জেলা প্রতিনিধি
২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৪:৩২ পিএম
টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলায় বিয়ে বিচ্ছেদের হার দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, এবং ২০২৪ সালের পরিসংখ্যান অনুসারে, ১০০টি বিয়ের মধ্যে ৩৬টি শেষ হচ্ছে বিচ্ছেদে। স্থানীয় প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে এখানে ৮৩৭টি বিয়ে হয়, যার মধ্যে ৩১৯টি বিচ্ছেদ ঘটে। ২০২৪ সালে বিয়ের সংখ্যা বেড়ে ৯২৯টি হলেও বিচ্ছেদের সংখ্যা ৩৩৭টিতে পৌঁছেছে, যা মোট বিয়ের ৩৬ দশমিক ২৮ শতাংশ।
স্থানীয় কাজী অফিসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ভিন্ন ভিন্ন ইউনিয়নে বিচ্ছেদের সংখ্যা পার্থক্য রয়েছে। নিকরাইল ইউনিয়নে গত বছর ১১৩টি বিচ্ছেদ ঘটেছে, গোবিন্দাসী ইউনিয়নে ৩৯টি, গাবসারা ইউনিয়নে ৪৮টি, এবং পৌর এলাকাসহ অন্যান্য এলাকায় একাধিক বিচ্ছেদ ঘটনা ঘটেছে।
বিচ্ছেদের পেছনে নানা কারণ রয়েছে, যার মধ্যে বাল্যবিয়ে, পরকীয়া, স্ত্রীর প্রতি স্বামীর উদাসীনতা, মাদকাসক্তি, নারীর প্রতিবাদী মনোভাব, শ্বশুর-শাশুড়ির নির্যাতন, যৌতুকের চাপ এবং প্রবাসে থাকা স্বামীদের অবহেলা অন্যতম।
বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন এবং স্থানীয় নেতৃবৃন্দ বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা মনে করছেন, বিয়ের ক্ষেত্রে সামাজিক চাপ, প্রথাগত দৃষ্টিভঙ্গি এবং শিক্ষার অভাব এই সমস্যা বৃদ্ধির প্রধান কারণ। তাছাড়া, অনেক তরুণী তাদের জীবনকে আরও ভালোভাবে গড়তে শিক্ষায় মনোনিবেশ করতে চান, কিন্তু পরিবার ও সমাজের চাপের কারণে তারা নিজের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না।
কয়েকজন তরুণী নাম প্রকাশ না করে জানান, তারা শিক্ষার মাধ্যমে জীবনকে আরও ভালোভাবে গড়ে তুলতে চান। কিন্তু পরিবারের অনাগ্রহ এবং সমাজের দিকে তাকিয়ে তারা অনেক সময় নিজেদের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না।
একই শর্তে একাধিক নারী জানান, সামান্য কারণে একজন নারী কখনোই বিয়ের বিচ্ছেদ চায় না। শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন যখন সীমা অতিক্রম করে, ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়, কেবল তখনই বাধ্য হয়ে এ কাজ করতে হয়। এরপর তাদের ‘ডিভোর্সী’ তকমা দিয়ে হেয় চোখে দেখা হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক বিচ্ছেদকৃত নারী জানান, পারিবারিক অশান্তি এবং আর্থিক সংকট তাদের সম্পর্কের মধ্যে ভাঙন তৈরি করেছে। এখন তারা ‘ডিভোর্সী’ তকমা নিয়েও স্বাধীনভাবে জীবন শুরু করতে চান, কারণ তারা জানিয়ে দিয়েছেন যে, তাদের পরিবার তাদের অমতে বিয়ে দিয়েছিল।
নাঈম নামে এক যুবক জানান, তিনি পারিবারিকভাবে বিয়ে করেন। তাদের বিবাহিত জীবন ভালই যাচ্ছিল, তাদের একটি সন্তানও রয়েছে। কিন্তু তার স্ত্রী পরকীয়া সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন এবং সংসারে সময় দিতে পারছিলেন না। এরপর তার বিরুদ্ধে নারী নির্যাতন আইনে সাজানো মামলা দেওয়া হয়, যার কারণে তাকে জেলে যেতে হয়। পরে তার স্ত্রী তাকে তালাক দেয়।
দি-হাঙ্গার প্রজেক্টের নিকরাইল ইউনিয়ন সমন্বয়কারী মোছা. পলি বলেন, ‘আমাদের উপজেলার মধ্যে নিকরাইলে সবচেয়ে বেশি বিবাহ বিচ্ছেদের প্রবণতা। উল্লেখযোগ্য প্রধান বা অন্যতম কারণ হলো অপ্রাপ্ত বয়সে বিয়ে এবং ছেলে-মেয়ের উভয়ের ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে দেওয়া। বিয়ের কিছুদিন পরেই দম্পতিদের মধ্যে পারিবারিক কলহ সৃষ্টি হয়, যার ফলে বিচ্ছেদ ঘটে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এছাড়া, পরকীয়া বিষয়েও ঘটনা ঘটে। তবে, বিবাহ বিচ্ছেদ রোধে আমরা পাড়া-মহল্লায় নানা সময়ে বিভিন্ন নারী সমাবেশ ও ক্যাম্পিং আয়োজন করে আসছি।’
এ প্রসঙ্গে উপজেলা কাজী সমিতির সাধারণ সম্পাদক বদিউজ্জামান জানান, ‘বিচ্ছেদ বা পরিবার ভাঙার ক্ষেত্রে সমাজের একটি নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে। তবে পরিবারগুলোর মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সহানুভূতিশীল মনোভাব গড়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে। এছাড়া, বাল্যবিয়ে ও পরকীয়ার কারণে বিয়ে বিচ্ছেদ হচ্ছে।’

এ বিষয়ে উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা আমিনা বেগম জানান, ‘বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে আমরা নিয়মিত সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছি। বিয়ে বিচ্ছেদ সম্পর্কে আমরা কাউন্সেলিং শুরু করেছি। তবে, এ ক্ষেত্রে অভিভাবকদের বেশি দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে—তবে তবেই সমাধান পাওয়া সহজতর হবে।’
প্রতিনিধি/একেবি