৩০ জুন ২০২৫, ০৯:৩৬ এএম
পিচঢালা পথের দুই পাশে সারি সারি গাছ। ডানে-বাঁয়ে ফসলি জমি, ঝোপঝাড় এঁকেবেঁকে এগিয়ে গেছে দিগন্তে। দূরে সবুজ টিলার ওপর দাঁড়িয়ে সুবিশাল বট কিংবা অশ্বত্থের মতো গাছ। কাছে যেতেই চোখ পরে সেই সূর্যপুরী আমগাছ। ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার হরিণমারী মন্ডুমালা গ্রামে মাটি আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে ঐতিহাসিক সূর্যপুরী আমগাছটি।

কিন্তু একটি আমগাছ দেখতে যদি আপনাকে টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকতে হয়? শুনে অবাক লাগলেও সূর্যপুরী আমগাছকে দেখতে এখন ভিড় করছেন শত শত মানুষ—টিকিট কেটে দেখছেন। যা শুধু বালিয়াডাঙ্গী বা ঠাকুরগাঁও নয়, সমগ্র এশিয়ায় ‘লতা’ বা প্রশস্ত শাখাযুক্ত এই জাতের একটি গজবৃক্ষ।

স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, ঐতিহাসিক এই গাছের বয়স প্রায় ২০০ বছর। আজ অবধি গাছটি শুধু বেঁচে আছে তাই নয়, বরং প্রতি বছর ফলন দিয়েও মুগ্ধ করছে এলাকাবাসী ও দর্শনার্থীদের।

দুই বিঘা জমির উপরে বিস্তৃত গাছটির উচ্চতা প্রায় ৯০ ফুট। উঁচু এই গাছটির শাখাগুলো মাটির দিকে নেমে আবার উঠে গেছে। গাছটির ছায়ায় ঢোকার পর যেন এক প্রাকৃতিক ছাউনি, এক অন্যরকম আবহ। তার ডালপালা এতটাই বিস্তৃত যে নিচে দাঁড়িয়ে পুরোটা এক ফ্রেমে ধরাও দায়।

গাছটির শাখা চওড়াই প্রায় ৩৫ ফুট। এতে প্রায় ১৯টি মোটা ডাল, প্রত্যেকের দৈর্ঘ্য ৪০‑৫০ ফুট, যা মাটির দিকে ঝুঁকে আবার উঠছে—দেখতে যেন ‘অক্টোপাস’ এর মতো।

এই গাছের সূর্যপুরী আম স্বাদে অতুলনীয়। স্থানীয়রা বলছেন, এর অনন্য স্বাদ, ঘ্রাণ ও মিষ্টতা আজকের বাজারজাত সূর্যপুরীর তুলনায় ‘অপরিমেয়’ সরস ও ঘন। এছাড়া, এই গাছের আমগুলো বাজারে সাধারণ সূর্যপুরীর দামে পাওয়া যায় না—প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকার কারণে দাম দ্বিগুণ পর্যন্ত বাড়ে।

প্রতি বছর এটি ১০০‑২০০ মণ ফল দেয় এবং প্রতিটি আমের ওজন দাঁড়ায় ২০০‑২৫০ গ্রাম। যা প্রতি কেজি এবার ১০০ টাকা দরে বিক্রি করা হচ্ছে বলে জানান গাছ লিজ নেওয়া ব্যক্তি মো. সাদেকুল ইসলাম।

তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, ২০২৩ সালে তিন বছরের জন্য ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা গাছটি আমি লিজ নিয়েছি। এতে প্রথম বছরেই আমি দেড় লাখ টাকা আম বিক্রি করেছি। পরের বছরে ১ লাখ টাকার আম বিক্রি করেছি। এবছর আশা করছি ২ লাখ থেকে আড়াই লাখ টাকার আম বিক্রি করতে পারবো। আর এ গাছের আম আমাদের বাজারে বিক্রি করতে যেতে হয় না। এখান থেকেই আম মানুষ কিনে নিয়ে যায়।

পর্যটকের ভিড়, গাছের নিরাপত্তা এবং পরিচর্যার জন্য প্রতিটি দর্শনার্থীর কাছ থেকে নেওয়া হয় মাত্র ২০ টাকা করে টিকিট। এই টাকায় গাছের চারপাশে বেড়া, পরিচ্ছন্নতা রক্ষা এবং বসার ব্যবস্থাও করা হয়েছে। স্থানীয় মো. সাইদুর মোল্লা ও মো. নূর ইসলাম এই গাছের দেখভাল করছেন পারিবারিকভাবে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে।

জেলা ও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এবংকি বিদেশ থেকেও অনেক মানুষ আসেন এই গাছটি দেখতে।

হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর থেকে এসেছিলেন মো. ফয়েজ উদ্দিন। তিনি বলেন, আসলে নিজের চোখে না দেখলে গাছটি কল্পনাও করা যাবে না। আমি গাছটি দেখে আশ্চর্য হয়েছি যে, পৃথিবীতে এতো বড় ও এমন আমগাছ হতে পারে।

দিনাজপুর জেলার চিরির বন্দর থেকে পরিবার সহ গাছটি দেখতে এসেছিলেন সাবরিনা। তিনি বলেন, আগে কখনোই এমন গাছ দেখা হয়নি। জীবনের এই প্রথম এতো বড় আমগাছ দেখলাম। দেখে আমি অভিভূত ও এখানে এসে সরাসরি দেখতে পেরে খুব ভালো লাগছে।

অনেকেই মনে করেন, এই গাছকে ঘিরে গড়ে তোলা যেতে পারে একটি পর্যটন কেন্দ্র। এখানে আসা দর্শনার্থীরা শুধু গাছটি নয়, এর ঐতিহাসিক পটভূমি, পরিবেশ এবং সংস্কৃতিকে উপলব্ধি করতে পারেন। স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতা পেলে জায়গাটি হতে পারে শিক্ষা ও ঐতিহ্যের এক অনন্য মডেল।

বর্তমান মালিক— মো. সাইদুর মোল্লা ও মো. নূর ইসলাম দুই ভাই—গাছের চারপাশ বেড়া, তথ্যফলক ও পিকনিক স্পট গড়ে তুলছেন। তারা চান, ভবিষ্যতে পর্যটন ও পরিবেশবান্ধব বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে।

গাছ মালিক মো. নূর ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, আমগাছটি আমার বাবার দাদা লাগিয়েছে। আনুমানিক প্রায় ২২০ বছর আগে। ২০ টাকা টিকিট মূল্যের বিনিময়ে গাছটি দেখতে পারে যে কেউ। আর এখান থেকে যা আয় হয় তা দিয়ে আমাদের দুই ভাইয়ের মোট ১১ জন সদস্যের সংসার চলে। ভবিষ্যতে এখানে পর্যটন ও পরিবেশবান্ধব বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে চাই আমরা।

বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পলাশ কুমার দেবনাথ ঢাকা মেইলকে বলেন, এই ঐতিহ্যবাহী আম গাছটি ব্যক্তি মালিকানাধীন। তাই মালিক পক্ষ সরকারিভাবে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করতে না দিলে তো আমাদের কিছু করার থাকে না। তার পরেও আমরা সেখানে সরকারি খাসজমিতে দর্শনার্থীদের জন্য একটি রেস্ট হাউস করা হয়েছে। যেন দূরদূরান্ত থেকে আসা মানুষরা সেখানে বিশ্রাম নিতে পারেন।

গাছটি শুধু জেলার বা উপজেলার একটি ঐতিহ্য নয়, বরং এটি বাংলাদেশের ঐতিহ্য। তাই এই ঐতিহাসিক গাছটি দীর্ঘকাল টিকিয়ে রাখতে রাষ্ট্রীয়ভাবে বা সরকারি কোনো উদ্যোগ গ্রহণের বিষয়ে তিনি আরও বলেন, গাছটি সংরক্ষণে বা রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে জমি অধিগ্রহণ করার চিন্তাভাবনা আছে। এটি আমরা ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে পরামর্শ করে উদ্যোগ গ্রহণ করব। এছাড়াও এই গাছটির সূর্যপুরী আম জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধন করার জন্য কার্যক্রম চলছে। আমরা আশা করি যারা এখানে দেশ বা বিদেশ থেকে গাছটি দেখতে আসবে তারা যেন সুন্দর ও শৃঙ্খলা ভাবে দেখে পারে। সে ব্যাপারে জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা থাকবে।

এই গাছটি কেবলই একটি আমগাছ নয়—এটি একাধারে ঐতিহ্য, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, বৈজ্ঞানিক কৌতূহল এবং মানবিক অনুভূতির প্রতীক। এর ছায়া ও সম্ভার আগামী প্রজন্মকে টানে ইতিহাসের দিকে তাকাতে। সূর্যপুরী আমগাছটি এই অঞ্চলের জাতীয় দিগন্তে কেবল একটি গাছের নাম নয়; এটি হয়ে থাকবে মননে উদ্দীপনা, পরিবেশে সংগঠন, আর গবেষণায় প্রেরণার নতুন অধ্যায়।

যাকে দেখতে মানুষ টিকিট কাটে—এটা শুধু বিস্ময়ের নয়, গর্বেরও। এই গাছ শুধু ফল দেয় না, ইতিহাসও বয়ে নিয়ে চলে। ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গীর এই সূর্যপুরী আমগাছ তাই শুধু একটি বৃক্ষ নয়—একটি জীবন, একটি যাত্রা, একটি জীবন্ত ইতিহাস।
প্রতিনিধি/এজে