জেলা প্রতিনিধি
২৭ জুলাই ২০২৫, ১২:৩৬ পিএম
এক জীবন্ত সংগ্রামের নাম আশরাফ আলী। দিনাজপুরের বিরল উপজেলার খোপরা গ্রামের ৭৬ বছর বয়সী আশরাফ আলী—একজন বাবা, যিনি নিজের বয়সের ভার, দারিদ্র্য আর কষ্টকে উপেক্ষা করে লড়ে যাচ্ছেন দুই প্রতিবন্ধী সন্তানের জীবন টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে। জন্ম থেকেই চলাফেরায় অক্ষম দুই ছেলে মোকলেসুর রহমান (৪০) ও লাইসুর রহমান (৩৫)—তারই সন্তান।
এর মধ্যে বড় ছেলে মোকলেস ১১ মাস ধরে শয্যাশায়ী প্যারালাইজড। স্ত্রী শাহিনা বেগম মারা গেছেন ৩৩ বছর আগে। তখন থেকেই একাই সন্তানদের সেবা, যত্ন ও লালন-পালনের কঠিন দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন আশরাফ আলী।
শারীরিকভাবে অক্ষম দুই সন্তানের প্রতিদিনের খাওয়া, গোসল, ওষুধপত্র, সেবাসহ সকল দায়িত্ব আশরাফ আলীর কাঁধে। বয়সের ভারে নুয়ে পড়লেও সন্তানদের মুখে দু-মুঠো আহার তুলে দিতে তিনি এখনও সপ্তাহে তিন থেকে চার দিন দিনমজুরের কাজ করেন। সকালবেলা তাদের ঘরে রেখে কাজে যান, আর বিকেল গড়ালেই ছেলেরা পথ চেয়ে থাকে বাবার ফেরার অপেক্ষায়।
আশরাফ আলী বলেন, তাদের মা মারা যাওয়ার পর থেকে একাই সব দায়িত্ব পালন করছি। গোসল, খাওয়ানো, সবকিছু আমি করি। কাজও বেশি করতে পারি না, কারণ ওদের পাশে থাকতে হয়। সরকারি ভাতা আর যেটুকু আয় করি, তা দিয়ে কোনো রকমে বেঁচে আছি।
তিনি আরও বলেন, যদি কেউ একটা দুধের গাভী গরু আর কিছু খাদ্যসামগ্রী দিয়ে সাহায্য করতেন, তাহলে দুধ বিক্রি করে ছেলেদের নিয়ে একটু ভালোভাবে চলতে পারতাম।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, আশরাফ আলী ও তার ছেলেরা অমানবিক কষ্টে জীবনযাপন করছেন। এই পরিবারটির পাশে দাঁড়ানো প্রতিটি মানুষের নৈতিক দায়িত্ব। প্রতিবন্ধী দুই ভাইয়ের জন্য জীবনযাপন খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।
এই পরিবারটির খোঁজ মেলে সম্প্রতি এলাকায় একটি বেসরকারি সংগঠন ‘একজন বাংলাদেশ’ নামের মাঠকর্মী মুক্তা পারভীনের কাছ থেকে। বিষয়টি জানানো হলে মানবিক সহায়তায় এগিয়ে আসেন সমাজকর্মী মামুন বিশ্বাস।
মামুন বিশ্বাস বলেন, খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি তাদের বাড়িতে ছুটে যাই। মানবিক দায়িত্ববোধ থেকেই আমি তাদের পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেই। আমাদের একটি পোস্টের মাধ্যমে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা সংগ্রহ সম্ভব হয়। এ অর্থের মধ্যে ১ লাখ ২৬ হাজার ৮ শত টাকা দিয়ে একটি দুধেল গাভী কিনে দেওয়া হয়েছে এবং বাকি ৩ হাজার ২০০ টাকা নগদ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ওই পরিবারের প্রতিবন্ধী দুই ভাইয়ের জন্য প্রতি মাসে ২ হাজার ৫০০ টাকা করে নিয়মিত আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে।
তিনি আরও বলেন, এদের পাশে দাঁড়াতে পেরে আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি। শুধু আমি না—এলাকার সচেতন সমাজ, সরকার ও অন্যান্য সংস্থাও যদি এগিয়ে আসে, তাহলে হয়তো উন্নত চিকিৎসার মাধ্যমে এই দুই ভাইয়ের অবস্থারও কিছুটা উন্নতি ঘটতে পারে।
এই মানবিক গল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয়, মানবতা এখনও বেঁচে আছে—শুধু প্রয়োজন একটু সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দেওয়া।
প্রতিনিধি/ এজে