images

সারাদেশ

বংশ পরম্পরায় জেলে পেশা, বদলায়নি ভাগ্য

০৫ মে ২০২৫, ০৪:৪৫ পিএম

জেলেদের জীবন এখনো আধুনিকতার ছোঁয়া থেকে অনেকটাই দূরে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসে যে সংগ্রামী জীবনের চিত্র আঁকা হয়েছে, তা আজও বাস্তবতা থেকে আলাদা হয়নি। সময় বদলালেও পরিবর্তন আসেনি জেলেদের জীবনে। তাই বংশানুক্রমে পরবর্তী প্রজন্মও তাদের পূর্বপুরুষদের এই সংগ্রামী জীবনকেই বেছে নিচ্ছে।

মাছ ধরে আর্থিক অবস্থা পরিবর্তন করতে পেরেছেন—এমন জেলে খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন। জীবনটা যেন একই বৃত্তে আবর্তিত হচ্ছে—জাল ফেলো, মাছ ধরো, ঘাটে বিক্রি করো, ঋণ শোধ করো। আবার নতুন করে দিন শুরু করো। দারিদ্র্য, অনিশ্চয়তা আর জীবন সংগ্রামে ক্লান্ত এ জনগোষ্ঠীর ভাগ্যে নেই পরিবর্তনের ছোঁয়া। সুখের দিন খুব কম, দুঃখের দিনই যেন নিয়তি। অনেকেই দেনার ভারে জর্জরিত হয়ে এই পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। কেউ কেউ আবার মাছ ধরতে গিয়ে পঙ্গু হয়ে গেছেন, কেউবা সর্বস্ব হারিয়ে পথে বসেছেন।

পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর উপজেলার কুমারখালী গ্রামের জেলে ওমর আলী মোল্লার বয়স প্রায় ৭০ বছর। তিনি ১০-১২ বছর বয়স থেকেই মাছ ধরছেন। সারা জীবন অন্যের নৌকায় মাছ ধরে কাটিয়ে দিয়েছেন। তাঁর ছেলেরাও একই পথে হাঁটছে—ছোটবেলা থেকেই অন্যের নৌকায় মাছ ধরছে জীবিকার প্রয়োজনে।

ওমর আলী মোল্লা বলেন, ‘যা রোজগার হয়, তা দিয়েই সংসার চলে। কিছুই হাতে থাকে না। বেশি মাছ পেলে ভালো খেতে পারি, না হলে কষ্ট হয়। অভিযান চললে তো মাছ ধরা একদম বন্ধ থাকে, তখন অবস্থা আরও খারাপ হয়।’

পিরোজপুর সদর উপজেলার চিথলীয়া গ্রামের জেলে মোবারেক হাওলাদার মাত্র নয় মাস বয়সে বাবাকে হারান। মায়ের সঙ্গে দারিদ্র্যের মধ্যেই বড় হয়েছেন। মাত্র ১২ বছর বয়সে সাগরে মাছ ধরতে যান। টানা ৪০ বছর ধরে এই পেশায় আছেন।

তাঁর সংসার আজও সচ্ছল নয়। ‘সাগরে মাছ ধরা বন্ধ থাকলে সংসার চালানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। তখন মানবেতর জীবন কাটাতে হয়,’—বললেন মোবারেক হাওলাদার।

৫০ বছর ধরে সাগরে মাছ ধরছেন সৈয়দ আলী মিস্ত্রি। তাঁর বয়স এখন প্রায় ৬৫। বাবা-দাদার পেশা ধরে রেখেছেন তিনিও। জীবনে কয়েকবার অন্য পেশায় যেতে চাইলেও পারেননি—কারণ অন্য কোনো কাজ শিখেননি।

কুমারখালী গ্রামের আরও জেলে যেমন আনোয়ার হোসেন মোল্লা (৫০), ইউসুফ মোল্লা (৩৮)—তাঁরাও বংশানুক্রমিকভাবে একই পেশায় রয়েছেন।

চিথলীয়া গ্রামের জেলে মো. সুলতান পশারী বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞা চলাকালীন সময় বেকার থাকতে হয়। সরকার যে চাল দেয় তা দিয়ে চলে না। ঋণ করে সংসার চালাতে হয়। আর কতদিন এভাবে এনজিওর ঋণে চলব?’

একই গ্রামের আরেক জেলে মো. আজিজুল পশারী বলেন, ‘মাছ ধরা আমাদের একমাত্র পেশা। অন্য কোনো কাজ পারি না। নিষেধাজ্ঞা চললে এনজিও থেকে আবার ঋণ নিতে হয়। ঋণের বোঝা দিনদিন বেড়েই চলেছে। কীভাবে শোধ করব, বুঝতে পারি না।’

শুধু মোবারেক, আজিজুল, সুলতান, আনোয়ার, সৈয়দ আলী বা ওমর আলী মোল্লা নয়—এই চিত্রই পিরোজপুর জেলার সাতটি উপজেলার হাজার হাজার জেলে পরিবারের বাস্তবতা। একমাত্র পেশা হিসেবে মাছ ধরা বেছে নেওয়ায় তাঁদের জীবনে অভাব-অনটন লেগেই থাকে।

চিথলীয়া গ্রামের মোবারেক হাওলাদারের স্ত্রী আছিয়া বেগম বলেন, ‘মাছ ধরে যা আয় হয়, তা দিয়ে সংসার চালাতেই হিমশিম খেতে হয়। পাঁচ মেয়ের চারজনকে ঋণ করে বিয়ে দিয়েছি। এখন তিন ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে সংসার চলছে। প্রতি সপ্তাহে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হয়।’

নাজিরপুর উপজেলার মালীখালী গ্রামের রাজবংশী পাড়ার বৃদ্ধ ধীরেন মন্ডল (৭০) বলেন, ‘বাপ-দাদার পেশাই আমার পেশা ছিল। নিজে কোনো পরিবর্তন আনতে পারিনি, তাতে দুঃখ নেই; কিন্তু ছেলে এখনো একই পেশায়, এটিই সবচেয়ে কষ্টের।’

তাঁর ছেলে প্রতুল মন্ডল (৪০) বলেন, ‘স্কুলে নামমাত্র পড়েছি। ছোট থেকেই মাছ ধরছি। অন্য কোনো কাজ পারি না। আগের মতো মাছও পাওয়া যায় না—এখন সংসার চালাতে খুব কষ্ট হয়।’

জেলেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, ঝড়-তুফান উপেক্ষা করে সাগরে মাছ ধরে দেশের কোটি মানুষের আমিষের জোগান দেন। অথচ তাঁদের জীবন কেমন—তা নীতিনির্ধারকদের নজরে পড়ে বলেই মনে হয় না—এমনটাই দাবি সচেতন মহলের।

কয়েক শত জেলে পরিবারের দাবি—একটা ঋণমুক্ত, ধান্ধামুক্ত, স্বচ্ছল জীবন।

প্রতিনিধি/একেবি