জেলা প্রতিনিধি
০৫ আগস্ট ২০২৫, ০২:২৩ পিএম
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশের ইতিহাসে স্মরণীয় এক গণঅভ্যুত্থানের দিন। স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে সেদিন কুষ্টিয়াসহ সারাদেশে উত্তাল হয় ছাত্র-জনতা। তবে কুষ্টিয়ায় সেই আন্দোলন রক্তাক্ত ট্র্যাজেডিতে রূপ নেয়। পুলিশের গুলিতে ও সরকারি দলের সন্ত্রাসে প্রাণ হারান কুষ্টিয়ার অন্তত ৮ জন, আহত হন অনেকে। শহীদ পরিবারগুলো এক বছর পরও বিচার না পাওয়ায় চরম হতাশায় দিন কাটাচ্ছেন।
সেদিন সকালে শুরু হওয়া বিক্ষোভে পুলিশ হামলা চালায়। বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গুলি ও টিয়ারশেল ছোড়া হয়। এতে কুষ্টিয়ায় পুলিশের গুলিতে ৬ জন, টিয়ারশেলের আঘাতে ১ জন এবং যুবলীগের হামলায় ১ জন নিহত হন। এছাড়া দেশের অন্যান্য এলাকায় আন্দোলনে অংশ নিয়ে কুষ্টিয়ার আরও ৭ জন শহীদ হন।
নিহত ব্যক্তিরা হলেন আব্দুল্লাহ, ইউসুফ, ওসামা, বাবলু ফারাজী, সুরুজ আলী, আশরাফুল ইসলাম, সবুজ আলী ও মাহিম হোসেন।
অন্য শহীদরা হলেন ইয়ামিন, আলমগীর শেখ, মারুফ হোসেন, জামাল উদ্দিন শেখ, আব্দুস সালাম, সেলিম মণ্ডল ও জুবায়ের। তারা ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান করে আন্দোলনে অংশ নেন।
নিহত ইউসুফের মেয়ে সীমা খাতুন জানান, তার বাবাকে গুলি করে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয়েছে। এসআই সাহেব আলী ও এসআই মুস্তাফিজ এ ঘটনায় সরাসরি জড়িত বলে তিনি অভিযোগ করেন। মামলা করতে চাইলে প্রথমে পুলিশ নেয়নি। পরে ১০ দিন পর মামলা করা হয়। সীমা বলেন, ‘মামলায় নির্দোষদের নাম ঢুকিয়ে অনেকেই বানিজ্য করেছে।’
শহীদ ওসামার পিতা জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘আমার ছেলেকে আল্লাহর রাস্তায় শহীদ করা হয়েছে। পুলিশ ও প্রশাসন এসে আপোষের কাগজে সই নিয়ে গেছে।’
শহীদ বাবলু ফারাজীর ছেলে সুজন বলেন, ‘আমার বাবাকে মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এক বছরেও বিচার হয়নি। দায়ীদের শাস্তি চাই, নির্দোষদের অব্যাহতি দেওয়া হোক।’
শহীদ সুরুজ আলীর স্ত্রী ফাহিমা খাতুন বলেন, ‘আমার স্বামীকে বুকে গুলি করে হত্যা করেছে পুলিশ। মামলা নিয়ে যারা বানিজ্য করেছে, তাদেরও বিচার চাই।’
শহীদ আশরাফুল ইসলামের স্ত্রী লাবণী আক্তার বলেন, ‘আমার স্বামীকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করেছে পুলিশ। অথচ মামলায় পুলিশের নাম দিতে দেয়নি। দোষীদের ফাঁসি চাই, শহীদ পরিবারকে চাকরি ও পুনর্বাসন দিতে হবে।’
শহীদ সবুজ আলীর স্ত্রী রেশমা খাতুন বলেন, ‘আমার স্বামীকে কুপিয়ে হত্যা করেছে যুবলীগ-আওয়ামী লীগ নেতারা। মূল আসামিদের পুলিশ গ্রেপ্তার করছে না, বরং তদন্ত কর্মকর্তারা ঘুষ খাচ্ছে।’
১৩ বছর বয়সী শহীদ আব্দুল্লাহর বাবা লোকমান হোসেন বলেন, ‘এসআই সাহেব আলী প্রকাশ্যে আমার ছেলেকে গুলি করে হত্যা করেছে। অথচ মামলায় তার নামই নেই। এক বছরেও বিচার পাইনি। আমি তার ফাঁসি চাই।’
শহীদ মাহিম হোসেনের বাবা ইব্রাহীম হোসেন জানান, আন্দোলনের সময় পুলিশের টিয়ারশেলের ধোঁয়ায় অসুস্থ হয়ে তার ছেলে মারা যায়। তিনি দোষীদের শাস্তি দাবি করেন।
এ বিষয়ে কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান জানান, ‘মামলাগুলো গুরুত্বসহকারে তদন্ত চলছে। পুলিশ হেডকোয়ার্টারের কমিটির দিকনির্দেশনায় কাজ করছি।’
জেলা প্রশাসক মো. তৌফিকুর রহমান জানান, ‘প্রতিটি শহীদ পরিবারকে ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র ও ২ লাখ টাকা এককালীন সহায়তা দেওয়া হয়েছে। পুনর্বাসন ও চাকরির ব্যবস্থাও করা হবে।’
তবে পরিবারগুলোর দাবি, সেসব সহযোগিতা যথেষ্ট নয়। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি, দোষীদের শাস্তি, শহীদ পরিবারে চাকরি ও পুনর্বাসনের দাবি এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। তাদের প্রশ্ন প্রকাশ্যে গুলি করা পুলিশ সদস্যরা কীভাবে এখনো চাকরিতে বহাল থাকে?
এক বছর অতিক্রান্ত হলেও বিচারের প্রক্রিয়া শুরু না হওয়ায় শহীদ পরিবারগুলো ক্ষোভ, হতাশা ও বেদনার মাঝে দিন কাটাচ্ছেন। তাদের চাওয়া— দোষীদের শাস্তি হোক, আর শহীদদের মর্যাদা নিশ্চিত করুক রাষ্ট্র।
প্রতিনিধি/একেবি