images

সারাদেশ

ফেনীতে এখনো বন্যার পানিতে নিমজ্জিত শতাধিক গ্রাম

জেলা প্রতিনিধি

১১ জুলাই ২০২৫, ১০:৪৪ পিএম

ভারী বৃষ্টিপাত ও ভারতের উজানের পানিতে বছর না পেরোতে ফের বন্যার কবলে পড়েছে ফেনীর পাঁচটি উপজেলা। মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ২১টি স্থান ভেঙে প্লাবিত হয়েছে একের পর এক জনপদ। বসতবাড়ি, রাস্তাঘাট তলিয়ে পানিবন্দি হয়ে পড়েন লাখো মানুষ। 

তবে জেলার সীমান্তবর্তী পরশুরাম ও ফুলগাজী উপজেলায় বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। অন্যদিকে নতুন করে প্লাবিত হচ্ছে ছাগলনাইয়া, ফেনী সদর ও দাগনভূঞা উপজেলার কিছু কিছু এলাকা। বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও এখন পর্যন্ত আতঙ্ক কাটেনি ফেনীর জনপদে। এখনো বন্যার পানিতে নিমজ্জিত জেলার ১১৪টি গ্রাম। 

Feni2

মোটবী ইউনিয়নের ইজ্জতপুর উচ্চ বিদ্যালয় আশ্রয় কেন্দ্রে রাতে ১৬টি পরিবারের ৫০ জন আশ্রয় নিয়েছেন বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন। প্লাবিত হয়েছে তিনটি উপজেলার ১১৪টি গ্রাম। ফেনীর ফুলগাজী ও পরশুরামের বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি হলেও অবনতি হচ্ছে জেলার সদর ও ছাগলনাইয়া উপজেলার। এখনো পানিবন্দি লক্ষাধিক মানুষ।

বন্যাদুর্গত এলাকায় কাজ করছে সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, স্থানীয় প্রশাসন ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। আর ভাঙা স্থান দিয়ে পানি প্রবেশ বন্ধ হলে দ্রুত বেড়িবাঁধ মেরামত করা হবে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।

Feni3

এদিকে বন্যার পানিতে মাছ ধরতে পাতানো কারেন্ট জাল তুলতে গিয়ে ফেনীর ফুলগাজীতে নুরুল আলম (৬২) নামের এক ব্যক্তির মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। বৃহস্পতিবার (১০ জুলাই) বিকেলে উপজেলার বন্দুয়া দৌলতপুর এলাকা থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। 

ফুলগাজী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহরিয়া ইসলাম এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন। নিহত আলম দৌলতপুর এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধা সাদেক কমান্ডারের ছেলে। 

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার ফজরের নামাজ শেষে নিজ বাড়ির পাশে বন্যার পানিতে পাতানো কারেন্ট জাল তুলতে যান নুরুল আলম। এ সময় অসাবধানতাবশত তার পা জালে আটকে যায়। সেখানেই আটকে ছটফট করে তার মৃত্যু হয়েছে।

Feni4

অন্যদিকে ফুলগাজী ও পরশুরামের পানি নামতে থাকায় আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বাড়ি ফিরছে মানুষ। তবে নতুন করে প্লাবিত হচ্ছে ফেনী সদর ও ছাগলনাইয়া উপজেলা বিভিন্ন ইউনিয়নের শতাধিক গ্রাম। এতে করে পানিতে তলিয়ে আছে মানুষের ঘরবাড়ি, আসবাবপত্র, ফসলি জমি, ভেসে গেছে শত শত পুকুরের মাছ। চরম ভোগান্তিতে স্থানীয় বাসিন্দারা।

স্থানীদের অভিযোগ, ২০২৪ সালের বন্যার ক্ষত কাটিয়ে উঠে না উঠতেই এবার আবার বন্যার কবলে পড়ে তারা নিঃস্ব হয়েছেন, আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তায় দিন পার করছেন। চারদিকে থই থই পানি, অন্যের বাড়ির ছাদে আশ্রয় নিলেও পোকামাকড় আর সাপের উপদ্রবে আতঙ্কে দিন পার করছেন বানভাসীরা।

Feni5

ফুলগাজী উপজেলা দৌলতপুর এলাকার বাসিন্দা জহিরুল ইসলাম বলেন, প্রায় এক সপ্তাহ পর আজ সূর্যের দেখা মিলেছে। বাড়িতে এখন হাঁটু সমান পানি রয়েছে। বৃষ্টি বন্ধ থাকলে দ্রুত পানি নামবে বলে আশা করছি। এখনো বাঁধের ভাঙন স্থান দিয়ে পানি প্রবেশ করছে। ফেনী-পরশুরাম আঞ্চলিক সড়কের কিছু কিছু স্থানে পানি থাকায় এখনো যানচলাচল স্বাভাবিক হয়নি। 

পরশুরামের পশ্চিম অলকার বাসিন্দা মোহাম্মদ মাসুম বলেন, বৃহস্পতিবার বিকেলে বাড়ি থেকে পানি নেমে গেছে। পানির তোড়ে বসতঘর পুরো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের দায়সারা কাজের কারণে প্রতিবছর আমাদের এতো দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে। মাঝেমধ্যে এমন পরিস্থিতির জন্য নিজের ভাগ্যকেই দায়ী করি।

Feni6

ফেনী সদর উপজেলার মোটবীর ইজ্জতপুর এলাকার বাসিন্দা রাশেদা আক্তার বলেন, বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে বাড়িতে পানি ঢুকতে শুরু করে। এখনো আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছি। প্রশাসনের লোকজন খাবারের জন্য জিনিসপত্র দিয়ে গেছে।

অপরদিকে বন্যাদুর্গত এলাকায় আটকে পড়া পানিবন্দি মানুষদের উদ্ধার তৎপরতা ও রান্না করা খাবার এবং তাদের ত্রাণ সহায়তায় সম্মিলিতভাবে কাজ করে যাচ্ছেন সেনা, বিজিবি ও পুলিশ সদস্যরা। সামরিক-বেসামরিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন উদ্ধার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। বানভাসী মানুষ ত্রাণ সহায়তা চান না। তারা চান, প্রতিবছর বন্যার ধ্বংসলীলা থেকে বাঁচতে টেকসই বাঁধ নির্মাণ করা হোক। তারা টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে স্থায়ী সমাধান চান।

F7

জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, ফেনীর বন্যাকবলিত পরশুরাম, ফুলগাজী, ছাগলনাইয়া (আংশিক), ফেনী সদর (আংশিক) ও দাগনভূঞা (আংশিক) উপজেলার ১১৪টি গ্রামের জনগণের দুর্ভোগ কমাতে সকল অংশীজনের সহযোগিতায় কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। ইতোপূর্বে ঘোষিত আশ্রয় কেন্দ্রগুলোর মধ্যে ৮২টি আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় ৯ হাজার ২০০ মানুষ অবস্থান করছেন। তাদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে। 

পরশুরাম ও ফুলগাজী উপজেলায় দুর্যোগে সবচেয়ে নাজুক গর্ভবতী নারী ও অসুস্থ ১৮ জনকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও স্বেচ্ছাসেবকদের সহযোগিতায় উদ্ধার করা হয়েছে।

F8

ফেনী আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মজিবুর রহমান বলেন, জেলায় টানা চার দিন ধরে মাঝারি ও ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত ছিল। তবে আজ সূর্যের দেখা মিলেছে। সকাল ৯টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় জেলায় ২৮ দশমিক ৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। 

ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আক্তার হোসেন মজুমদার বলেন বলেন, পরশুরাম, ফুলগাজী অংশে নদীর পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হলেও ছাগলনাইয়া ও ফেনী সদর অংশে পানি অনেক বাড়ছে। বাঁধের ভাঙনের স্থান দিয়ে এখনো পানি ঢুকছে। পানি কমার পরেই বাঁধ মেরামতের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

F9

এ ব্যাপারে ফেনীর জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম বলেন, জেলা-উপজেলা পর্যায়ে খাদ্য ও প্রয়োজনীয় সামগ্রীর পর্যাপ্ত বরাদ্দ ও মজুদ রয়েছে। বিদ্যুৎ সরবরাহ, মোবাইল নেটওয়ার্ক সচল রাখতে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড ও মোবাইল নেটওয়ার্ক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ করা হচ্ছে। জনগণের নিরাপত্তায় বন্যাকবলিত কিছু এলাকায় সাময়িকভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছে।

এর আগে ৭ জুলাই থেকে টানা বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে মুহুরী নদীর উভয় তীরে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে পরশুরাম উপজেলায় ৭টি স্থানে ও ফুলগাজী উপজেলায় তিনটি, মোট ১০টি স্থানে ভাঙনের সৃষ্টি হয়, পরে তা ২১টিতে পরিণত হয়। 

এএইচ