জেলা প্রতিনিধি
০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৭:৩৫ পিএম
রাজশাহী সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজে (টিটিসি) মাদরাসা শিক্ষকদের নিয়ে চলমান প্রশিক্ষণে ‘কৌশলে’ শেখ মুজিবুর রহমান ও হাসিনার গুণকীর্তন করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রতিবাদে ট্রেনিং বর্জন করেছেন প্রশিক্ষণার্থী মাদরাসা শিক্ষকরা। বৃহস্পতিবার (৫ ডিসেম্বর) সকালে নগরীর ঘোষপাড়া মোড় এলাকায় টিটিসির সম্মেলন কক্ষে এ ঘটনা ঘটে। তবে সাংবাদিক ও টিটিসির এসব দেখার দায়িত্ব না উল্লেখ করে মন্ত্রণালয়ের ওপর দোষারোপ করে দায় সেরেছেন টিটিসির উপাধ্যক্ষ প্রফেসর ড. বিশ্বজিৎ ব্যানার্জী।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মাদরাসা শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বাছাইকৃত শিক্ষকদের নিয়ে ট্রেনিং পরিচালনা করে আসছে মাদরাসা শিক্ষা অধিদফতর। কোরআন, হাদিস, ফিকাহ ও আরবি বিষয়ের শিক্ষকদের নিয়ে এই প্রশিক্ষণ। প্রতি ব্যাচে ১৫০ জন করে শিক্ষকের ট্রেনিং করানো হচ্ছে। ইতোমধ্যে ৪ ব্যাচে রাজশাহী বিভাগের বিভিন্ন মাদরাসার ৬০০ জন শিক্ষকের ট্রেনিং সম্পন্ন হয়েছে। সর্বশেষ আরবি বিষয়ের ১৫০ জন শিক্ষক ট্রেনিং করছেন। প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করছেন ৪৪ জন প্রশিক্ষক ও ২০ জন গেস্ট স্পিকার।
সূত্র জানিয়েছে, প্রশিক্ষণে প্রত্যেক শিক্ষককে ম্যানুয়াল (প্রশিক্ষণ/শিখন বই) দেওয়া হয়েছে। সেই ম্যানুয়ালে (বই) ‘শিক্ষা নিয়ে গড়ব দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ’ লেখা সম্বলিত মনোগ্রাম রয়েছে। এছাড়া ম্যানুয়ালের ভেতরে ভূমিকায় ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মাদরাসা শিক্ষার ওপর যথেষ্ট গুরুত্বারোপ করেন’ উদ্ধৃতিসহ বিভিন্ন গুণকীর্তনমূলক লেখা এখনো রয়েছে। ৬০০ জন শিক্ষককে ইতোমধ্যে এই ম্যানুয়াল দেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ আরবি বিষয়ের শিক্ষকদেরও দেওয়া হয়।
বিষয়টি শিক্ষকদের দৃষ্টিগোচর হলে তারা প্রতিবাদ জানিয়ে ক্লাস বর্জন করেন। জিল্লুর রহমান নামে প্রশিক্ষণার্থী এক শিক্ষক ঢাকা মেইলকে বলেন, বইয়ের ভেতরে পাতায় পাতায় বিভিন্ন জায়গায় 'জাতির পিতা' বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লেখা; তার জীবনী, তার গুণকীর্তন আরবিতেও লেখা, বাংলাতেও লেখা। এগুলো লিখে পাতায় পাতায় রাখা আছে, এগুলো আমাদেরকে দিল। আর এই ম্যানুয়াল দিল প্রশিক্ষণ শুরু হওয়ার ৮ দিন পরে।
তিনি বলেন, ওখানে কারা আছে, উদ্দেশ্যটা কী, যে শিক্ষকদের হাতে এরকম ডকুমেন্ট তুলে দেওয়া হচ্ছে। আমরা ক্ষোভ, তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। এতগুলো শিক্ষার্থী জীবন দিল, এত মানুষের প্রাণ গেল, সেই রক্তের বন্যায় সাঁতার কাটা অবস্থায় কেন এসব এখনো হাতে পাচ্ছি? এই নামগুলো কেন আসছে? এরকম কেন করছে এবং ওখানে কারা-ই বা আছে, এসব খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
জিল্লুর রহমান আরও বলেন, উদ্দেশ্যমূলকভাবে এগুলো করছে। আমরা প্রাথমিকভাবে ক্লাস বর্জন করেছিলাম। কর্তৃপক্ষ আমাদের বলেছে, আগেও সমস্যা হয়েছে। আগেও যদি সমস্যা হয়, কেন সংশোধন করলো না? আমরা জেলা প্রশাসক মহোদয়কে অবহিত করেছি। বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ফ্যাসিস্টের দোসরদের পরিকল্পিত অপচেষ্টা নস্যাৎ করতে হবে। এই ম্যানুয়াল বাতিল করে প্রশিক্ষণ চলমান রেখেই নতুন করে ম্যানুয়াল দিতে হবে।
মো. সেরাজুল ইসলাম নামে এক প্রশিক্ষণার্থী ক্ষোভ প্রকাশ করে ঢাকা মেইলকে বলেন, ভারত শেখ হাসিনার পতন মেনে নিতে পারছে না, বিধায় তার শিক্ষা দিয়েই এখন আবার আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে।
মো. বদিউজ্জামান নামে আরেক প্রশিক্ষণার্থী শিক্ষক ঢাকা মেইলকে বলেন, আমরা শিক্ষক সমাজ ট্রেনিং করতে এসে দেখতে পেলাম, 'শিক্ষা নিয়ে গড়ব দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ'। এটায় অত্যন্ত আমরা ব্যথা পেয়েছি। আমরা বারবার বলছি ও প্রতিবাদ করছি, আজকে সেই ফ্যাসিবাদ সরকারের দোসররা আছে। আমার মনে হয়, প্রশিক্ষণে এসে আমরা এখানেও এটা দেখতে পাচ্ছি। এটা গভীর ষড়যন্ত্র মনে হচ্ছে। আমরা জোরালো প্রতিবাদ জানাচ্ছি।
এ বিষয়ে কোর্স কো-অর্ডিনেটর এ কে এম ফজলে রাব্বীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি। এ ব্যাপারে কথা হয় রাজশাহী সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের (টিটিসি) উপাধ্যক্ষ প্রফেসর ড. বিশ্বজিৎ ব্যানার্জীর সঙ্গে। তিনি সাংবাদিক পরিচয় শুনেই বলেন, ‘এটা আপনার-আমার দেখার দায়িত্ব না। এগুলো মন্ত্রণালয় দেখবে, এসবের দায়-দায়িত্ব তাদের।’ উপাধ্যক্ষ নিজেও শিক্ষকদের ক্লাস নেন বলে তিনি স্বীকার করেন। ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, ‘আমি শিক্ষা প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা ক্লাস নিয়ে থাকি। আপনি চিফ কো-অর্ডিনেটরের সঙ্গে কথা বলেন।’
এ ব্যাপারে রাজশাহী সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের অধ্যক্ষ ও কোর্সের চিফ কো-অর্ডিনেটর প্রফেসর মো. শওকত আলী খান ঢাকা মেইলকে বলেন, উদ্বোধনের সময় অধিদফতরের ডিজি ও কোর্সের পিডিসহ সংশ্লিষ্ট উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা সবাই উপস্থিত ছিলেন। আমরা বই ছাপাইনি, বইয়ে সংযোজন-বিয়োজন করার সুযোগও আমাদের নেই। যা পাঠানো হয়, তা দিয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি। বিষয়টি মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি। আগামীতে এই ম্যানুয়াল আর দেওয়া হবে না।
এ বিষয়ে রাজশাহী জেলা প্রশাসক আফিয়া আখতার ঢাকা মেইলকে বলেন, আমি অবগত হয়ে ম্যানুয়ালগুলো ক্লোজ করে নিতে বলেছি। আমাদের একজন অফিসার গেছেন মনিটর করার জন্য। ইনভেস্টিগেশন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জানতে চাইলে মাদরাসা শিক্ষা অধিদফতরের উপ-পরিচালক (প্রশিক্ষণ) মো. শরিফুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, 'রাজশাহীতে যে প্রোগ্রামটা চলছে, এটা আমাদের অধিদফতরের না। সবকিছুই আমাদের অধিদফতরের, তবে এটা আলাদা প্রজেক্টের টিমের আন্ডারে। ওই টিম পরিচালনা করে। ওই টিমের সাথে আমরা জড়িত না। আমাদের মহাপরিচালক স্যর টিমের প্রধান।' তবে এসব ব্যাপারে মাদরাসা শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক ও টিমের প্রধান (অতিরিক্ত সচিব) ড. শাহনওয়াজ দিলরুবা খানের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
প্রতিনিধি/এইউ