জেলা প্রতিনিধি
২৫ এপ্রিল ২০২৫, ০৯:১৯ পিএম
প্রথমবারের মতো চিয়া সিড ফসল আবাদ করে বেশ সাড়া ফেলেছেন শেরপুরে এক তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা। মাত্র ৫ হাজার টাকা খরচ করে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখছেন তিনি। এদিকে, প্রতিদিন তার ফসল দেখতে আসছেন অনেকেই। অল্প খরচে লাভজনক হওয়ায় আগ্রহও প্রকাশ করছেন কেউ কেউ।
শেরপুর সদরের কামারিয়া ইউনিয়নের সূর্যদী উত্তরপাড়া এলাকার মৃত মোজাফফর আলীর ছেলে শিমুল মিয়া। তিনি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। চাকরি করার সুবাদে অবসর সময়ে ইউটিউবে নানা কৃষি চাষাবাদ দেখতেন। দেখতে দেখতে কৃষিতে আগ্রহ বাড়ে তার। ধীরে ধীরে নতুন নতুন ফসল চাষাবাদের প্রতি ঝুঁকে পড়েন। এরপর চাকরি ছেড়ে ৫০ শতাংশ জমি বর্গা নেন তিনি। পরে সেই জমিতে লাগানোর জন্য চিয়া সিডের বীজ সংগ্রহ করেন এবং জেলায় প্রথমবারের মতো রোপণ করেন।

শিমুল ঢাকা মেইলকে জানান, গেল বছরের ডিসেম্বর মাসে প্রথমবারেরমতো বিদেশি উচ্চ মূল্যের ফসল চিয়া সিডের চাষ শুরু করেন তিনি। বর্গা নেয়া জমিতে বীজ বপন, সার, সেচসহ তার সবমিলিয়ে খরচ হয়েছে মাত্র ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা। লাগানোর তিন মাসের মধ্যে ফলন পরিপক্ব হয় তার। এরই মধ্যে ফলন কাটতে শুরু করেছেন তিনি। যা প্রায় ২০০ কেজির মতো হওয়ার আশা তার। ৫ থেকে ১ হাজার টাকা কেজি দরে ১ লাখ টাকা বিক্রির স্বপ্নও দেখছেন তিনি।

কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, অন্যান্য যেকোনো ফসলের থেকে চিয়া সিড চাষে খরচ কম। রোগবালাইও কম হয়। বাজার দর বেশি থাকায় স্থানীয় কৃষকদের মাঝে চিয়া চাষে আগ্রহ বাড়ছে। এক বিঘা জমিতে দুই থেকে ৩০০ গ্রাম বীজ প্রয়োজন হয়। বীজ বপনের ৯০ থেকে ১০০ দিনের মধ্যে এই ফসল ঘরে তোলা যায়। দেশের বিভিন্ন সুপার শপ ও অনলাইনে প্রতি কেজি চিয়া সিডের বাজারমূল্য ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা কেজি। চিয়া সিড দেখতে অনেকটা তোকমা দানা ও তিল বীজের মতো। এটিতে রয়েছে ক্যালসিয়াম, ভিটামিন সি, আয়রন, পটাশিয়াম, প্রোটিন, ওমেগা-থ্রিসহ নানা পুষ্টিগুণ। যা মানবদেহে রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। এছাড়া দেহের বাড়তি ওজন এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমিয়ে রক্তে চিনির পরিমাণ স্বাভাবিক রাখে। শুধু তাই নয় সুপার ফুড চিয়া সিডে আছে নানান ওষধিগুণ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চাষ হয় চিয়া সিড।
_20250425_211736894.png)
এদিকে, প্রতিদিন শিমুলের খেত দেখতে আসছেন অনেকেই। অল্প খরচে লাভজনক হওয়ায় আগ্রহও প্রকাশ করছেন কেউ কেউ।
স্থানীয় কৃষক পারভেজ আলী বলেন, আমরা সাধারণত ধান চাষ করি, কিন্তু এটা তেমন লাভ হয় না। কিন্তু কি আর করার, ওই ভাবেই আমাদের চাষ করতে হয়। কিন্তু এই এলাকায় নতুন যে একটা ফসল আইছে, এটা দেখলাম। অনেক ফলন আইছে, হুনতাছি দাম বেশি। আমরা কৃষক মানুষ একটু লাভের আশা করি। যদি দেখি লাভ এটাতে বেশি, তাহলে আমরাও এটা চাষ করব।
আরেক কৃষক সোহরাব আলী বলেন, এই ফসলডা যে আমাদের দেশে আছে, এটা আগে জানতাম না। আমরা এখন দেখতাছি অন্য ফসলের চেয়ে এটা বেশি আবাদ হয়। দামও ভালা হুনতাছি। আর অল্প সময়ের মধ্যেই ঘরে আসে। এটাইতো চাষ করা দরকার আমাদের।
.সুপার ফুড হিসেবে পরিচিতি।
.হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়।
.ক্যানসার প্রতিরোধে বেশ কার্যকরী।
.বপনের ৯০ থেকে ১০০ দিনের মধ্যে ফসল ঘরে আসে।
.সেচের সংকট এলাকায়, এটির চাষ উত্তম।
.বাড়তি কোনো খরচ নেই।
.চিয়া সিড ৫০০ টাকা থেকে ১ হাজার টাকা কেজি বিক্রি।
কৃষক রহমান মিয়া বলেন, আমরা গম, ভুট্টা, আলু এসব চাষ করতাম। কিন্তু ওইভাবে লাভবান হয় না। লাভবান বলতে একেবারে কম হয় আরকি। তবে, চিয়া সিডের লাভ তার থেকে বেশি হয়। আমার বয়সতো কম হয়নি, আমার দেখা ময়মনসিংহ বিভাগের মধ্যে এই চিয়া সিড চাষ নাই। আগামীবার আশা আছে ১/২একর জমিতে আবাদ করব।
একই এলাকার কৃষক শাহাদাত হোসেন বলেন, শিমুল যখন এই জমি ভাড়া নে, তখন আমি বলছিলাম কি লাগাবে, সে এই ফসলের কথা বলেছিল। আমরা তাকে না করেছিলাম যে আজেবাজে কিছু না লাগাতে। কিন্তু আমার কথা না শুনে শিমুল এই ফসল লাগাইলো। আমরা ধান করলাম। এহন দেখতাছি শিমুলই ভালা কাজ করেছে। তার ফসল অলরেডি ঘরে তুলেছে। ভালো দামে বেঁচতাছে। যখন ফসলডা লাগাইছিল, তেমন কোনো পরিশ্রমও করে নাই। শুধু লাগাই রাখছিল। যাই হোক সামনের বার আমারও লাগানোর ইচ্ছা আছে।

পুষ্টিবিদ তাসলিমা আক্তার ঊর্মি ঢাকা মেইলকে জানান, চিয়া সিড মূলত আমেরিকা ও মেক্সিকান খাবার। প্রাচীনকাল থেকেই এটি মানুষ খেয়ে আসছে। চিয়া সিডে রয়েছে অনেক পুষ্টিগুণ। এতে দুধের চেয়ে ৫ গুণ বেশি ক্যালসিয়াম, কমলার চেয়ে ৭ গুণ বেশি ভিটামিন সি, পালংশাকের চেয়ে ৩ গুণ বেশি আয়রন, কলার চেয়ে দ্বিগুণ পটাশিয়াম, মুরগির ডিম থেকে ৩ গুণ বেশি প্রোটিন, স্যামন মাছের চেয়ে ৮ গুণ বেশি ওমেগা-৩ রয়েছে। এটি পরিমাণ মতো খেতে হবে৷ অতিরিক্ত খেলে আবার পেটের পিড়া হতে পারে। চিয়া সিডে আরও রয়েছে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, কোয়েরসেটিন, কেম্পফেরল, ক্লোরোজেনিক অ্যাসিড ও ক্যাফিক অ্যাসিড নামক অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, আয়রন, ক্যালসিয়াম এবং দ্রবণীয় ও অদ্রবণীয় খাদ্য আঁশ। সকালে খালি পেটে এটি খাওয়া যায় আবার ঘুমানোর আগেও খাওয়া যায়।

শেরপুর জেলা কৃষি বিভাগের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ শাখাওয়াত হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, চিয়া সিড একটি পুষ্টিকর খাদ্য। এটি আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য বেশ উপকারী। এটি আমাদের একদিকে যেমন হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়, পাশাপাশি ক্যানসার প্রতিরোধে বেশ কার্যকরী। বর্তমানে যেটি সুপার ফুড হিসেবে পরিচিতি। আমাদের একজন কৃষি উদ্যোক্তা তিনি এই চিয়া সিড আবাদ করেছেন। ফলনও ভালো হয়েছে। এটি একটি স্বল্প মেয়াদি ফসল এবং এই ফসল চাষে পানি অনেক কম লাগে। বাংলাদেশের যেসমস্ত এলাকায় সেচের ঘাটতি আছে, সেসব এলাকায় এই চিয়া সিড চাষ উত্তম। এটির বাজার মূল্যেও বেশ ভালো। বর্তমানে এই ফসল চাষ করতে অনেক কৃষক উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। আমরা কৃষি বিভাগ থেকেও কৃষকদের উৎসাহ দিচ্ছি। কোন কৃষি উদ্যোক্তা যদি এই ফসল চাষে আগ্রহ থাকেন, তাহলে তাকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করা হবে।
প্রতিনিধি/এসএস