জেলা প্রতিনিধি
১২ জুলাই ২০২৫, ০৮:১৪ পিএম
ফেনীতে চলমান বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি হতে শুরু করেছে। গত সপ্তাহের সোমবার থেকে শুরু হওয়া ভারী বর্ষণ এবং ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের চাপে বন্যা রক্ষা বাঁধের ২১টি স্থানে ভাঙনে ফেনীতে আকস্মিক বন্যার সৃষ্টি হয়। বৃহস্পতিবার থেকে বৃষ্টিপাত কমতে থাকায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে শুরু করে। বন্যার পানি নেমে আসার পর রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি ও বিভিন্ন খামারে ক্ষয়ক্ষতির চিহ্ন দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে।
ইতোমধ্যে সরকারি বিভিন্ন দফতর প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতির একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছে। ওই প্রতিবেদনে শুধু পুকুর ভেসে ও বিভিন্ন মাছের খামারিদের ৮ কোটি ১৩ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার তথ্য উঠে এসেছে। এর বাইরে কৃষি বিভাগের সাড়ে ৫ হাজার হেক্টর ফসলি জমি পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রাণিসম্পদের প্রতিবেদনে মুরগি, গরু, ছাগল ও মহিষ মারা গিয়ে ৬৪ লাখ টাকার সম্পদহানি হওয়ার কথা বলা হয়েছে।
![]()
তবে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত বিভাগ বাড়িঘর ও রাস্তাঘাটের ক্ষয়ক্ষতির প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি। পানি গড়িয়ে রাস্তাঘাটের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। গ্রামীণ অনেক সড়ক থেকে পানি নামার পর বড় বড় গর্ত থাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে রয়েছে। অনেকেই বসতভিটা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে সহায়তার অপেক্ষার প্রহর গুনছেন।
জানা যায়, সোমবার (৭ জুলাই) বিকেল থেকে ফেনীতে ভারী বৃষ্টি হওয়ায় মঙ্গলবার থেকে ফেনীর বিভিন্ন স্থানে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। এর মাঝে ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের চাপে মুহুরি, কহুয়া ও সিলোনীয়া নদীর পানি বাড়তে থাকে। এক পর্যায় মঙ্গলবার রাতে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের কয়েকটি স্থান ভেঙে লোকালয় প্লাবিত হতে থাকে। সর্বশেষ ফুলগাজী ও পরশুরাম এলাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ২১টি স্থান ভেঙে দেড় ৪ উপজেলার দেড়শতাধিক গ্রাম পানির নিচে তলিয়ে যায়।
![]()
এসব এলাকার রাস্তাঘাট, বাড়িঘর, আসবাবপত্র, গবাদি পশুসহ সবকিছু বন্যার পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এক কাপড়ে মানুষ জেলার অর্ধশতাধিক আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে ওঠে। প্রশাসন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের ব্যক্তিরা বন্যা দুর্গতদের উদ্ধার কার্যক্রম, খাবার, পানীয় পৌঁছে দেওয়াসহ মানবিক সেবা প্রদান করে। বৃহস্পতিবার থেকে বৃষ্টিপাত কমতে থাকলে ফুলগাজী ও পরশুরামে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি শুরু হয়। তবে লোকালয়ে ঢুকে পড়া বন্যার পানি গড়িয়ে ছাগলনাইয়া ও ফেনী সদর উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন তলিয়ে দেয়।
![]()
শনিবার এ প্রতিবেদন প্রস্তুতকালে ফুলগাজী ও পরশুরামের মানুষ আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বাড়ি ঘরে ফেরা শুরু করলেও ফেনী সদর উপজেলা ও ছাগলনাইয়ার অনেক মানুষ এখনও আশ্রয় কেন্দ্র ছাড়তে পারেনি। এখনও জলাবদ্ধতায় ডুবে আছে এ দুই উপজেলার রাস্তাঘাট ও বাড়িঘর।
![]()
জেলা মৎস্য বিভাগ জানায়, অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ও বাঁধভাঙা পানিতে জেলার সব উপজেলা আক্রান্ত হয়েছে। বন্যার পানিতে জেলায় ২ হাজার ৩৩০টি পুকুর ডুবে অন্তত ৮ কোটি ১২ লাখ ৫০ হাজার টাকার মতো ক্ষয়ক্ষতির প্রাথমিক তথ্য উঠে এসেছে। তন্মধ্যে ৪ কোটি ৯০ লাখ টাকার মাছ ও ২ কোটি ৮১ লাখ টাকার মাছের পোনা বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। এর বাইরে প্রায় অর্ধকোটি টাকার খামারিদের অবকাঠামোর ক্ষতি হয়েছে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম বলেন, ভেসে যাওয়া পুকুরের তথ্য প্রস্তুত করে প্রতিবেদন ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে পাঠানো হয়েছে। এ বিষয়ে পরবর্তী নির্দেশনার আলোকে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
_20250712_201302119.jpeg)
এদিকে জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. মোজাম্মেল হক বলেন, গত কয়েকদিনের বয়ে যাওয়া বন্যায় জেলায় প্রায় ৬৫ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতির প্রাথমিক তথ্য উঠে এসেছে। ক্ষয়ক্ষতির মাঝে ৪টি গরু, ৩টি ছাগল, ১টি ভেড়া, সাড়ে ১০ হাজার বাণিজ্যিক মুরগি ও ২৩৫টি হাস মারা যাওয়া তথ্য পেয়েছি। এর বাইরে বন্যায় কবলিত হয়ে অন্তত ২০ হাজার গরু, মহিষ, ছাগলসহ গবাদি পশু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অবকাঠামোগত ক্ষতির পরিমাণও কম নয়। তিনি বলেন, এটি পূর্ণাঙ্গ ক্ষয়ক্ষতির চিত্র নয়। বন্যা এখনও শেষ হয়নি। দিনদিন এ ক্ষতির পরিমাণ আরও বড় হতে পারে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মাঠ পর্যায়ের তথ্যের আলোকে সাড়ে ৫ হাজার হেক্টর জমির ফসল পানিতে নিমজ্জিত উল্লেখ করে একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয় জেলায় চলমান বন্যায় ৮৪৫ হেক্টর আউশ আবাদ, ৫৩৭ হেক্টর গ্রীষ্মকালীন সবজি, ১৪ হেক্টর মরিচ, ৭ হেক্টর আদা, আড়াই হেক্টর হলুদ, ১১ একর টমেটো, ৬৮৯ হেক্টর বীজ তলা ও ৩৪৭০ হেক্টর বস্তায় আদা ফসল পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত কৃষি বিভাগ ক্ষয়ক্ষতির টাকার অঙ্ক নিরূপণ করতে পারেনি। পানি নেমে গেলেই চূড়ান্ত ক্ষয়ক্ষতির প্রতিবেদন প্রস্তুত করা যাবে বলে জানিয়েছেন কৃষি সম্প্রসারণ উপপরিচালক মোহাম্মদ আতিক উল্লাহ।
ফেনী জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম জানান, বন্যা এখনও শেষ হয়নি। কয়েকটি ডিপার্টমেন্ট প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতির একটি বিবরণী আমাদেরকে দিয়েছে। এটিকে আমরা চূড়ান্ত ভাবছি না। এখনও জেলায় অনেক এলাকা পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর চূড়ান্ত ক্ষয়ক্ষতির তথ্য হাতে পাব। দুর্গত এলাকায় পুনর্বাসনের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনার আলোকে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
প্রতিনিধি/এসএস