০৫ আগস্ট ২০২৫, ০৯:০০ এএম
ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনের দাবিতে চলমান আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ৫ আগস্টেও শিক্ষানগরী রাজশাহীর রাজপথে নেমে আসেন ছাত্র-জনতা। অন্যদিকে, হাসিনার পতন ঠেকাতে সশস্ত্র অবস্থান নেয় আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। আন্দোলনকে জোরালো করতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক শিক্ষার্থীদের রাজপথে সংঘবদ্ধ করেন। পূর্বঘোষণা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে মিছিল বের হয়ে কাজলা হয়ে তালাইমারি মোড়ে জড়ো হয়। এদিকে ভদ্রা থেকে আরও একটি মিছিল এসে সেখানে মিলিত হয়।
আন্দোলনকারীরা নগরীর জিরো পয়েন্টের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের অস্ত্রের ঝনঝনানিতে রাজপথ থমথমে হয়ে পড়ে। ছাত্র-জনতার মিছিল আলুপট্টি মোড়ে পৌঁছালে কুমারপাড়ায় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা অবস্থান নেয়। তাদের সঙ্গে ছিল পুলিশও।
বিক্ষোভকারীরা স্লোগান দিতে থাকেন; ‘আমার ভাই মরলো কেন, খুনি হাসিনা জবাব দে’, ‘এক দফা এক দাবি, খুনি হাসিনা কখন যাবি’, ‘আওয়ামী লীগের চামড়া, তুলে নেবো আমরা’, ‘হইহই রইরই, ছাত্রলীগ গেলি কই’, ‘দিয়েছি তো রক্ত, আরও দেবো রক্ত’, ‘আমার ভাইয়ের রক্ত বৃথা যেতে দেবো না’, ‘লেগেছে রে লেগেছে, রক্তে আগুন লেগেছে’ ইত্যাদি।
আরও পড়ুন—
অনেকের হাতে ছিল লাঠি, মাথায় বাঁধা ছিল পতাকা। সেই দিন কাফনের কাপড় পরে স্লোগান দিচ্ছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ রাজপথে নেমে আসেন। বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী নিয়ে বিএনপি, জামায়াত, ইসলামী ছাত্রশিবির ও ছাত্রদল মাঠে সক্রিয় ছিল।
দুপুর ১২টার দিকে আলুপট্টি মোড়ে অবস্থানরত আন্দোলনকারীদের ওপর মুহুর্মুহু গুলি চালানো শুরু হয়। গুলির নেতৃত্বে ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও রাজশাহী সিটির সাবেক মেয়র খায়রুজ্জামান লিটন, মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ আলী কামাল, সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার এবং মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি নূর মোহাম্মদ সিয়াম। ডাবল হ্যান্ডেড শ্যুটার রুবেল দু’হাতে গুলি চালায়। রাজশাহী নগরী রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।
গুলিবিদ্ধ হন ইসলামী ছাত্রশিবিরের রাজশাহী মহানগরের তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক আলী রায়হান। তার কপালে গুলি লাগে। আরও কয়েকজনের পায়ে গুলি লাগে। আন্দোলনকারীরা তাদের হাসপাতালে নেওয়ার চেষ্টা করলে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা অ্যাম্বুলেন্সে হামলা চালায় ও ভাঙচুর করে। বিকল্প গাড়িতে আহতদের হাসপাতালে নেওয়া হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৮ আগস্ট আলী রায়হান শাহাদাত বরণ করেন।

আরও পড়ুন—
৫ আগস্ট সাকিব আনজুমকে ধাওয়া করে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। তিনি একটি বাসায় আশ্রয় নেন। সেখানে ঢুকে তাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এছাড়া নগরীর রেলগেটে রামদা ও চাপাতিসহ অবস্থান নেয় সন্ত্রাসীরা, সৃষ্টি হয় আতঙ্কজনক পরিস্থিতির।
একজন চিকিৎসক জানান, ৫ আগস্ট দুপুরে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অন্তত অর্ধশত আন্দোলনকারী গুলিবিদ্ধ অবস্থায় চিকিৎসা নিতে আসেন।
তবে পরিস্থিতি পাল্টে যায় সেনাপ্রধানের ব্রিফিংয়ের সংবাদ শোনার পর। ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনের খবরে জনতা উল্লাসে ফেটে পড়ে। রাস্তায় পতাকা হাতে বিজয় মিছিল শুরু হয়। সাহেব বাজার জিরো পয়েন্টসহ প্রতিটি মোড়ে আনন্দ মিছিল হয়। কুমারপাড়ার আওয়ামী লীগের অফিস বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দেওয়া হয়। নগরীর উপশহরে খায়রুজ্জামান লিটনের বাসায় হামলা ও ভাঙচুর হয়। রেলগেট সংলগ্ন নগর ভবনে হামলা ও লুটপাট হয়। সিএন্ডবি মোড়ে শেখ মুজিবের ম্যুরাল এবং মেট্রোপলিটন পুলিশ কার্যালয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
মালোপাড়া পুলিশ ফাঁড়িতে কয়েকজন সদস্য অবরুদ্ধ হলে সেনাবাহিনী গিয়ে তাদের উদ্ধার করে। পুলিশের অনেকে ক্যান্টনমেন্টে আশ্রয় নেন।
সেই দিনের স্মৃতিচারণ করে কাটাখালীর শ্যামপুর এলাকার বাসিন্দা মো. রোকনুজ্জামান ‘ঢাকা মেইল’-কে বলেন, ‘৫ আগস্ট দিনটি ছিল ব্যতিক্রম। দুপুর ১২টার দিকে তালাইমারি থেকে জিরো পয়েন্টের দিকে যাচ্ছিলাম। তখন পুলিশ ও আওয়ামী সন্ত্রাসীরা টিয়ারশেল, রাবার বুলেট ও গুলি ছোড়ে। তাদের হাতে ছিল রামদা, চাপাতি।’
তিনি আরও বলেন, ‘একটা গুলি আমার ডান বাহুতে লাগে। সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হতে পারিনি, পরে ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে এক্স-রে করি। ৩৫ ঘণ্টা পর, ৬ আগস্ট রাত ৮টায় অপারেশন করে গুলি বের করা হয়। এখন আমি সুস্থ। তবে খুনি হাসিনা ও তার দোসরদের বিচার এখনো হয়নি, এটাই কষ্ট।’
গত বছরের ৫ আগস্টের রাজশাহীর চিত্র স্মরণ করে কথা বলেন প্রফেসর ড. ইফতিখারুল আলম মাসউদ। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের অধ্যাপক ও বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার। আন্দোলনের পুরো সময় তিনি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে রাজপথে ছিলেন।
তিনি বলেন, ‘৩৬ জুলাই বা হাসিনার পতন হঠাৎ করে হয়নি। গোটা জাতির আকাঙ্ক্ষা ছিল। সেই আন্দোলনে আমাদের শিক্ষার্থীরা অসামান্য ভূমিকা রেখেছে। আমরা ইতিহাসের অংশ হয়েছিলাম। রাজপথে শিক্ষার্থীদের পাশে ছিলাম, আটক হওয়াদের ছাড়িয়ে আনা থেকে শুরু করে মিছিল-মার্চে নেতৃত্ব দিয়েছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘৩১ জুলাই থেকে নতুনভাবে আন্দোলন শুরু হয়। ৩ আগস্ট আমরা ভদ্রা স্টেশন হয়ে বিন্দুর মোড় পর্যন্ত মিছিল নিয়ে যাই। ৪ আগস্ট তাদের ভদ্রায় আটকে রাখি। ৫ আগস্ট ছাত্রদের দাবি ছিল যেকোনো মূল্যে জিরো পয়েন্টে যেতে হবে। আমার মন সায় দিচ্ছিল না। তবে ঢাকার দিক থেকে নানা খবর আসছিল বড় কিছু ঘটতে যাচ্ছে।’
‘১১টার দিকে আমরা রওনা দেই জিরো পয়েন্টের দিকে। আমি, ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর সালেহ হাসান নকীব স্যার একসঙ্গে ছিলাম। তখন শাহ মখদুম কলেজের সামনে পৌঁছাই। হঠাৎ করে গুলি ও বোমাবাজি শুরু করে আওয়ামী পেটুয়া বাহিনী। আমরা ভাবতেই পারিনি তারা সাধারণ মানুষের ওপর এমন বর্বর আক্রমণ চালাবে। পুলিশের সহযোগিতায় সব চলছিল।’

‘তখনই ঢাকা থেকে খবর আসে, ফ্যাসিস্ট হাসিনা পালিয়ে গেছেন। আমি শিক্ষার্থীদের বললাম শান্ত হও, খুনি পালিয়ে গেছে। তখন শিক্ষার্থীরা আমাকে জড়িয়ে ধরলো, সিজদায় পড়ে গেল। সে কী আনন্দ! সেখান থেকে সারা শহরে বিজয়ের মিছিল শুরু হয়। আমরা ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছি।’
প্রতিনিধি/একেবি