জায়গা সংকটের কারণে ভবনটি নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি।
![]()
সরকারি মহিলা কলেজের শিক্ষার্থীরা জানান, ভবনের প্রতিটি রুম ভাঙা ক্লাস করতে ভয়। বৃষ্টির সময় ভাঙা জানালা দিয়ে পানি আসে ক্লাসে। সংস্কার করা হলেও বেশিদিন টিকছে না সেই প্লাস্টার। আমরা শুনেছি যে নতুন একটা ছয় তলা ভবন তৈরি হওয়ার কথা কিন্তু জমি না থাকায় ভবন তৈরি হচ্ছে না। কলেজের পাশে থাকা সরকারি জমিটা সরকার যদি আমাদের দিত তাহলে নতুন ভবন তৈরি করা হতো।
সরকারি মহিলা কলেজের হোস্টেলে থাকা শিক্ষার্থীরা জানান, হোস্টেলে আমরা যারা থাকি সেখানের ভবনের প্লাস্টার ভেঙে পড়ে, দেয়াল ভাঙা, জানালা ভাঙা, জানালা দিয়ে বৃষ্টির দিন পানি আসে, দিনে রোদে আসে, ইলেকট্রিসিটি ভালো না। নতুন ভবন তৈরি ছাড়া এই সমস্যা সমাধান করা সম্ভব না।

সরকারি মহিলা কলেজ সহযোগী অধ্যাপক আব্দুল আউয়াল বলেন, দক্ষিণ বাংলার নারী শিক্ষা অর্জনে পিরোজপুর সরকারি মহিলা কলেজ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে চলছে। কিন্তু কলেজে বর্তমানে যথেষ্ট শ্রেণিকক্ষ সংকট বিরাজমান। একাডেমিক ভবন এক ও দুই জরাজীর্ণ অবস্থায় আছে। ক্লাস করার উপযুক্ত নয়। অনার্স বিল্ডিংয়ের পেছনে একটি অর্পিত সম্পত্তি আছে। সে সম্পত্তি কলেজের নামে যদি বরাদ্দ দেওয়া হয়। কলেজের নূতন ছয় তলা ভবনটি যদি সেখানে করা সম্ভব হয়, তাহলে এটি দক্ষিণ বাংলার নারী শিক্ষার জন্য যুগান্তকারী পদক্ষেপ হবে।
![]()
সরকারি মহিলা কলেজের সহযোগী অধ্যাপক মো. শেখ ফরিদ বলেন, আমাদের এই কলেজের পুরাতন বিল্ডিংগুলোর অবস্থা খুব করুণ। এখানে অনেক ঝুঁকি নিয়ে মেয়েদের ক্লাস করাতে হয়। গত কয়েক বছর ধরে আমাদের নতুনের বরাদ্দ ভবন এসেছে, তবে জায়গার অভাবে নতুন ভবন করা হয়নি। আমাদের ক্যাম্পাসের পাশের সরকারি সম্পত্তিগুলো দীর্ঘদিন পড়ে আছে। সেই জায়গাগুলো মহিলা কলেজের নামে অন্তর্ভুক্ত করলে নতুন ভবনটি সেখানে করা যায়।
![]()
সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ শেখ রফিকুল ইসলাম বলেন, কলেজের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলে শ্রেণিকক্ষের সমস্যা। আমি যোগদানের পরপরই এখানে সব শ্রেণি পেশার মানুষ নিয়ে একটি মতবিনিময় সভা করি। এই মতবিনিময় সভায় সবাই কলেজের ক্যাম্পাস বড় করার জন্য কলেজের পাশের পরিত্যক্ত সরকারি সম্পত্তি কলেজের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য সবাই মত প্রকাশ করে। তাই আমি জেলা প্রশাসকের কাছে একটি আবেদন করি জায়গাটি মহিলা কলেজের নামে পাওয়ার জন্য। তবে এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি আমরা দেখতে পাইনি। তাই আশা করছি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
প্রতিনিধি/এসএস