জেলা প্রতিনিধি
২৮ জুন ২০২৫, ১১:৩০ এএম
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত বরগুনা জেলা একদিকে যেমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ, অন্যদিকে তেমনি সম্ভাবনাময় কৃষি, মৎস্য এবং পর্যটনে। বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষা এ জেলাটি দীর্ঘদিন ধরেই নদীমাতৃক সংস্কৃতি ও জীবিকার এক অনন্য কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত।

বরগুনা জেলার আয়তন প্রায় ১,৯৩৯.৩৯ বর্গকিলোমিটার। উত্তরে ঝালকাঠি, বরিশাল, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পূর্বে পটুয়াখালী এবং পশ্চিমে পিরোজপুর ও বাগেরহাট জেলা অবস্থিত। এ জেলার প্রশাসনিক কাঠামোতে রয়েছে ৬টি উপজেলা—বরগুনা সদর, আমতলী, তালতলী, বামনা, পাথরঘাটা ও বেতাগী। ইউনিয়নের সংখ্যা ৩৮টি এবং পৌরসভা রয়েছে ৪টি।

জেলার বুক চিরে বয়ে গেছে বহু নদী ও খাল। প্রধান নদীগুলোর মধ্যে পায়রা, বিষখালী, বুড়িগৌরাঙ্গ ও বলেশ্বর অন্যতম। এসব নদীই বরগুনার জীবনযাত্রা, কৃষিকাজ, নৌপথ এবং পরিবেশ ব্যবস্থার মূল চালিকা শক্তি। শহরের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া ছোট ছোট নদী ও খাল বরগুনাকে এক অনন্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সাজিয়েছে।

বরগুনার প্রধান অর্থনৈতিক ভিত্তি কৃষি ও মৎস্য। ধান, আলু, পেঁয়াজ, রসুন, মুগডালসহ বিভিন্ন সবজি চাষ এখানে জনপ্রিয়। বঙ্গোপসাগরের নিকটবর্তী হওয়ায় জেলার আমতলী, তালতলী ও পাথরঘাটা উপজেলায় মাছ ধরা, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিপণন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এখানে রয়েছে বেশ কিছু ফিশারিজ হ্যাচারি ও বরফকল।

শিক্ষাক্ষেত্রে বরগুনা ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছে। জেলার মধ্যে রয়েছে বরগুনা সরকারি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়, বরগুনা সরকারি মহিলা কলেজ, বরগুনা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, পাথরঘাটা কলেজ, আমতলী ডিগ্রি কলেজ, ইটবাড়িয়া কদমতলা কলেজ, খাজুরতলা মডেল কলেজ, বরগুনা দারুল উলুম নেছারিয়া কামিল মডেল মাদরাসা, খাকবুনিয়া মাদ্রাসা, চরকগাছিয়া ফাজিল ডিগ্রি মাদরাসা, বরগুনা সরকারি বালিকা বিদ্যালয় এবং বরগুনা জিলা স্কুল। এছাড়া টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ বেসরকারি অক্সফোর্ড স্কুল, সানবীম কিন্ডারগার্টেন, এভারগ্রীণ পাবলিক মডেল স্কুল এন্ড কলেজ, কদমতলা কিন্ডারগার্টেন, নিরালা স্কুল, সহ জেলার সকল উপজেলা এগুলোতে সরকারি- বেসরকারি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সহ বেশ কিছু কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তরুণদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে।

জেলার স্বাস্থ্যব্যবস্থার কেন্দ্র বিন্দু হলো বরগুনা সদর হাসপাতাল। এছাড়াও প্রতিটি উপজেলায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং গ্রামে গ্রামে রয়েছে কমিউনিটি ক্লিনিক। যদিও আধুনিক যন্ত্রপাতি ও পর্যাপ্ত চিকিৎসক সংকট এখানকার অন্যতম চ্যালেঞ্জ।

পর্যটনের দিক থেকেও বরগুনা পিছিয়ে নেই। এখানে রয়েছে গোড়াপদ্মা পর্যটন কেন্দ্র, গোলবুনিয়া পর্যটন কেন্দ্র, মিয়াবাড়ি পর্যটন কেন্দ্র,শুভসন্ধ্যা পর্যটন কেন্দ্র, টেংরাগিরি ইকোপার্ক, হরিণঘাটা বন ও পর্যটন কেন্দ্র, লালদিয়া বন, মোহনা পর্যটন এলাকা ইত্যাদি। ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে উঠেছে শিশু বিনোদন কেন্দ্র, পিকনিক ও শুটিং স্পোর্ট, ‘সুরঞ্জনা ইকোপার্ক’ পর্যটন কেন্দ্র, এবং শহরের পার্শ্ববর্তী শিশু বিনোদন কেন্দ্র ‘ফান ওয়ার্ল্ড’। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন বিবিচিনি শাহী মসজিদ এখানকার ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রতীক। উপকূলজুড়ে বিস্তৃত বালুকাবেলা ও লোনা হাওয়ার হাতছানিতে এখানে ঘুরতে আসা পর্যটকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তবে যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ থাকায় দ্বিতীয়বার মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন পর্যটকরা।

তবে সবকিছুর মাঝেও বরগুনার সবচেয়ে বড় শক্তি এখানকার মানুষ। পরিশ্রমী, আত্মনির্ভরশীল এবং সংস্কৃতিমনা এই জনগোষ্ঠী প্রতিকূলতা পেরিয়ে নিজেদের ভাগ্য গড়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।

সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বরগুনা এখন উন্নয়নের পথে। নদীভাঙনরোধ, অবকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় যে পরিবর্তন সূচিত হচ্ছে, তা আগামীতে বরগুনাকে একটি পূর্ণাঙ্গ সম্ভাবনার জেলায় পরিণত করবে এমনটাই প্রত্যাশা স্থানীয়দের।

বরগুনা শুধু একটি উপকূলীয় জেলা নয় — এটি সম্ভাবনার নাম, প্রকৃতির ছায়াঘেরা এক জীবন্ত চিত্র। সঠিক পরিকল্পনা ও নাগরিক উদ্যোগ থাকলে বরগুনা হয়ে উঠতে পারে দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়নের রোল মডেল।
প্রতিনিধি/এজে