images

সারাদেশ

‘উলঙ্গ’ নালা-খালে মৃত্যুর মিছিল, লজ্জাহীন চসিক-চউক!

নিজস্ব প্রতিবেদক

২০ এপ্রিল ২০২৫, ১০:৪৫ এএম

একের পর এক মৃত্যু। কোনো সময় খালে। কোনো সময় নালায়। আবার কোনো সময় গর্তে পড়ে ঘটছে সব অকাল মৃত্যু। কারণ খাল বা নালা, এমনকি গর্ত সব উলঙ্গ। নেই কোনো নিরাপত্তা বেস্টনি, নেই দেয়াল। এমনকি ওড়ে না সতর্কতামূলক লাল নিশানাও।

এ নিয়ে যেন দায়ও নেই কারও। অথচ এসব দেখার দায়িত্ব চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (চউক)। কিন্তু এই দুই সংস্থার দায়িত্বশীলদের হাব-ভাব দেখে বুঝা যায়, তারা নগর পিতা, সেবক নয়। এজন্য তাদের কোনো লজ্জাও নেই। আছে গর্ব।

শনিবার (১৯ এপ্রিল) সকাল ১০টার দিকে চট্টগ্রাম মহানগরীর চাক্তাই খাল থেকে এক শিশুর মরদেহ উদ্ধারের পর এমন কঠিন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন প্রত্যক্ষদর্শী নগরবাসী। তাদের ভাষ্য, চট্টগ্রাম মহানগরীতে গত চার বছর ধরে নালা-খালে ও গর্তে পড়ে একের পর এক মৃত্যুর মিছিল চলছে। কিন্তু এ নিয়ে কোনো মাথা ব্যাথা নেই চসিক-চউকের।

ভোট আসলে সেবা সংস্থা চসিক, ভোট শেষে বনে যান নগরপিতা। আর নগরবাসীরা রোহিঙ্গা। খাল দখল, নালা দখলসহ চাঁদাবাজি আর লুটপাটে ব্যস্ত থাকে চসিক। খাল-নালা গর্তে পড়ে একের পর এক মৃত্যুর ঘটনা ঘটলেও সেগুলো নিরাপদ করার কোনো উদ্যোগ নেই সংস্থাটির।

চাক্তাইয়ের ব্যবসায়ী আমিনুল ইসলাম বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের নামে দীর্ঘ ১০ বছর ধরে রাস্তাঘাট খাল ও নালা কেটে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে চউক। অন্যদিকে, ওয়াসা করছে মাটি খোঁড়াখুঁড়ি, যেখানে তৈরি হচ্ছে বড় বড় গর্ত। আর এসব খাল-নালা গর্ত পুরোপুরি উলঙ্গ। যেখানে প্রতিনিয়ত ঘটছে অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা। হচ্ছে পঙ্গু, যাচ্ছে প্রাণ।

thumbnail_CCC-19.04_(3)

সর্বশেষ এমনি প্রাণ গেল ছয় মাস বয়সি শিশু সেহরিশের। শুক্রবার (১৮ এপ্রিল) রাত সোয়া ৮টার দিকে চট্টগ্রাম মহানগরীর কাপাসগোলা এলাকায় মা ও দাদির কোলে চড়ে ফুফুর বাসায় যাওয়ার সময় নবাব হোটেলের সামনে তাদের বহনকারী ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে নালায় পড়ে যায়।

এ সময় মায়ের কোল থেকে ছিটকে পড়ে পানির স্রোতে তলিয়ে যায় শিশু সেহরিশ। প্রত্যক্ষদর্শীরা মা-দাদি ও রিকশা চালককে উদ্ধার করলেও হারিয়ে যায় শিশু সেহরিশ। শনিবার (১৯ এপ্রিল) সকাল ১০টার দিকে নিখোঁজের স্থান থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে চাক্তাই খালের চামড়ার গুদাম এলাকা থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস।

সেহরিশ নগরীর আছাদগঞ্জের শুঁটকিপট্টি এলাকার মো. শহিদ ও সালমা বেগম দম্পতির প্রথম সন্তান। সন্তান হারিয়ে মা সালমা এখন পাগল প্রায় বলে জানান ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের চন্দনপুরা ফায়ার স্টেশনের লিডার অলোক চাকমা। তিনি বলেন, দুর্ঘটনার সময় নালাটি হাঁটু পানিতে ডুবেছিল। সন্ধ্যা থেকে মাঝারি বৃষ্টিপাতে নালায় পানি জমে স্রোত সৃষ্টি হয়েছিল। এই নালা সম্পূর্ণ খোলা ছিল। র‌্যাব বা নিরাপত্তা বেস্টনি থাকলে এই প্রাণহানির ঘটনা ঘটত না।

শুধু সেহরিশ নয়, ২০২৩ সালের ২৭ আগস্ট নালায় পড়ে নিখোঁজ হয় ১৮ মাস বয়সের এমনি এক শিশু। তার নাম ইয়াছিন আরাফাত। সে নগরীর আগ্রাবাদ রঙ্গিপাড়ার সাদ্দাম হোসেনের ছেলে। ওইদিন বিকেল ৪টার দিকে শিশুটি নিখোঁজ হয়।

ওইদিন বাসার লাগোয়া খোলা নালায় তন্ন তন্ন করে খুঁজেও রাত ১১টা পর্যন্ত শিশুটির হদিস পায়নি ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল। পরদিন সকাল ৯টা ১০ মিনিটের সময় বাসার পাশের নালায় জমে থাকা আবর্জনার মধ্যে শিশুটির লাশ খুঁজে পাওয়া যায়। এর আগে একই বছরের ৭ আগস্ট নগরীর দক্ষিণ পাহাড়তলী ইসলামিয়া হাট বাদামতলীতে নালায় পড়ে মারা যান চট্টগ্রামের হাটহাজারী সরকারি কলেজের ছাত্রী নিপা পালিত (১৯)।

এছাড়া ২০২২ সালের ৬ ডিসেম্বর নালায় তলিয়ে যায় ১০ বছরের শিশু মো. কামাল উদ্দিন। তিন দিন পর ঘটনাস্থলের প্রায় এক কিলোমিটার দূরে মুরাদপুর এন মোহাম্মদ প্লাস্টিক কারখানাসংলগ্ন খাল থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। ওই বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় নগরীর ডবলমুরিং থানার আগ্রাবাদ শেখ মুজিব সড়কের মাজার গেট এলাকার জেক্স মার্কেটের সামনে ফুটপাতে পা পিছলে নালায় পড়ে মৃত্যু হয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী শেহেরীন মাহমুদ সাদিয়ার (১৯)। তিনি আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের এক ছাত্রী ছিলেন। চার ঘণ্টা পর তার লাশ উদ্ধার হয়।

thumbnail_CCC-19.04_(1)

এর আগে ২০২১ সালের ২৫ আগস্ট প্রবল বর্ষণে পানিবন্দি নগরীর মুরাদপুরে খালে পড়ে তলিয়ে যান সবজি বিক্রেতা সালেহ আহমেদ। এখনও  তার খোঁজ পাওয়া যায়নি। তার সন্তানরা মুরাদপুরে পা পিছলে খালে পড়ার স্থানটিতে এসে খুঁজে বেড়ান বাবাকে। যদি কঙ্কালটিও অন্তত পাওয়া যায়, এই আশায় দিন গুনছেন নিখোঁজ সালেহ আহমেদের ছেলে সাদেক উল্লাহ মাহিন।

এছাড়া ২০২১ সালের ৩০ জুন ষোলশহর চশমাহিল এলাকায় একটি অটোরিকশা খোলা খালে পড়ে যায়। পরে খাল থেকে অটোরিকশাচালক সুলতান ও যাত্রী খাদিজা বেগমের লাশ উদ্ধার করা হয়।

নগরবাসীর অভিযোগ, পুরো চট্টগ্রাম মহানগরের রাস্তাঘাট, খাল, নালা উলঙ্গ অবস্থায় রয়েছে। অধিকাংশ খালের দুই পাশে নিরাপত্তা বেস্টনি নেই, নালা ও গর্তের ওপর স্লাব নেই। ফলে খাল ও নালাগুলো মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। যেখানে পড়ে একের পর এক প্রাণ হারাচ্ছে শিশু-তরুণ-তরুণি ও বয়োজেষ্ঠ্যরা।

প্রতিটি মৃত্যুর পর খাল ও নালার দু’পাশে প্রতিবন্ধকতা তৈরির পাশাপাশি উন্মুক্ত নালাগুলোতে সংস্কারের দাবি ওঠে। সেই সময় খোলা নালার পাশে বেস্টনি দেওয়ার ব্যাপারে চসিক সরব হলেও বেঘোরে থাকে চউক। অথচ খালগুলোর অধিকাংশই চউকের তত্ত্বাবধানে।

চসিকের তথ্য মতে, চট্টগ্রাম মহানগরে চসিকের আওতায় ৯৭২ কিলোমিটার নালা রয়েছে। ২৮১ কিলোমিটার ফুটপাত এবং ৫৭টি (১৬১ কিলোমিটার) খাল রয়েছে। এর মধ্যে ৩৬টিই সিডিএর আওতাধীন। বাকি ২১টি খাল দেখভালের দায়-দায়িত্ব চসিকের। আবার বেশিরভাগ ফুটপাত নালার ওপর। সেখানেও দখলদারদের হানা। ২০২১ সালে এ সকল খাল, নালা ও ফুটপাতের ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোর ওপর জরিপ চালায়। জরিপের পর মোট ৫ হাজার ৫২৭টি ঝুঁকিপূর্ণ স্থান চিহ্নিত করা হয়। এসকল ঝুঁকিপূর্ণ স্থানের মোট আয়তন ছিল ১৯ কিলোমিটার। তবে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা রক্ষায় দৃশ্যমান কোন অগ্রগতি চোখে পড়েনি।

 

সরেজমিনে দেখা যায়, চট্টগ্রাম মহানগরের মুরাদপুর, বহদ্দারহাট, শুলকবহর, মেহেদিবাগ, চটেশ্বরী মোড়, দুই নম্বর গেট, রহমান নগর, মেয়র গলি, আল-ফালাহ গলি এলাকার নালার বেশির ভাগ অংশে এখনও স্ল্যাব বসানো হয়নি। এমনকি নগরীর ৪১ ওয়ার্ডের বড় বড় খালেও নেই নিরাপত্তাবেষ্টনী।

নগরীর বহদ্দারহাট এলাকার বাসিন্দা মো. আজাদ জানান, ভারি বর্ষণে খাল-নালা ও সড়ক পানিতে একাকার হয়ে যায়। তখন পা ফেলতে গিয়ে বিপদে পড়েন পথচারীরা। কোনটি রাস্তা, কোনটি নালা বুঝতে কষ্ট হয়। আবার অনেকে পা পিছলে খোলা নালা-খালে পড়ে যান। স্রোত ও জমে থাকা আবর্জনার কারণে উঠতে না পেরে অনেকে প্রাণ হারান।

চকবাজারের বাসিন্দা কামাল হোসেন বলেন, শুধু ড্রেনগুলো নয়, পুরো চসিক উলঙ্গ নালা-খালই এখনো মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। এত প্রাণ যাওয়ার পরও কারও কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেই। কেউ মারা গেলে কয়েকদিন বেশ হাঁক-ডাক চলে। এরপর চাপা পড়ে যায় নিরাপদ নগরীর গড়ার দাবি।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী বলেন, নগরীর জলাবদ্ধতা একটি দীর্ঘদিনের সমস্যা। এ থেকে কবে মুক্তি মিলবে সেটি আর বলার প্রয়োজন মনে করছি না। তবে নগরবাসীকে এসব খাল-নালের মৃত্যুর ফাঁদ থেকে যাদের নিরাপত্তা দেওয়ার কথা, এতো মৃত্যুর পরও তাদের বোধোদয় হয়নি। তাদের কাছে পিঁপড়ার চেয়েও নাগরিকদের জীবন মূল্যহীন। বর্ষার সময় বিপদজ্জনক নালা-খালগুলোকে তারা চিহ্নিত করে লাল পতাকা টাঙিয়ে দিতে পারতো। কিন্তু বহুবার এসব বলার পরও কোনো গরজ নেই। আছে শুধু একজন-আরেকজনকে দোষারোপ। এতে তারা তাদের ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে তাদের এমন অবহেলার খেসারত আরও দিতে হবে।

উলঙ্গ খাল-নালা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, চসিকের নির্ধারিত খোলা ড্রেনে স্ল্যাব স্থাপন এবং খালের পাশে রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। আমাদের তালিকা তৈরি হলেও বর্ষার আগে নানা কারণে অনেক জায়গার কাজ শেষ করতে পারিনি। তবে গত কয়েক বছরে প্রায় ৩০ হাজার বর্গফুট স্ল্যাব মেরামত ও নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছে। আর ঝুঁকিপূর্ণ খালের পাড়ে ১৭ থেকে ১৮ হাজার বর্গফুট রক্ষাপ্রাচীর নির্মাণ করা হয়। কিন্তু বিভিন্ন ওয়ার্ডে এখনও অন্তত ৩ হাজার মরণফাঁদ রয়েছে।

 

মৃত্যুর ঘটনাগুলো প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম সিটি করপোরশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো দুর্ঘটনাগুলোর কারণ। তবে আমাদের দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। আবার আমরা যে বসে আছি ব্যাপারটা ঠিক তা না। খাল-নালায় পড়ে এমন মৃত্যুর ঘটনা অনাকাঙ্ক্ষিত, দুঃখজনক। ঝুঁকিপূর্ণ যেসকল খাল-নালা রয়েছে সেগুলোতে অতিসত্ত্বর লাল পতাকা বা সাইনবোর্ড টাঙানোর ব্যবস্থা করা হবে।

একইভাবে চউকের প্রধান নির্বাহী প্রকৌশলী হাসান বিন সামশ বলেন, নগরীর ৩৬টি খাল চউকের আওতায় হলেও তা সংস্কারের জন্য। নিরাপত্তা বেস্টনির দায়িত্ব তো চসিকের। তারা ২১টি খাল ও নালার নিরাপত্তা দিতে পারছে না। বাকি দায়িত্ব কিভাবে নিবে। নানাভাবে দায় এড়ানো ছাড়া চসিকের কী করার আছে।

প্রতিনিধি/টিবি