উপজেলা প্রতিনিধি
০৩ আগস্ট ২০২৫, ০৬:১৭ পিএম
নামে-বেনামে শতশত একর জায়গা পড়ে আছে। তবুও সরকারি বনের গাছ কেটে ফাঁকে ফাঁকে নির্মাণ হচ্ছে বাড়ি-ঘর। আরেকপ্রান্তে জেটি নির্মাণ করে তৎসংলগ্ন থেকে শুরু করে বনের সারি সারি গাছ কেটে করা হয় দীর্ঘ সড়ক ও দোকানপাট । এমন বিশৃঙ্খল, বেপরোয়া ও আধিপত্যের বেষ্টনীতে অরক্ষিত নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার ঢালচরের বনায়ন।
সরকারি বন কেটে উজাড় করে ফেললেও এখানে সম্পূর্ণ নির্বিকার উপজেলার নলচিরা বনবিভাগ। মাসের পর মাস চলে গেলেও বন সংশ্লিষ্ট কারো দেখা মেলে না এই দুর্গম এলাকায়। বনবিভাগের উদাসীনতার কারণে ইতিপূর্বে উজাড় হয়ে গেছে চরটির পূর্ব-উত্তর পাশের চর গাসিয়ার বনায়নও।
গত সোমবার ট্রলারযোগে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ঢালচরের পূর্ব-দক্ষিণ কোণে নির্মিত জেটি থেকে শুরু করে ম্যানগ্রোভ বনের সারি সারি গাছ কেটে মাঝ দিয়ে উত্তর দিকে করা হয় সড়ক। যুক্ত করে পশ্চিম দিকে করা হয় আরেকটি সড়ক। এর মাথায় নির্মিত হচ্ছে দোকানপাট ও ব্যবসাকেন্দ্র। গড়ে তোলা হয় মাছ ঘাটও। অবস্থানরত ব্যবসায়ীদের জিজ্ঞেস করলে তারা পার্শ্ববর্তী মনপুরা থেকে এসেছে বলে জানান।
এলাকাবাসী ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মনপুরার একটি প্রভাবশালী পরিবার (সাবেক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সচিব নাজিম উদ্দিন চৌধুরী ও তার দখলসঙ্গী চাচা মনপুরা উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন চৌধুরী বনবিভাগের বাধা উপেক্ষা করে নিজেদের প্রয়োজনে অব্যাহতভাবে এসব অনিয়ম চালিয়ে যাচ্ছেন। স্বাধীনতাপূর্ব ও উত্তর সময় থেকে তারা একেকবার একেক শক্তি এবং গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে হাতিয়াবাসীর এ চরের দক্ষিণ পাশের প্রায় চার বর্গকিলোমিটারের মতো দখলে রেখেছে। ওই অংশে বন কাটার সঙ্গে প্রভাবশালী পরিবারের অনুগত বেলাল মেম্বার টিম জড়িত।
মুঠোফোনে বেলাল মেম্বারের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, এসব নাজিম উদ্দিন চৌধুরীর পরিবারের সিদ্ধান্তে হয়েছে। এতে তার কোনো দায় নেই।
ঢালচরের পর ট্রলারযোগে যাওয়া হয় 'চর কলাতলি'র দিকে। হাতিয়ার ঢালচরের রাস্তার মাথায় পা রাখতেই হাঁটু সমান পানি আর কাদামাটি। দীর্ঘপথ কাদামাটি পাড়ি দিয়ে মাদ্রাসা বাজার হয়ে আসা হয় মসজিদ মার্কেট। এখানে কিছু মানুষের সঙ্গে কথা হয়।
এলাকাবাসী জানান, পাশের ম্যানগ্রোভ বন কেটে গৃহ নির্মাণসহ জমি পরিস্কার করা হচ্ছে। দেরি না করে সাইক্লোন সেন্টার থেকে দক্ষিণের কাঁচা রাস্তায় শুরু হয় পথ চলা। রাস্তাটি ঢালচরের পুরাতন মসজিদের কাছে গিয়ে শেষ হয়। কাঁচা রাস্তায় কাদামাটি কোথাও হাঁটু সমান, কোথাও বা কিছুটা কম।
পাশে তাকাতেই দেখা মিলে বনের ভিতর ছোট-ছোট অসংখ্য বাড়িঘর, নতুন পুরাতন কেটে ফেলা গাছের অসংখ্য গোড়া। মসজিদ সংলগ্ন থেকে উত্তর দিকে ম্যানগ্রোভ বন কেটে এক-দেড় একর করে প্রস্তুত হচ্ছে চাষাবাদের জমি।
চরে বসবাসরত অনেকে আবার বনের গাছ এবং লাকড়ি নিয়ে তাদের প্রয়োজন মেটায়। এর জন্য বছর শেষে বনরক্ষকদের নিয়োজিত ব্যক্তিকে দিতে হয় ৫০০ থেকে এক হাজার করে টাকা কিংবা ২০ থেকে ৪০ কেজি করে ধান।
বনের উপর এমন আক্রমণ সম্পর্কে কয়েকজন বাসিন্দা ও এক বাথানিয়া নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, হাতিয়া এবং বহিরাগত কিছু ভূমি খেকো একেকবার একেক সময় দ্বীপ হাতিয়ার বিভিন্ন এলাকার নদী ভাঙা মানুষজন থেকে ৩০-৫০ হাজার করে টাকা নিয়ে বনের ভেতর জায়গা করে দেন।
উপজেলার সুখচর ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ড ঢালচরের বাসিন্দারা আরো জানান, গত দুই মাসের মধ্যে বন এলাকায় ফরেস্টের কোনো লোকজনকে দেখতে পাননি তারা।
হাতিয়া উপজেলার নলচিরা রেঞ্জের ঢালচর বিট কর্মকর্তা আরিফুর ইসলাম বন এলাকার নানান জটিলতার কথা তুলে ধরে বলেন, অপরাধীদের বিরুদ্ধে বন মামলা হয়েছে। এছাড়া মহিষ গরুর উৎপাত না থাকলে প্রকৃতিগতভাবে বনায়ন সৃষ্টির সুযোগ তৈরি হয়। তবে তিনি চার দিন সময় নিয়েও বনের আয়তন সম্পর্কে তথ্য দিতে পারেননি।
নলচিরা বন কর্মকর্তা আল-আমিন গাজী জানান, সরকারি বেতন-ভাতা ভোগ করার পরও চাঁদা সংগ্রহ, অনিয়ম বা দায়িত্বে অবহেলা করার সুযোগ নেই।
নোয়াখালী উপকূলীয় বন কর্মকর্তা আবু ইউসুফ জানান, খোঁজখবর নিয়ে বিষয়টি দেখতেছি। এ অঞ্চলের ঢালচরটি ‘সেনসিটিভ জায়গা’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এসএ/ক.ম