images

সারাদেশ

কক্সবাজারে তামাকের আগ্রাসন: বাড়ছে ক্যানসারের ঝুঁকি

জেলা প্রতিনিধি

১১ মার্চ ২০২৫, ০৯:৩৯ এএম

ক্ষতির প্রভাব জেনেও সবজি ছেড়ে তামাক চাষে ঝুঁকছেন কক্সবাজারের কৃষকেরা। চলতি মৌসুমে চকরিয়া ও রামু উপজেলায় ৬৮০ হেক্টর জমিতে তামাকের চাষ হয়েছে।  তামাক কোম্পানিগুলোর লোভনীয় অফার ও লজিস্টিক সাপোর্টের কারণে কৃষকরা তামাক চাষে উৎসাহ পাচ্ছেন। এসব তামাক চাষের ফলে নষ্ট হয় জমির উর্বরতা। তামাকের বিষাক্ত উপাদান শিশু স্বাস্থ্যের  জন্যে ঝুঁকিপূর্ণ, এর ফলে ক্যানসারের প্রবণতা রয়েছে। এছাড়া বিষাক্ত কীটনাশক ব্যবহার ও তামাকের নিকোটিনের প্রভাবে দূষিত হচ্ছে  নদীর পানি। যার কারণে তামাক খেতের পার্শ্ববর্তী নদীগুলোয় মাছের প্রজনন কমে গিয়েছে। 

স্থানীয়রা জানান, অসাধু তামাক কোম্পানিগুলো কৃষকদের ভুল বুঝিয়ে তামাক চাষে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন। কৃষকদের আর্থিক সহায়তা, সার, বীজ ও ইত্যাদি মাধ্যমে তামাক কোম্পানিগুলো সুবিধা আদায় করছে। এদিকে পুঁজি ছাড়া ব্যবসা হওয়ায় ও অতিরিক্ত মুনাফা অর্জনের আশায় তামাক চাষে যাচ্ছে অধিকাংশ কৃষক।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, কক্সবাজারের রামু রাজারকুল, মৈষকুম, গর্জনিয়া, কচ্ছপিয়ার নাপিতেরচর, কাউয়ারখোপ, মনিরঝিল ও ফাক্রিকাটা এলাকায় বাঁকখালী নদীর দুই তীরে চাষ করা হয়েছে তামাকের। যেখানে এক সময় সবজি চাষাবাদ হতো, সেসব জমিগুলো এখন দখলে নিয়েছে তামাক খেত।

thumbnail_IMG_20250301_081618_059

একই চিত্র চকরিয়ায়ও। এই উপজেলার ১৮টি ইউনিয়নের মধ্যে ৮টি ইউনিয়নে তামাকের চাষ হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি তামাক চাষ হচ্ছে বমু বিলছড়ি, সুরাজপুর মানিকপুর ও কাকারা ইউনিয়নে। এই তিন ইউনিয়নের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া মাতামুহুরী নদীর চর এবং তীরবর্তী জমিতেও তামাকের আবাদ হয়ে আসছে।

বর্ষায় নদীর দু’কূল উপচে ঢলের পানিতে পলি জমে। আর সেই উর্বর জমির বেশির ভাগই তামাকের দখলে চলে যায়। অথচ নদীর আশপাশের স্বল্প উর্বর জমিতে বাদাম, ভুট্টা, সরিষা, শাকসবজি, গোলাপ, সূর্যমুখী ফুল ও বোরোর আবাদ হয়েছে।

এখানকার মানুষ প্রাকৃতিক পানি নির্ভর। সেক্ষেত্রে সাঙ্গু, মাতামুহুরী ও বাকঁখালী নদী অন্যতম ভরসা। বর্তমানে যা অনিরাপদ হয়ে উঠছে। তামাক চাষে ব্যবহৃত অতিমাত্রার সার-কীটনাশক ও তামাকের রাসায়নিক উপাদান ক্রমেই নদী ও জলাশয়ের পানিতে মিশে পানিদূষণ করছে। বিশেষ করে মাছের ডিম পাড়ার মৌসুমে কীটনাশকযুক্ত পানির কারণে মাছ তার বংশ বিস্তারের অনুকূল পরিবেশ হারাচ্ছে। আরও একটি আশঙ্কার বিষয় হলো, তামাক চাষ ও প্রক্রিয়াকরণ কাজে সম্পৃক্ত থাকার কারণে সংশ্লিষ্ট এলাকায় শিশু-কিশোরদের বিদ্যালয়ে উপস্থিতির হার দিন দিন কমে আসছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, এই তামাকের ক্ষতিকর প্রভাবে ভূমির উর্বরতা নষ্ট হয়ে যায়। যে জমিতে একবার তামাক চাষ করা হয়, সে জমিতে অন্য ফসল সহজে হয় না। ফসলের জন্যে হুমকিস্বরূপ এই বিষাক্ত তামাক। তামাক কোম্পানিগুলোর প্রলোভনে পড়ে বেশি লাভের আশায় প্রতিবছর শুষ্ক মৌসুমে তামাক চাষে জড়িয়ে পড়েন অর্থলোভী কিছু কৃষক।

thumbnail_IMG_20250301_081643_638

বিশেষজ্ঞদের মতে, তামাক রোপণ থেকে শুরু করে পাতা কাটা এবং শুকানো পর্যন্ত এর সব প্রক্রিয়াতে রয়েছে বিষাক্ত উপাদান। কৃষকরা ভয়াল এ বিষ সম্পর্কে জানার পরেও অতিরিক্ত লাভের আশায় তামাক চাষে যাচ্ছেন। এর পরিচর্যায় কৃষকরা নিজেদের পাশাপাশি পরিবারের স্ত্রী ও কোমলমতি শিশুদেরও ব্যবহার করছে। ফলে বাড়ছে ক্যানসারসহ তামাকজনিত বিভিন্ন রোগের প্রকোপ। স্বাস্থ্য ও পরিবেশে ঝুঁকি জেনেও অনেকেই অতিরিক্ত লাভের আশায় তামাক চাষ ছাড়তে পারছে না।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে ইতোমধ্যে বেশ ক’টি বেসরকারি সংস্থা কক্সবাজার জেলায় কাজ করলেও কৃষকের পক্ষ থেকে তামাক চাষ বন্ধে কোনো ধরনের আগ্রহ নেই। ফলে অনেকটা বিনা বাধায় স্থানীয় কৃষকদের জিম্মি করে নানা প্রলোভন দেখিয়ে তামাক কোম্পানিগুলো প্রতিবছর তামাক চাষে বিনিয়োগ করে আসছে।

কৃষকরা বলেন, তামাক চাষ আসলেই ক্ষতিকর । কিন্তু সংসারের অভাবের কারণে বাধ্য হয়ে তামাক চাষ করতে হয়। ফসলের চেয়ে তামাক চাষ করলে  টাকা বেশি পাওয়া যায়। তাই অধিকাংশ কৃষক তামাক চাষের ক্ষতিকর সব কারণ জেনেও অতিরিক্ত লাভের আশায় ফসলের পরিবর্তে তামাক চাষ করতে বেশি আগ্রহী হন।

thumbnail_IMG_20250301_081600_928

রামু উপজেলার কচ্ছপিয়া এলাকার সমাজ সেবক জাহাঙ্গীর সেলিম জানান, পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি জেনেও কৃষকেরা তামাক কোম্পানিগুলোর ঋণ সহায়তা ও লোভনীয় প্রলোভনে তামাক চাষ ছাড়তে পারছে না। রামুতে দিন দিন তামাক চাষের প্রবণতা বেড়েই চলেছে।

পরিবেশবাদীদের অভিযোগ, তামাকে অতিরিক্ত কীটনাশক ও সার প্রয়োগের ফলে নদীদূষণ বেড়েছে। এতে ধ্বংস হচ্ছে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য। পাশাপাশি তামাক পোড়ানোর জন্য সংরক্ষিত বন ও ভিটেবাড়ির গাছ কেটে উজাড় করা হয়।

কক্সবাজার কৃষিসম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আশীষ কুমার জানান, তামাক পরিবেশের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এই তামাক চাষের কারণে মাটির উর্বরতা নষ্ট হয়ে যায়। যে ভূমিতে একবার তামাক চাষ করা হয়, সেখানে অন্য কোনো ফসল হয় না। কৃষকদের তামাক চাষ থেকে সরে আসতে আমরা নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করে আসছি। যেসব কৃষক তামাক চাষ করেন, তাদের কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের সহযোগিতা করা হয় না। চলতি মৌসুমে রামু ও চকরিয়া উপজেলায় ৬৮০ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়েছে। আগের বছর চাষ হয়েছিল ৭৪০ হেক্টর জমিতে। নানাভাবে প্রচেষ্টায় তামাক চাষ কিছুটা কমে এসেছে। শাক সবজি ও ফলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেক কৃষক তামাক চাষ ছেড়ে  ফসলের দিকে ঝুঁকছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে তামাক চাষ একেবারে কমে আসবে বলে মনে করেন তিনি।

প্রতিনিধি/এসএস