images

সারাদেশ

ঢাক-ঢোল পিঠিয়ে অভিযান, দু’দিন পর ফের চালু অবৈধ ইটভাটা

জেলা প্রতিনিধি

০১ মে ২০২৫, ০৫:০৩ পিএম

ভাটাগুলো অবৈধ। এর পরও চলছে ইট প্রস্তুতকরণ। শুধু আগে ছিল লম্বা ইট সিমেন্টের চিমনি, আর এখন চিমনি ছাড়াই টিনের পাইপ দিয়েই চলছে ইট পোড়ানোর কার্যক্রম। এ চিত্র শেরপুরে অভিযানে ভেঙে দেওয়া প্রায় সব ভাটার। দেখে বোঝার উপায় নেই; কিছু দিন আগে এই ইটভাটাগুলোতে অভিযান চালিয়েছে পরিবেশ অধিদফতর। এখন জনমনে প্রশ্ন, চিমনি সম্পূর্ণ গুঁড়িয়ে দেওয়ার পর নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও কীভাবে এত অল্প সময়ে ভাটাগুলো দেদারসে চলছে।

পরিবেশ অধিদফতরের তথ্যমতে, চলতি বছরের ২ মার্চ জেলা প্রশাসন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের সহযোগিতায় শেরপুর পৌর শহরের মোবারকপুর মহল্লায় সাওদা ব্রিকসকে দুই লাখ টাকা জরিমানা এবং আর এইচ অটো ব্রিকসকে তিন লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। একইসঙ্গে অবৈধ ভাটা দু’টির চিমনি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। এবং ভাটা পরিচালনার সব কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়ার আদেশ দেওয়া হয়। এরপর ৬ মার্চ শেরপুর শহরের নৌহাটা মহল্লার আর ইউবি জিজজ্যাগ এবং পার্শ্ববর্তী মীরগঞ্জ মহল্লার এমএস অটো  ব্রিকসের চিমনি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।

৯ মার্চ পরিবেশ অধিদফতরের অভিযানে সদর উপজেলার বাজিতখিলার মুন ব্রিকস এবং বিপি ব্রিকসকে চিমনি গুঁড়িয়ে কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১০ মার্চ সদরের তাতালপুরের এম আর এইচ ব্রিকস -১ এবং এম আর এইচ ব্রিকস -২ এর চিমনি গুঁড়িয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১১ মার্চ একই ইউনিয়নের উত্তরা অটো ব্রিকস ও সুলতানপুরে ইদ্রিস অ্যান্ড কোং-৫ কে চিমনি গুঁড়িয়ে দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১২ মার্চ শ্রীবরদী উপজেলার কুড়িকাহনিয়া ইউনিয়নের পশ্চিম ঝিনিয়ার আল আমিন জিগজ্যাগ, সততা জিগজ্যাগ ও ইন্দিলপুরের ফাতেমা জিগজ্যাগ ব্রিকসের চিমনি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। এরপরের দিন ১৩ মার্চ শ্রীবরদীর মনিরা ব্রিকস ও একতা ব্রিকসের চিমনি গুঁড়িয়ে দিয়ে সব কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন

শেরপুরে উচ্চ শব্দে হর্ন বাজানোয় ৮ ট্রাক চালককে জরিমানা

১৭ মার্চ নকলা উপজেলার রিজন জিগজ্যাগ, পুবালি জিগজ্যাগ ও বাবা জিগজ্যাগ ইটভাটার চিমনি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। পরেরদিন ১৮ মার্চ শেরপুর সদরের মির্জাপুরের এ এইচ জিগজ্যাগ ও নৌহাটা মহল্লার এইচ এ বি জিগজ্যাগ ভাটা দু’টির চিমনি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। ১৯ মার্চ শ্রীবরদী উপজেলার ভায়া ডাঙার এবিএম অটো ব্রিকস ও শ্রীবরদী জিগজ্যাগ ব্রিকস ভাটাতেও অভিযান পরিচালনা করে পরিবেশ অধিদফতর। ভেঙে দেওয়া হয় চিমনি। এবং ২০ মার্চ শেরপুর পৌর শহরের মোবারকপুর মহল্লার আল আমিন জিগজ্যাগ ব্রিকস- ভাটাটিকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, চিমনি গুঁড়িয়ে দেওয়া শ্রীবরদীর ইন্দিলপুরের ফাতেমা ব্রিকস (বর্তমানে মা ব্রিকস) কর্তৃপক্ষ টিনের চিমনি দিয়ে দেদারসে চালাচ্ছে। একইভাবে চালাচ্ছে পশ্চিম ঝিনিয়ায় সততা ব্রিকস। টিনের চিমনি দিয়েই দেদারসে চালাচ্ছে আল আমিন ব্রিকসসহ গুঁড়িয়ে দেওয়া প্রায় সবকটিই ইটভাটা। ছোট টিনের চিমনি দিয়ে ধোঁয়া বের হওয়ায় আশপাশের ধানি জমির ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। কালিগঞ্জ ও মোবারকপুর মহল্লার একাধিক কৃষক বলেন, আগেই ভালো ছিল কারণ চিমনিটা অনেক উঁচু ছিল। এখন টিনের এই ছোট চিমনির ধোঁয়ায় আর ভাটার আগুনের তাপে আমাদের আধাপাকা ধানগুলো পুড়ে যাচ্ছে। আমাদের অভিযোগ কেউ শুনে না। আমাদের এ ক্ষতি পোষানোর মতো না। তাছাড়া এই ঝাঁঝালো ধোঁয়ায় আম ও লিচুর মুকুল পুড়ে যাচ্ছে। মালিকপক্ষকে বললে, আমাদের কোনো কথায় তারা শুনে না।

সদর উপজেলার মোবারকপুর মহল্লার একাধিক বাসিন্দা বলেন,  ইটভাটায় ম্যাজিস্ট্রেট ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় পরিবেশ অধিদফতর অভিযান চালান। তারা যাওয়ার পরদিনই চিমনি গুঁড়িয়ে দেওয়া এসব ব্রিকস ফিল্ডে কাজ শুরু হয়। এখন টিনের চিমনি দিয়ে দেদারসে ইট পোড়াচ্ছে। এসব নিষিদ্ধ ভাটাগুলো কীভাবে চালাচ্ছে, প্রশাসনের নাকের ডগায় তা আমাদের বোধগম্য নয়। এই টিনের চিমনির ধোঁয়া ও তাপে আমাদের ধানের ফসল ও ফলগাছের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। ঝাঁঝাল ধোঁয়া ও ধুলাবালির কারণে বাড়িতে ভাত পর্যন্ত খেতে পারি না।

thumbnail_pic-2-_Srrebordii_

চালু হওয়া ভাটার শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রথম দিকে প্রশাসন কৌশলী অভিযান চালিয়েছে। অভিযানের সময় ভাটার মূল অংশ অক্ষত রাখা হয়। শুধু চিমনির পাশের সারি সারি সাজানো ইটগুলো ইসকেবেটর দিয়ে এলোমেলো করা হয়। পরে ফায়ার সার্ভিসের সহায়তায় আগুনে পানি ফেলা হয়। এতে মালিকরা দু'দিনের মধ্যে আবারও ভাটা সচল করেছেন। আর দ্বিতীয় ধাপে যখন চিমনি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তখন দু'দিন পরেই কয়েক ফুট ইট দিয়ে গেঁথে টিনের চিমনি বসিয়ে ফের আগুনে পোড়ানো হচ্ছে ইট। আর এতে প্রশাসনের কোনো লোকজনকে বাঁধা দিতে তারা দেখেননি বলে জানান।

ভ্রাম্যমাণ আদালতের কঠোর নির্দেশনাকে উপেক্ষা করে কীভাবে ভাটার কার্যক্রম চালানো হচ্ছে, এ বিষয়ে মুখ খুলেনি ভাটা মালিকরা।

পরিবেশবাদী সংগঠন সবুজ আন্দোলনের চেয়ারম্যান বাপ্পি সরদার বলেন, ভাটা অবৈধভাবে চলছে। অভিযানও চলছে। অভিযানের ক’দিনের মাথায় আবার চিমনি গুঁড়িয়ে দেওয়া সেসব ভাটাও টিনের ছোট্ট চিমনি চালু হচ্ছে। ইতোমধ্যে টিনের চিমনি দিয়েই প্রায় সব ইট পোড়ানো হয়ে গেছে। আর এখন বর্ষা মৌসুমে এমনিতেই ভাটাগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। তাহলে ঢাক ঢোল বাজিয়ে লোক দেখানো এসব অভিযানের মানে কী। আমরা চাই, পরিবেশের সুরক্ষায় আইনের যথাযথ প্রয়োগ।

অভিযোগ প্রসঙ্গে পরিবেশ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক মো. নূর কুতুবে আলম সিদ্দিক বলেন, অভিযানে কোনো কৌশল অবলম্বন করা হয়নি। জেলার বেশিরভাগ ভাটার চিমনি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সঙ্গে সেসব ভাটার সব কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গুঁড়িয়ে দেওয়া ভাটায় আবার কার্যক্রম চলছে, শুনলাম। বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখা হবে। অভিযান কি এখন বন্ধ রয়েছে, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এটি চলমান প্রক্রিয়া।

প্রতিনিধি/এসএস