images

সারাদেশ / শিক্ষা

রাকসু: নেতৃত্ব তৈরির এক ঐতিহাসিক পাঠশালা

৩১ জুলাই ২০২৫, ০৮:১০ পিএম

দীর্ঘ ৩৫ বছর পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ফলে নতুন নেতৃত্বের আশায় মুখিয়ে আছেন শিক্ষার্থীরা। ইতোমধ্যেই বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে।

রাকসু শুধু শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের একটি সংগঠন নয়, এটি জাতীয় রাজনীতিতে নেতৃত্ব তৈরির অন্যতম ভিত্তিও। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১৯৬০–৮০ দশকে রাকসুর মাধ্যমে যারা উঠে এসেছেন, তাদের অনেকে পরবর্তীকালে জাতীয় পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্ব দিয়েছেন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার তিন বছর পর প্রথম ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৫৬-৫৭ শিক্ষাবর্ষে। তখন এই সংসদের নাম ছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্টুডেন্টস ইউনিয়ন। ১৯৬২ সালে রাকসু নামে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের যাত্রা শুরু হয়। এরপর মোট ১৬ বার রাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।

১৯৮৯ সালে রাকসুর সর্বশেষ নির্বাচন হয়। তবে তার আগের কয়েক দশকে এখান থেকে উঠে এসেছেন জাতীয় রাজনীতির বেশ কয়েকজন পরিচিত মুখ। ইতিহাসের পাতায় যেমন তারা রাকসুতে দৃঢ় নেতৃত্ব দিয়েছেন, তেমনি জাতীয় রাজনীতিতেও রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

আরও পড়ুন—

রাকসু থেকে উঠে এসে পরবর্তীতে জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারকারী কয়েকজন নেতার সংক্ষিপ্ত পরিচয়:

১. আবু সাইয়িদ
১৯৬৫-৬৬ শিক্ষাবর্ষে রাকসুর ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ পূর্ব সময়ে সক্রিয় রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। স্বাধীনতার পর তথ্য প্রতিমন্ত্রী এবং সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

২. নুরুল ইসলাম ঠান্ডু
১৯৭৩-৭৪ শিক্ষাবর্ষে রাকসুর ভিপি ছিলেন। পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য এবং নিজ নির্বাচনী এলাকায় এমপি পদপ্রার্থী ছিলেন।

৩. ফজলুর রহমান পটল
১৯৭৪-৭৫ সালে রাকসুর ভিপি ছিলেন। পরবর্তীতে বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

৪. শামসুল হক টুকু
সত্তরের দশকে রাকসুর জিএস ছিলেন। পরে তিনি আওয়ামী লীগের নেতা, জাতীয় সংসদের সদস্য এবং স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।

৫. ফজলে হোসেন বাদশা
১৯৮০-৮১ শিক্ষাবর্ষে রাকসুর ভিপি ছিলেন। বর্তমানে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট থেকে রাজশাহী সদর আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

৬. রুহুল কবির রিজভী
১৯৮৯-৯০ সালে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ রাকসু নির্বাচনে ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সভাপতি এবং বর্তমানে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব ও মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

৭. রুহুল কুদ্দুস বাবু
একই নির্বাচনে (১৯৮৯-৯০) জেনারেল সেক্রেটারি (জিএস) নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) রাজনীতিতে যুক্ত হন।

৮. নূরুল ইসলাম বুলবুল
১৯৯০ সালের রাকসু নির্বাচনে শহীদ শামসুজ্জোহা হলের জিএস নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি এবং বর্তমানে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের আমির। এছাড়াও তিনি জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর ৩ আসনে মনোনীত সংসদ সদস্য প্রার্থী।

রাকসু নির্বাচন তফসিল ও সময়সূচি:
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর রাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সোমবার (২৮ জুলাই) বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে রাকসু নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক এনামুল হক এই তফসিল ঘোষণা করেন।

ঘোষণা অনুযায়ী:

৩১ জুলাই: আচরণবিধি প্রকাশ;

৬ আগস্ট: খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ;

৭ ও ১০–১২ আগস্ট: আপত্তি গ্রহণ ও নিষ্পত্তি;

১৪ আগস্ট: চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ;

১৭–১৯ আগস্ট: মনোনয়নপত্র বিতরণ;

২১ ও ২৪–২৫ আগস্ট: মনোনয়নপত্র দাখিল;

২৭–২৮ আগস্ট: মনোনয়নপত্র বাছাই;

৩১ আগস্ট: প্রার্থীদের প্রাথমিক তালিকা প্রকাশ;

২ সেপ্টেম্বর: মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার;

৪ সেপ্টেম্বর: চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ;

১৫ সেপ্টেম্বর: ভোটগ্রহণ।

শিক্ষার্থীদের মতামত:
শিক্ষার্থীরা বলছেন, ৩৫ বছর পর এই ঐতিহাসিক প্ল্যাটফর্মটি পুনরায় চালু হওয়ায় গণতান্ত্রিক চর্চা বৃদ্ধি পাবে এবং ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরির পথ সুগম হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী মেহেদী সজীব বলেন, ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কেন্দ্রীয় প্ল্যাটফর্ম হিসেবে রাকসু কাজ করলেও এর একটি জাতীয় আবেদন রয়েছে। রাকসুর নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তিরা দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। রাকসু পুনরায় চালু হলে শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়, সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড এবং দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক নেতৃত্ব গঠনের ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখবে।’

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. ফরিদুল ইসলাম বলেন, ‘রাকসু ছিল এমন একটি প্ল্যাটফর্ম, যা তরুণদের চিন্তাভাবনা, বক্তৃতা ও নেতৃত্ব বিকাশের এক অনন্য ক্ষেত্র। রাকসুর নেতৃত্বে যারা ছিলেন, তারা পরবর্তীতে জাতীয় সংসদ, মন্ত্রিসভা কিংবা দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিজেদের দক্ষতা প্রমাণ করেছেন।’

তবে দীর্ঘ ৩৫ বছর রাকসু নির্বাচন না হওয়ায় শিক্ষার্থীরা নেতৃত্ব তৈরির এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছিলেন। এখনো অনেক শিক্ষার্থী রাকসুর নাম জানলেও এর গৌরবময় ইতিহাস সম্পর্কে অবগত নন। তাই আশা করা যাচ্ছে, সময়মতো ও সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন আয়োজন করা হলে রাকসু আবারও শিক্ষার্থীদের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হবে।

প্রতিনিধি/একেবি