বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক
৩০ জুলাই ২০২৫, ১২:১৩ পিএম
স্পিচ থেরাপি নিঃশব্দ প্রাণে শব্দ ফেরানোর এক আশ্চর্য জাদু। এটি শুধু কথা শেখায় না, শেখায় নিজেকে প্রকাশ করতে, অনুভব করাতে, ভালোবাসতে। যারা মুখে শব্দ আনতে পারে না, তাদের জন্য থেরাপি হয়ে ওঠে আলো জ্বালানোর মশাল। প্রতিটি অনুশীলন যেন জড়তা কাটিয়ে সাহস খুঁজে পাওয়ার নতুন এক সকাল। এটি ভাষাহীন পাখিকে শেখায় ডানার ভাষা—যে পাখি উড়তে শেখে আবেগের আকাশে। স্পিচ থেরাপি মানে শব্দের নদীতে প্রথম সাঁতার, যেখানে প্রতিটি উচ্চারণ হয় এক নতুন আশার ঢেউ। এটি নিঃশব্দ মনকে দেয় কণ্ঠস্বরের মুক্তি।
তেমনই এক আশ্চর্য যাদুকর সাবরিনা হোসেন তৃষা। তিনি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাকৃবি) অবস্থিত সিআরপি ময়মনসিংহ সেন্টারের স্পিচ অ্যান্ড ল্যাংগুয়েজ থেরাপিস্ট হিসেবে কর্মরত। তিনিই শুনিয়েছেন স্পিচ থেরাপির মাধ্যমে সুমি নামের এক নারীর মুখে ভাষা ফেরানোর গল্প।
৩৫ বছর বয়সী সুমির একসময় ছিল মুখভর্তি শব্দের কাব্য, হাসির রেশ আর জীবনের স্বাভাবিক সুর। কিন্তু হঠাৎ এক রাতে তার জীবনে নেমে আসে ভয়াবহ বিপর্যয়। ঘুমন্ত অবস্থায় তার বাড়িতে হামলা চালায় হায়েনার মতো একদল সন্ত্রাসী। সেই রাতের বিভৎসতা ও নির্মম আঘাতে সুমি মাথায় মারাত্মকভাবে আহত হন। সে আঘাত ছিল শুধু শারীরিক নয়, বরং তার জীবনের মূল প্রকাশভঙ্গি—বাকশক্তির উপর।
সেই রাতের পর সুমি আর আগের মতো ছিলেন না। ভাষার রঙিন জগৎ থেকে ছিটকে পড়ে যান নিঃশব্দতার অতলে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় তার অবস্থা ছিল গ্লোবাল অ্যাফেসিয়া, ওরো-ফ্যারিঞ্জিয়াল ডিসফ্যাজিয়া এবং ডিসলেক্সিয়া। অর্থাৎ তিনি আর কথা বলতে পারতেন না, গিলতে পারতেন না, এমনকি নিজের অনুভূতিও প্রকাশ করতে পারতেন না।
নিউরো-সার্জনের কঠিন রায় ছিল, ‘তুমি আর কখনো কথা বলতে পারবে না।’ সেই শব্দ যেন তার জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ ঘোষণা। চারপাশের আলো যেন নিভে গিয়েছিল, আকাশটা যেন তার ওপর ধসে পড়েছিল।
তবু সুমি হাল ছাড়েননি। আলোর ক্ষীণ রেখার মতো আশার নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছিলেন সিআরপি ময়মনসিংহ সেন্টারের স্পিচ অ্যান্ড ল্যাংগুয়েজ থেরাপিস্ট সাবরিনা হোসেন তৃষা। তিনি শুধু একজন থেরাপিস্ট ছিলেন না, ছিলেন সুমির নিঃশব্দ জীবনের কণ্ঠস্বর ফিরিয়ে আনার যোদ্ধা।
সাবরিনার তত্ত্বাবধানে শুরু হয় সুমির স্পিচ থেরাপি। ধৈর্য, নিষ্ঠা ও পেশাগত ভালোবাসা নিয়ে তিনি চালিয়ে যেতে থাকেন থেরাপিউটিক প্রটোকলগুলো। মাত্র তিন মাসে ১২টি সেশনেই ঘটে বিস্ময়কর এক পরিবর্তন। সুমি আবার মুখে শব্দ তুললেন—প্রথমে ছোট্ট শব্দ, তারপর বাক্য, তারপর গল্প। প্রতিটি উচ্চারণ ছিল জীবনের এক একটি বিজয়ের আহ্বান।
সাবরিনা বলেন, ‘আমি এই পেশা বেছে নিয়েছি কারণ এটি অনন্য ও নতুন। আমি মনে করি, একজন অনুসন্ধানপ্রবণ ব্যক্তি হিসেবে আমার দক্ষতা এই পেশার জন্য উপযুক্ত। আমি এতে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারি।’
তিনি আরও বলেন, ‘স্পিচ অ্যান্ড ল্যাংগুয়েজ থেরাপি বাংলাদেশে এখনও অনেকটাই অজানা একটি ক্ষেত্র। অথচ আমরা যে সমস্যাগুলোর চিকিৎসা করি—কথা বলা, গিলতে পারা, কণ্ঠস্বর—তা মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। দ্রুত থেরাপি শুরু করলে রোগী দ্রুত উন্নতি লাভ করেন।’
সুমির ফিরে আসা শুধু একটি ব্যক্তিগত পুনর্জন্মের গল্প নয়, বরং এটি এক অনুপ্রেরণার প্রতীক। তার জীবনের ছায়াঘেরা অধ্যায়ে স্পিচ থেরাপি হয়ে উঠেছে এক রৌদ্রোজ্জ্বল প্রভাত। তার কণ্ঠস্বর ফিরে পাওয়া যেন নিঃশব্দ পৃথিবীর মাঝে গান ফেরার মতো—এক নতুন জীবনের সূচনা।
সুমির গল্প আজ বাংলাদেশের বহু গ্লোবাল অ্যাফেসিয়া, ডিসফ্যাজিয়া কিংবা ডিসলেক্সিয়ায় আক্রান্ত রোগীর জন্য হয়ে উঠতে পারে আশার আলো। হয়তো এই গল্পই অনেককে সময়মতো চিকিৎসা নিতে অনুপ্রাণিত করবে, কিংবা অনেককে উদ্বুদ্ধ করবে এই পেশায় যুক্ত হয়ে বাকহীনদের কণ্ঠস্বর ফেরাতে।
প্রতিনিধি/একেবি