উপজেলা প্রতিনিধি
৩১ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:৩৮ পিএম
বছরের প্রথম মাস শেষ হলেও হাতিয়ায় এখনও বেশিরভাগ বই হাতে পায়নি প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীরা। টেনেটুনে কোনোমতে চলছে ক্লাস। বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী উপস্থিতি একেবারে কম। যা আসে খেলাধুলায় কাটে দুপুর পর্যন্ত।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের বিনা মূল্যের পাঠ্যবই বিতরণের এই চিত্র হাতিয়ায় কিছুটা ব্যতিক্রম। দেশের বিভিন্ন এলাকার মতো নোয়াখালী জেলার অন্যান্য উপজেলায় যে মাত্রায় বই পৌঁছেছে, একই জেলার অধীন হাতিয়ায় ওই পরিমাণ বই না পাওয়ারও অভিযোগ তুলেছেন অনেক শিক্ষক।
নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার অন্তত ৯টি বিদ্যালয় ও ৩টি মাদরাসায় গতকাল সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, কোনো মাদরাসা কিংবা বিদ্যালয়েই সব শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সবগুলো নতুন বই পায়নি। মাধ্যমিকে তিনটি বিষয় আর ৮ম শ্রেণিতে মাত্র দু’টি বিষয়ের বই বিতরণ করা হয়েছে। মাদরাসায় ৮ম শ্রেণিতে কোনো বই-ই পায়নি। প্রাথমিকেও একই অবস্থা। কেবল ১ম,২য় এবং তৃতীয় শ্রেণির বই বিতরণ করা হয়েছে।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রায় মাদরাসা এবং বিদ্যালয়ে একটি বা দু’টি করে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে। সেখানেও তেমন উপস্থিতি নেই। বই না থাকায় ক্লাসে মনোযোগী হচ্ছে না শিক্ষার্থীরা। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানে পুরোনো বই দিয়ে দু-একটি ক্লাস টেনেটুনে করানো হচ্ছে।
উপজেলার পশ্চিম লক্ষ্মীদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৪র্থ ও ৫ম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের পিডিএফ কপি সংগ্রহ করে পড়ানোর চিত্র দেখা গেছে। পিডিএফ কপির সাপোর্ট নেওয়ার বিষয়ে রহমানিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শাহেনা আক্তার এবং হাজীপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রওশনারা বলেন, এ ব্যাপারে সরকারি কোনো নির্দেশনা পায়নি।
আবার প্রধান সড়ক থেকে দূরবর্তী উত্তর-পশ্চিম গুল্যাখালী হাজি গিয়াসউদ্দিন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একজন শিক্ষার্থীর উপস্থিতিও দেখা যায়নি।
স্কুলটির প্রধান শিক্ষক আব্দুল কাদের বলেন, আমরা কোনো বই পায়নি, তাই ছাত্র-ছাত্রী আসে না। তিনি আরও বলেন, আমাদের জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলায় সব বই পেয়েছে, কিন্তু আমরা পাইনি। তাই ক্লাস নেওয়া যাচ্ছে না। একই অবস্থা মধ্য চর আমানুল্যাহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েও। এখানেও কোনো শিক্ষার্থীর উপস্থিতি দেখা যায়নি। এমন কিছু চিত্র প্রায় নব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ অনেক প্রতিষ্ঠানে লক্ষ্য করা গেছে।
মো. মফিজ উদ্দিন আহামদ নামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক সহকারী শিক্ষক তার ফেইবুকে লিখেছেন, ‘দেশের কোনো কোনো অঞ্চলে সব শ্রেণির বই পেয়ে গেছে! অথচ আমরা পেয়েছি ১ম-৩য়! এটা বৈষম্য না??’
এছাড়া মাকছুদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নামের প্রতিষ্ঠানটির অবস্থাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। নদীগর্ভে তলিয়ে যাওয়ার পর গত তিন বছর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির পাঁচজন শিক্ষককে বসিয়ে বসিয়ে বেতনভাতা এবং বিভিন্ন উন্নয়ন বরাদ্দ দিয়ে যাচ্ছে সংশ্লিষ্ট ডিপার্টমেন্ট।
একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক প্রধান শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘নব সরকারিসহ প্রায় বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বই না থাকার অজুহাতে পাঠ দান থাক দূরের কথা স্কুলেও ঠিকমতো যায় না। তাদের ছাত্র-ছাত্রীও নেই। আর আমরা নতুন পুরান মিলিয়ে ঠিকমতো শ্রেণি পাঠদান চালিয়ে নিচ্ছি।
এদিকে, বুড়িরচর ছৈয়দিয়া উচ্চবিদ্যালয়ের ৯ম শ্রেণির তামান্না এবং জেসমিন নামে দুই শিক্ষার্থী বলেন, আমরা তিন বিষয় নতুন পেয়েছি। তবে নতুন পুরান বই মিলিয়ে আমাদের দুই-তিন বিষয়ের ক্লাস হয়। আব্দুল মোতালেব উচ্চবিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণির শিক্ষার্থী ইফফাত আরা, মাহি এবং সানজিদা বলেন, এখন বিভিন্ন ইভেন্টের খেলাধুলা চলে, আর সব বই না পাওয়াতে এক-দুইটা বিষয়ের ক্লাস চলে।
রিয়াজ উদ্দিন নামের এক হাইস্কুল শিক্ষক জানান, এখনতো খেলাধুলার সময়, আর বই যা আছে তা দিয়ে এক-দুইটা ক্লাস চলে। আকতার হোসেন নামের এক হাইস্কুল শিক্ষক জানান, আমরা তিনটা বিষয় পেয়েছি আর ৮ম শ্রেণির মাত্র ২টা বিষয় পেয়ে কোনোমতে ক্লাস চালিয়ে নিচ্ছি। সোহেল নামের আরেক হাইস্কুল শিক্ষক জানান, বই না পাওয়ার কারণে পাঠদান করা যাচ্ছে না, বিষয়টির সমাধানে এনসিটিবি জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।
তমরোদ্দি আহমাদিয়া ফাজিল মাদরাসার অধ্যক্ষ মাওলানা মাইন উদ্দিন জানান, ৮ম শ্রেণির কোনো বই পায়নি আর অন্যান্য শ্রেণির তিনটি বিষয়ের বই পেয়েছি।
জহির উদ্দিন এবং মাইন উদ্দিন নামের দু’জন ছাত্র গার্ডির হতাশা জানিয়ে বলেন, বছরের প্রথম মাস শেষ হয়ে গেল অথচ আমাদের সন্তানেরা এখনও বই পেল না। এতে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ যেমন কমে যাবে, তেমনি পড়াশোনার ক্ষেত্রেও পিছিয়ে যাবে।
জানা যায়, হাতিয়ায় ইবতেদায়ি ও মাধ্যমিক পর্যায়ের ১৭টি মাদরাসায় শিক্ষার্থী রয়েছে প্রায় ৯ হাজার। দু’টি সরকারি উচ্চবিদ্যালয়সহ ৩৪টি উচ্চবিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী রয়েছে প্রায় ১৫ হাজার।
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের তথ্যমতে, ২০২৪ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২২৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী রয়েছে ৬৩ হাজার ৭০০ জন। যেখানে শিশু শ্রেণিতে সাত হাজার ৫০০ জন, প্রথম শ্রেণিতে ১২ হাজার ৩০০ জন, ২য় শ্রেণিতে ১৩ হাজার ৫০০ জন, ৩য় শ্রেণিতে ১১ হাজার ৫০০ জন, ৪র্থ শ্রেণিতে ১০ হাজার ৮০০ জন এবং ৫ম শ্রেণিতে ৮ হাজার ১০০ জন শিক্ষার্থী।
হাতিয়া উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুল জব্বার বলেন, জেলা সমন্বয় মিটিংয়ে বলা হয়েছে এখনো পুরো সেটের প্রিন্টিং শেষ হয়নি, তাই সব শ্রেণির বই দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে কবে নাগাদ সবগুলো বই আসবে সে সংক্রান্ত কোনো তথ্য দিতে পারেননি এই কর্মকর্তা।
এবিষয়ে নোয়াখালী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মনছুর আলী চৌধুরীরর মোবাইল ফোনে বারবার কল দিয়েও যোগাযোগ করা যায়নি।
প্রতিনিধি/এসএস