নিজস্ব প্রতিবেদক
২১ মে ২০২৫, ০৫:৪৫ পিএম
দেশে স্টুডেন্টস হেলথ কার্ড কার্যক্রমের প্রথম যাত্রা শুরু হলো চট্টগ্রামে। প্রাথমিক পর্যায়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) পরিচালিত ৫টি বিদ্যালয়ে এ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। শিক্ষার্থীদের অভিভাবক ও চিকিৎসকদের মতে, এটি চসিকের এক অনন্য উদ্যোগ।
বুধবার (২১ মে) দুপুরে চট্টগ্রাম মহানগরের কাপাসগোলা সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে এ কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন চসিক মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন।
উদ্বোধনী বক্তৃতায় মেয়র বলেন, শিশুদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা শুধু অভিভাবকের দায়িত্ব নয়, প্রতিষ্ঠান এবং সিটি করপোরেশনকেও সে দায়িত্ব নিতে হবে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে শুধু স্বাস্থ্য নয়, শিক্ষার্থীদের মধ্যে পরিচ্ছন্নতা, স্বাস্থ্যবিধি এবং দায়িত্ববোধের মতো মূল্যবোধ গড়ে তোলা সম্ভব হবে। ‘ক্লিন, গ্রিন ও হেলদি চট্টগ্রাম’ বাস্তবায়নে এ কর্মসূচি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হবে।
মেয়র আরও বলেন, হেলথ কার্ডের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, টিকাদান এবং চিকিৎসাসংক্রান্ত তথ্য সংরক্ষণ করা যাবে। কার্ডে শিক্ষার্থীর নাম, জন্মতারিখ, বিদ্যালয়ের নাম, শ্রেণি, অভিভাবকের নাম ও যোগাযোগের তথ্য সংরক্ষণের সুযোগ থাকবে। ৫ থেকে ১৭ বছর বয়স পর্যন্ত সর্বমোট ১৪ বার স্বাস্থ্য পরীক্ষার রেকর্ড রাখা যাবে। প্রতি পরীক্ষায় ওজন, উচ্চতা, চোখ-কান, দাঁত, ত্বক-চুলের অবস্থা, রক্তচাপ ও হিমোগ্লোবিনসহ প্রয়োজনীয় তথ্য অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
কার্ডে একটি পৃথক অংশে টিকাদান সংক্রান্ত তথ্য সংরক্ষণের ব্যবস্থাও থাকবে। এতে বিসিজি, পোলিও, হেপাটাইটিস-বি, এমআর, পেন্টাভ্যালেন্ট, টাইফয়েড, ইনফ্লুয়েঞ্জা ও র্যাবিসসহ গুরুত্বপূর্ণ টিকার রেকর্ড রাখা যাবে। এর মাধ্যমে একটি সুস্থ ও সচেতন প্রজন্ম গড়ে তোলা সম্ভব হবে।
মেয়র আশা প্রকাশ করেন, চট্টগ্রামের এই মডেল ভবিষ্যতে দেশের অন্যান্য সিটি করপোরেশন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও অনুসরণীয় হবে। এই প্রকল্পের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টাকেও অবহিত করা হয়েছে এবং তিনি এই উদ্যোগের প্রশংসা করেছেন।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম। মুখ্য আলোচক ছিলেন শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডা. প্রণব কুমার চৌধুরী। সম্মানিত আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর ইলিয়াছ উদ্দিন আহম্মদ।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন চসিকের প্রধান শিক্ষা কর্মকর্তা ড. কিসিঞ্জার চাকমা। তিনি বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সুপারিশ অনুযায়ী, বিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যকর আচরণে উদ্বুদ্ধ করা, দৈহিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য বিশেষ সুযোগ সৃষ্টি এবং বিদ্যালয়ভিত্তিক রোগতত্ত্ব গবেষণা সাপেক্ষে একটি কার্যকর স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত জরুরি।
তিনি আরও বলেন, স্কুলশিক্ষার মতোই ‘স্কুল হেলথ’ শিক্ষার্থীদের মৌলিক অধিকার। “নীরোগ দেহ, নির্মল মন”—একজন সুস্থ শিশুই পারে শ্রেষ্ঠ শিক্ষার্থী হয়ে উঠতে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা পরিকাঠামো বিস্তৃত ও শক্তিশালী। বহুদিন ধরেই শিশুস্বাস্থ্যবিষয়ক এমন একটি সমন্বিত উদ্যোগের বাস্তবায়ন দেখার প্রত্যাশা ছিল, যা এবার চসিকের চিকিৎসক মেয়রের হাত ধরে বাস্তবায়িত হলো। এটি একটি অনন্য, কল্যাণকর পদক্ষেপ।
মুখ্য আলোচক প্রফেসর ডা. প্রণব কুমার চৌধুরী বলেন, শিক্ষার্থীদের সুস্বাস্থ্য মানেই স্বাস্থ্যসম্মত স্কুল পরিবেশ। বিদ্যালয়গামী শিশুরা সমাজের প্রায় ২৫% অংশ। এই বয়সে শারীরিক বৃদ্ধির পাশাপাশি মানসিক বিকাশ ঘটে। পরিবেশ দূষণ, সুষম খাদ্য ও পুষ্টির অভাব, সংক্রামক ব্যাধির আক্রমণ—এই বয়সে এসব সমস্যার প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে।
তাই বিদ্যালয়ে বিশুদ্ধ পানীয় জল, উন্নত স্যানিটেশন ব্যবস্থা, স্বাস্থ্যবিধি পালন, নিরাপদ খেলার মাঠ ও পরিচ্ছন্ন টিফিন রুম থাকা উচিত। একই জায়গায় একত্রে অবস্থানের কারণে স্কুলশিশুদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা তুলনামূলকভাবে সহজ। নিয়মিত স্বাস্থ্যপর্যবেক্ষণ, অপুষ্টি প্রতিরোধ, শারীরিক ও মানসিক অসংগতি আগেভাগে শনাক্তকরণ ও প্রয়োজনীয় ফলো-আপ চিকিৎসার ব্যবস্থা স্কুলেই রাখা সম্ভব।
তিনি বলেন, প্রতিটি পাঁচজন শিক্ষার্থীর মধ্যে একজন কোনো না কোনো স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগে। স্কুল ক্লিনিকের মাধ্যমে শিশুদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও প্রয়োজন হলে ল্যাব টেস্ট করিয়ে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব, যা ভবিষ্যতের জটিলতা থেকে রক্ষা করতে সহায়ক হবে।
শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়জীবনে নতুন অনেক কিছু শেখে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের মাধ্যমে তাদের হাইজিন, খাদ্যাভ্যাস, ঘুম ইত্যাদি স্বাস্থ্যকর জীবনাচরণে অভ্যস্ত করা যায়। এই শিক্ষাগুলো ভবিষ্যতে পরিবার ও সমাজে প্রয়োগ করে তারা একটি স্বাস্থ্যসচেতন সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখতে পারে।
তিনি আরও বলেন, দেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে প্রায় ৩ কোটি ৭০ লাখ শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত। প্রত্যাশা করি, দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্যয়সাশ্রয়ী ও অনুপ্রেরণাদায়ক এ ধরনের প্রকল্প হাতে নেবে।
কাপাসগোলা সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশাপাশি যেসব বিদ্যালয়ে স্টুডেন্টস হেলথ কার্ড চালু হয়েছে সেগুলো হলো—পাথরঘাটা সিটি করপোরেশন বালক উচ্চ বিদ্যালয়, গুল এজার বেগম সিটি করপোরেশন উচ্চ বিদ্যালয়, ইমারাতুন্নেসা কিন্ডারগার্টেন এবং পাঁচলাইশ কিন্ডারগার্টেন।
প্রতিনিধি/একেবি