images

সারাদেশ

চাকরিতে ঢুকে মা-বাবাকে সঙ্গে নিয়ে থাকার ইচ্ছা ছিল শহীদ আলী রায়হানের

জেলা প্রতিনিধি

০৪ আগস্ট ২০২৫, ০৪:৫১ পিএম

‘আন্দোলনের সময় প্রতিদিন কল দিত, সন্ধ্যায় বা ভোরে। শুধু বলত- চিন্তা করিয়েন না, আমি ভালো আছি। ঘুরেফিরে একই কথাই বলত। ৪ আগস্ট এশার নামাজের পর রাত সাড়ে ৮টা বা ৯টায় মোবাইলে সর্বশেষ কথা হয়। চাকরি যেখানে করবে, ওখানে আমাদের নিয়ে চলে যাবে বলেছিল। আরও বলত, আব্বা বাড়িঘর নিয়ে চিন্তা করা লাগবে না। আমি যেখানে চাকরি করব, সেখানে আমার সঙ্গে আপনারা থাকবেন। ছেলের আমার কত আশা ছিল, কিন্তু এক গুলিতে সব শেষ হয়ে গেল’- ঢাকা মেইলকে এসব বলতে বলতে দু’চোখ দিয়ে জল গড়িতে পড়তে থাকে রাজশাহীর শহীদ আলী রায়হানের বাবা মো. মুসলেম উদ্দিনের। এসময় ডুকরে ডুকরে কাঁদতে থাকেন তিনি।

শহীদ আলী রায়হানের বাসা রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার মঙ্গলপাড়া গ্রামে। ওই এলাকার মো. মুসলেম উদ্দিন ও মায়ের নাম মোসা. রোকসানা বিবি দম্পতির বড় সন্তান তিনি। আলী রায়হানের ছোট ভাই তানভীর ইসলাম রানা বর্তমানে পরিবারের সঙ্গে রয়েছেন। জিপিএ-৫ ফলাফল করে গ্রামের স্কুল ও কলেজ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাশ করে শহরে চলে আসেন আলী রায়হান। দেশের ঐতিহ্যবাহী রাজশাহী কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগ থেকে পাশ করেন স্নাতক। এখান থেকেই ২০২৩ সালে মাস্টার্স শেষ করেন তিনি। এরপর ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকার জন্য একটি কোর্সে ভর্তি হন। তিনি বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের রাজশাহী মহানগর শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন।

Kobor

শহীদ আলী রায়হান রাজশাহী মহানগর ছাত্রশিবিরের নেতৃত্ব স্থানে থাকায় বেশিরভাগ সময়ই সময় কাটাতে হতো পরিবার ছাড়া। তবে ছাত্রজীবন শেষে চাকরিতে ঢুকে পরিবারকে নিয়ে একসঙ্গে থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ছাত্রজীবন শেষ হওয়ার আগেই গত বছর জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে গুলিবিদ্ধ হয়ে শাহাদাত বরণ করেন তিনি। জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের ডাকে সাড়া দিয়ে নেতাকর্মীদের সঙ্গে রাজপথে নেমে আসেন আলী রায়হান। লাগাতার আন্দোলনে প্রতিদিনই ছিলেন প্রথম সারিতে। সর্বশেষ স্বৈরাচার হাসিনার পতনের দিন ৫ আগস্ট সকাল থেকে নগরীতে আন্দোলন তীব্র হয়। এসময় মুহুর্মুহু গুলি ছোড়ে পুলিশ এবং আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। একটি গুলি এসে লাগে আলী রায়হানের কপালে। মাটিয়ে লুটিয়ে পড়েন তিনি। আন্দোলনকারীরা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করেন। তিনদিন চিকিৎসাধীন থাকার পর ৮ আগস্ট সন্ধ্যায় হাসপাতালে মারা যান তিনি। তার মৃত্যুতে সর্বস্তরে শোকের ছায়া নেমে আসে। আলী রায়হানের জানাজার নামাজ পড়ান জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান। ছাত্রশিবিরের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সভাপতি মঞ্জুরুল ইসলামসহ বিভিন্ন দল ও শ্রেণিপেশার হাজার হাজার মানুষ তার জানাজায় অংশ নেন।

thumbnail_father_of_Raihan

আলী রায়হানের গ্রামের বাসায় গিয়ে কথা হয় তার পরিবারের সাথে। তার বাবা মো. মুসলেম উদ্দিন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমার ছেলে চাকরির কথা বলত, বাড়ি-ঘর করা লাগবে, বিয়েশাদি করা লাগবে। ছেলের আমার কত আশা ছিল, চাকরি যেখানে করবে, ওখানে আমাদের নিয়ে চলে যাবে বলেছিল। আরও বলত, আব্বা বাড়িঘর নিয়ে চিন্তা করা লাগবে না। আমি যেখানে চাকরি করব, সেখানে আমার সাথে আপনারা থাকবেন। কিন্তু এক গুলিতে সব শেষ হয়ে গেল।’

মুসলেম উদ্দিন বলেন, ‘রায়হান শিবির করত জানতাম। কিন্তু নিষেধ করিনি। শুধু চিন্তিত একটাই বিষয়ে ছিলাম, ধরে লিয়া যাবে। কিন্ত কখনও শিবির করতে মানা করিনি। রাজশাহী কলেজে পড়ত তখন তাকে ধরেছিল পুলিশ। খুব মেরেছিল তখন। ছেলে আমার খুব ভালো ছিল। নামাজ-কালাম সবকিছু পড়ত।’

Raihan1

শেষ মুহূর্তের স্মৃতিচারণ করে আলী রায়হানের বাবা বলেন, ‘৪ আগস্ট তারিখ এশার নামাজের পর সাড়ে ৮টা বা ৯টায় মোবাইলে আমার শেষ কথা হয়। আন্দোলন চলাকালে প্রতিদিন কল দিত। হয় সন্ধ্যায় বা ভোরে। আমি বলতাম, একটু করে কল দিও, তাহলে আমরা টেনশন মুক্ত থাকব। ও শুধু বলত, চিন্তা করিয়েন না, ভালো আছি। ঘুরেফিরে একই কথাই বলত। মায়ের সঙ্গেও কথা বলত। ওর ছোটভাই রানার পড়ালেখা করানোর জন্য বলেছিল, কলেজে ভর্তি হও। তাকে ৩৪ হাজার ট্যাকা দিয়্যা ল্যাপটপ কিনে দিয়েছিল। ছেলেটা আমার খুবই ভালো ছিল।’

thumbnail_Raihan_guli2

আলী রায়হানের ছোট ভাই তানভির ইসলাম রানা ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘ভাইয়া ৫ তারিখ ভোরে দোয়া করেছিল। আমার জীবনের বিনিময়ে হলেও আল্লাহ বিজয় দাও। সত্যিই তাই হলো। ভাইয়াকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। দ্বিতীয় স্বাধীনতা পেয়েছি আমরা।’ হতাশা প্রকাশ করে রানা বলেন, ‘মামলা করেছি। কিন্তু কোনো অগ্রগতি নাই। ৪ জন আসামি ধরা হয়েছে, ৫০ জনের ভেতর যাদের নাম আছে। অনেকে বলে, আসামিরা রাজশাহী শহরেও নাকি ঘোরাফেরা করে। কিছুদিন আগে ডিবি অফিসে গেছিলাম, ওরা বলে আমরা কাজ করছি। আসামিরা পলাতক আছে।’ খুনের বিচার চেয়ে রানা বলেন, ‘আমরা খুনিদের মৃত্যুদণ্ড আশা করি। আমরা ন্যায়বিচার পাব বলে আশা করি। খুনিদের ফাঁসি হোক, এতে মানুষ আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে। এ ধরণের কাজ করতে ভয় পাবে।’

আরও পড়ুন

জুলাই-আগস্ট বিপ্লব আগামী দিনের চলার পথের দিকনির্দেশক: ইবি ভিসি

আলী রায়হানের মা রোকসানা বিবি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘ছাওয়াল আমার অনেক হাসিখুশি ছিল। বাড়িত কম আইসতো। বুল্যাছিনু বিয়্যার কথা, কিন্তু করেনি। শিবির কইরতো। শিবির আর পড়ালেখা শ্যাষ হলে চাকরিত যাবে বুল্যাছিল। চাকরিত ঢুকলে আমারেক লিয়্যা চইল্যা যাইত চায়্যাছিল। খুনির গুলিত আমার ছেলে শহীদ হয়্যাস।’ এরপর কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

প্রতিনিধি/এসএস