images

সারাদেশ

খোলস পাল্টে অপরাধীরা সক্রিয়, বাড়ছেই অপরাধ!

২৭ এপ্রিল ২০২৫, ০৮:৪৭ পিএম

গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী সরকারের পতনের দিন, গত বছরের ৫ আগস্ট, দেশের বিভিন্ন জেলার মতো রাজশাহীতেও থানায় হামলা এবং লুটপাট চালানো হয়। চরম অবনতি ঘটে আইনশৃঙ্খলার। এরপর প্রায় ৯ মাস অতিবাহিত হতে চললেও রাজশাহীতে দৃশ্যমান কোনো উন্নতি হয়নি। রাজনৈতিক অভ্যন্তরীণ কোন্দলে সংঘর্ষ, চুরি ও ছিনতাইসহ নানা অপরাধ বেড়েই চলেছে। এতে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে জনমনে। খোলস পাল্টে সক্রিয় হয়েছেন অপরাধীরা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, নগরীতে শুধু সংঘর্ষ বা ছিনতাই নয়, রমরমা মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি ও কিশোর গ্যাংগুলোর বেপরোয়া দাপটও চলছে দেদারসে। নির্মাণাধীন ভবন ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদাবাজির মাধ্যমে সক্রিয় বেশকিছু চক্র। প্রাণভয়ে চাঁদা দিতে বাধ্য হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। অভিযোগ উঠছে, চাঁদা না দিলে ‘স্বৈরাচারের দোসর’ ট্যাগ লাগিয়ে ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন। এছাড়া নগরীতে উদ্বেগজনকহারে বেড়েছে ছিনতাইয়ের ঘটনা।

গত ২০ এপ্রিল সকালে নগরীর বোয়ালিয়া থানা থেকে মাত্র ৩০০ মিটার দূরেই ছিনতাইয়ের শিকার হন দিলীপ কুমার প্রামাণিক নামে এক ব্যক্তি। রিকশায় থাকা দিলীপের চোখে মরিচের গুড়া ছিটিয়ে সাড়ে ১০ লাখ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে যায় দুই মোটরসাইকেল আরোহী। রিকশাচালক মো. মাসুমের যোগসাজশেই চাঞ্চল্যকর এই ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। পরে অবশ্য ওই রিকশাচালক গ্রেফতার হলেও মূল দুই ছিনতাইকারী এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। টাকাও উদ্ধার হয়নি এখনো।

গত ২৩ এপ্রিল রাতে নগরীর পঞ্চবটি গাড়োয়ানপাড়ায় রবিউল ইসলাম রবি (৪০) নামে আওয়ামী লীগের এক কর্মীকে গুলি করে কোপানো হয়। এই ঘটনার সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লেও এখন পর্যন্ত হামলাকারী কাউকে আটক করা সম্ভব হয়নি।

এছাড়া গত শনিবার (২৬ এপ্রিল) দিবাগত রাতে নগরীর বালিয়াপুকুর বড় বটতলা এলাকায় বিএনপির দুই গ্রুপের দ্বন্দ্বে ছুরিকাঘাতে বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। আহতদের মধ্যে নির্ঝর (২৮), বিপ্লব (২৮) ও হিমেল (৩৫) নামে তিনজনকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

গত ২১ এপ্রিল সাহেববাজার বড় মসজিদ এলাকায় মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক বজলুল হক মন্টুকে পিস্তল দিয়ে গুলি করে হত্যা চেষ্টা চালানো হয়। পরে ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ২৪ এপ্রিল শিমুল নামে একজনকে দল থেকে বহিষ্কার করে বিএনপি। সৈকতের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে তিনি এলাকায় বিভিন্ন সময়ে মব সৃষ্টি করছেন।

অভিযোগ পাওয়া গেছে, কেদুর মোড়, পঞ্চবটি, তালাইমারি শহিদ মিনার এলাকার অনেক ব্যক্তি মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের দফতর সম্পাদক সৈকতকে ‘খুশি’ রাখতে সর্বদা ব্যস্ত থাকছেন। সৈকত অসন্তুষ্ট হলেই পুলিশ ডেকে ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে স্বৈরাচারের দোসর হিসেবে। সবশেষ শনিবার রাফি নামে এক তরুণকে স্বৈরাচারের দোসর হিসেবে ধরে ফেসবুকে লাইভ করেন সৈকত। পরে সেই তরুণকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়।

এ বিষয়ে মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের দফতর সম্পাদক সৈকত ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘রাফির নামে মামলা ছিল না। অজ্ঞাত আসামি হিসেবে তাকে পুলিশে দেওয়া হয়েছে। কারণ, সে আগে বিএনপির নেতাকর্মীদের বাড়ি বাড়ি পুলিশ নিয়ে যেত।’ চাঁদা না পেয়ে ধরিয়ে দেওয়ার অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করে সৈকত বলেন, ‘তার কাছে তো মাদকও পাওয়া গেছে। আমরা পুলিশকে সহযোগিতা করছি।’

নগরবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শহরে এখনও চলছে বেপরোয়া চাঁদাবাজি। কোথাও কোনো নতুন ভবন উঠলেই চাঁদা দিতে হচ্ছে। চাঁদা না দিলে আটকে দেওয়া হচ্ছে নির্মাণ কাজ। চাঁদাবাজদের কারণে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে রাজশাহীর ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানগুলো।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বৈরাচার হাসিনার আমলে এসব নির্মাণাধীন ভবন থেকে চাঁদা তুলতো যুবলীগ-ছাত্রলীগের ছত্রছায়ায় থাকা সন্ত্রাসীরা। অভিযোগ উঠেছে, এখন তারা বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও তার বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের নেতাদের সাথে মিশে গেছে। ফলে চাঁদাবাজি চলছে আগের মতোই।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির টালমাটাল অবস্থায় শহরে এখন রমরমা মাদক ব্যবসাও চলছে দেদারসে। শহরের গুড়িপাড়া, কেদুর মোড়, পঞ্চবটি, তালাইমারি শহীদ মিনার এলাকায় মাদক কারবারিরা বর্তমানে অনেকটাই বেপরোয়া। হাত বাড়ালেই এসব এলাকায় মিলছে হেরোইন, ইয়াবা ও ফেনসিডিল। মোবাইলে এসব মাদক অর্ডার করছেন মাদকসেবীরা এবং রাত-বিরাতে দ্রুতগতিতে মোটরসাইকেল হাঁকিয়ে অল্পবয়সী মাদক কারবারিরা তা পৌঁছে দিচ্ছে শহরের সব এলাকায়। পুলিশের চেকপোস্ট ও তল্লাশি না থাকায় মাদক কারবারিরা ধরা পড়ছে না।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জামাত খান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘নাগরিক হিসেবে আমি আশাহত। আশা করেছিলাম, আমরা শান্তি পাব, কিন্তু আশাহত হয়েছি। প্রত্যেকটা মানুষ, প্রত্যেকটা পরিবার নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। কেউ নিরাপদে চলাচল করতে পারছে না। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবস্থা অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে খারাপ। সংশ্লিষ্টদের উচিত এদিকে নজর দেওয়া।’

এ বিষয়ে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরএমপি) অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (মিডিয়া) মোহাম্মদ রকিবুল হাসান ইবনে রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘৫ আগস্টের পর পুলিশ আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্য নিয়মিত টহল দিচ্ছে, সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলছে। অপরাধ সংগঠিত হওয়ার পর অপরাধীরা লুকিয়ে পড়ছে। তারপরও অনেকে ধরা পড়ছে। চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হলে সাধারণ মানুষকেও সহযোগিতা করতে হবে।’

কোনোরকম ‘মব’ পুলিশ সমর্থন করছে না জানিয়ে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘অনেক মানুষই আইন সম্পর্কে স্বল্প জ্ঞান রাখেন। তারা মনে করছেন যে, আইনের মাধ্যমে তারা বিচার পাবেন না। তাই তারা নিজেরাই মব সৃষ্টি করছেন। এটা না করার জন্যও আমরা বোঝাচ্ছি।’

প্রতিনিধি/একেবি