জেলা প্রতিনিধি
২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৫:৪৯ পিএম
পারুল আক্তার (ছদ্মনাম) যখন ক্লাস সেভেনে পড়ে তখন শেরপুর শহরের নৌহাটা মহল্লায় বিয়ে হয়। এরপর ক্লাস অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় হয় বিচ্ছেদ। ক্লাস নবম শ্রেণিতে যখন বার্ষিক পরিক্ষা দেন, তখন বিয়ে হয় শ্রীবরদী উপজেলার কুড়িকাহনিয়ায়। এরপর এসএসসি পরিক্ষা শেষে হয় বিয়ে বিচ্ছেদ। বছর না ঘুরতে ফের পারুল বসেন বিয়ের পিড়িতে। এবার পারুলের বিয়ে হয় সদর উপজেলার চরশেরপুরে। পারুলের সংসারে এখন চলছে সম্পর্কের টানাপোড়েন। আওয়াজ উঠছে তালাকের। মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে উঠে পারুল।
মা বাবার অনুগত মেয়ে পারুল আক্তারের সঙ্গে কথা হলে তিনি ঢাকা মেইলকে জানান, কোনো ঘরেই সে সংসার করতে অরাজি ছিলেন না। সবকিছু ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিলেন এ তরুণী। এ চিত্র অনেক পরিবারেই।
সীমান্তবর্তী শেরপুর জেলায় গত এক বছরে যতগুলো বিয়ে নিবন্ধন করা হয়েছে সেই হিসেবে অপরদিকে ৪৪ শতাংশ বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে। এ ক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় বিচ্ছেদে নারীরাই বেশি আগ্রহী বলে জানা গেছে। জেলায় দিন দিন আশঙ্কাজনক হারে বেড়েই চলেছে বিবাহ বিচ্ছেদের হার।
খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যখন চরমভাবে বিরোধ দেখা দেয়, মিলেমিশে শান্তিপূর্ণভাবে জীবনযাপন যখন অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়, তখন মধুর সম্পর্ক তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদের মাধ্যমে ছিন্ন করা হয়। জেলার বিভিন্ন এলাকায় বিবাহ বিচ্ছেদের পেছনে বড় কারণগুলো হলো দাম্পত্যজীবনে বনিবনার অভাব, যৌতুক, বাল্যবিবাহ এবং বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক। তবে শেরপুরে তালাকের মধ্যে শিক্ষিত লোকের সংখ্যাই বেশি। সাধারণ মানুষের মধ্যে এই প্রবণতা কিছুটা কম। তবে পরিবারের অমতে লুকিয়ে করা প্রেম ঘটিত বিয়ে ভাঙার হার বেশি। যে সব প্রেমের বিয়ে পরিবারের সদস্যদের সম্মতিক্রমে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পন্ন হয়েছে সেগুলো ভাঙার হার খুব কমই।
এ ছাড়াও জেলায় কিছু কিছু পরিবারে দীর্ঘ দিন সন্তান না হওয়ার ক্ষেত্রে বিচ্ছেদ হলেও পরিমাণে আগের তুলনায় কমেছে। জেলার বিভিন্ন পৌরসভা ও ইউনিয়নে দায়িত্বরত কাজী ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সাথে কথা বলে উঠে আসে এই চিত্র।
শেরপুর জেলা রেজিস্ট্রার অফিসের তথ্যমতে, গত ১ বছরে শেরপুরে বিবাহ বিচ্ছেদ তুলনামূলকভাবে বেড়েছে। ২০২৩ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ১ বছরে জেলায় মোট বিবাহ নিবন্ধন হয়েছে ৮ হাজার ৭২০টি। এর মধ্যে শেরপুর সদর উপজেলার ২ হাজার ৫৮৯টি, নকলা উপজেলায় ৯৮৯টি, নালিতাবাড়ি উপজেলায় ২ হাজার ৩৮৬টি, শ্রীবরদী উপজেলায় ১ হাজার ৭১৩টি ও ঝিনাইগাতী উপজেলা ১ হাজার ৪৩টি। ঠিক এই একই সময়ে তালাক নিবন্ধন হয়েছে ৩ হাজার ৮৪৪টি। যা মোট বিবাহ নিবন্ধনের ৪৪ শতাংশ। এর মধ্যে শেরপুর সদর উপজেলায় ১ হাজার ৯১টি, নকলা উপজেলায় ৫১১টি, নালিতাবাড়ি উপজেলায় ৯২১টি, শ্রীবরদী উপজেলায় ৮৯৫টি ও ঝিনাইগাতী উপজেলায় ৪২৬টি।
হিসেবে আনুপাতিক হারে জেলার শ্রীবরদী উপজেলায় সবচেয়ে বেশি বিবাহ বিচ্ছেদ হয়েছে যা ৫২.২৫ শতাংশ এবং সবচেয়ে কম বিবাহ বিচ্ছেদ হয়েছে নালিতাবাড়ি উপজেলায় যা ৩৮.৬০ শতাংশ। তবে বিয়ে যত ধুমধামের মধ্যে দিয়ে হয় তালাক সেভাবে সম্পন্ন হয় না। তালাক প্রক্রিয়া অনেক পরিবার অতি গোপনে সম্পন্ন করায় অনেক তালাক নিবন্ধনের আওতায় আসে না। তাই সংশ্লিষ্টদের ধারণা প্রকৃত বিবাহ বিচ্ছেদের সংখ্যা আরও বেশি হবে।
একাধিক কাজী ঢাকা মেইলকে জানায়, আগে তালাকের প্রধানতম কারণ ছিল দারিদ্রতা বা পারিবারিক ব্যয় বহনের অক্ষমতা। সেইসঙ্গে শ্বশুর-শাশুড়ির দ্বন্দ্বের জের ধরে পারিবারিক অশান্তি শেষে তালাক। এ ছাড়াও নানা কলহ-বিবাদের জেরে স্বামী কর্তৃক স্ত্রীর শারীরিক নির্যাতনের ফলে। এ সমস্যাগুলো যেসব এলাকায় অভাব-দারিদ্র্য বেশি সেসব এলাকায় বেশি হতো। অনেক ক্ষেত্রে গ্রামের দরিদ্র বাবা-মার সন্তান লালন-পালনের সক্ষমতা কম থাকায় মেয়ে সন্তান একটু বড় হলেই বিয়ে দিয়ে দিত। তুলনামূলক অনেক বেশি বয়সের স্বামীর ঘর করতে না পারায় হতো তালাক। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ধর্মীয় অনুশাসন কমে গিয়ে নৈতিক অবক্ষয় বেড়ে যাওয়া অবাধ তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহারে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক স্থাপনের হার বৃদ্ধি পাওয়ায় তালাক বেশি হচ্ছে। আধুনিক যুগে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রেম যতটাই বেশি, বিচ্ছেদও ঠিক ততটাই। সবচেয়ে বেশি বিবাহ বিচ্ছেদ হয় ভালোবাসার অভাব ও নিজেদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির কারণে। বর্তমানে সম্পর্কের দুজনেই দুজনের ভুল ধরতে ব্যস্ত। শোধরাতে নয়। তাই সব শেষে বিয়ে ভেঙে দেওয়ার রাস্তায় হাঁটেন তারা। এছাড়াও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, মূল্যবোধের অবক্ষয়ও এর জন্য দায়ী।
শেরপুর পৌরসভার ৮ ও ৯ নং ওয়ার্ডের কাজি আবুজর আল আমিন বলেন, আমি প্রতিদিনই বিয়ের নিবন্ধন করি। আবার তালাক নিবন্ধনও করি। আমি বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার পর স্বামী ও স্ত্রী উভয় পক্ষকে কাবিননামার বিষয়বস্তু ভালোভাবে বুঝিয়ে দিয়ে দুই পক্ষকে নকল প্রদান করি। আগে তাকাল রেজিস্ট্রেশন কম হতো, এখন অনেক বেড়েছে। যা খুবই দুঃখজনক ও আশঙ্কাজনক। আমার দেখায় শিক্ষিতরা তালাকে সব চেয়ে এগিয়ে। আগে ছেলেদের পক্ষ থেকে তালাক বেশি হতো। এখন মেয়েদের পক্ষ থেকে তালাক বেশি হচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মেয়েদের অতিরিক্ত জেদের কারণে তালাক হচ্ছে। এবং এটার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। এছাড়াও মেয়েদের অনেক অভিবাবক তাদের অনেক বিষয়ে ছাড় না দেওয়াও একটি কারণ।
বিবাহ এবং দাম্পত্য জীবন নিয়ে কথা হয় শ্রীবরদী ইসলামীয়া কামিল মাদ্রাসার মুহাদ্দিস আলহাজ্ব আমির হামজার সঙ্গে। তিনি বলেন, ইসলামে সবচেয়ে অপছন্দের বৈধ বিষয় তালাক। ইসলাম সংসার ভাঙাকে পছন্দ করে না। তবে নিরুপায় অবস্থায় তালাক দেয়ার অনুমতি দিয়েছে ইসলাম। প্রাথমিকভাবে বুঝানো, ছাড় দেয়া, পরিবারের মুরুব্বিদের মাধ্যমে বুঝানো।
মহান আল্লাহ তায়ালা সূরা নিসার ৩৫নং আয়াতে বলেন, তোমরা যদি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কলহ সৃষ্টির আশঙ্কা করো, তবে মীমাংসার জন্য পুরুষের পরিবার থেকে একজন সালিস ও নারীর পরিবার থেকে একজন সালিস পাঠিয়ে দেবে। তারা দু’জন যদি মীমাংসা করতে চায়, তবে আল্লাহ উভয়ের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি করে দেবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্ববিষয়ে জ্ঞাত ও সর্ববিষয়ে অবহিত।
দারুল আমান মডেল মাদরাসার ভাইস প্রিন্সিপাল মাওলানা হাফিজুর রহমান বাতেন বলেন, বর্তমান সময়ে ইন্টারনেটের মাধ্যমে যোগাযোগ সহজলভ্য হওয়ায় বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে জড়াচ্ছে নারী-পুরুষ। তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ ব্যবহারের কুফলগুলোর মধ্যে এটি একটি। তবে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে জীবন পরিচালনার করলে কখনোই কোনো মানুষ বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে জড়াবে না। কোনো সুযোগই নেই। প্রতিটি ধর্মেই এই মর্মবাণীগুলোই আছে।
মাওলানা হাফিজুর রহমান বাতেন আরও বলেন, হাদিস শরিফে এসেছে; পরিস্থিতি এমন ভয়াবহ অবস্থায় পৌঁছে যায় যে মীমাংসার সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়, তখন ইসলামি শরিয়তে স্বামীকে তালাক দেয়ার এখতিয়ার দিয়েছে। তবে ইসলামের দৃষ্টিতে তালাক দেয়া অত্যন্ত অপছন্দনীয় ও ঘৃণিত কাজ। হাদিস শরিফে আছে, মহান আল্লাহর কাছে বৈধ কাজগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ঘৃণিত কাজ হলো তালাক।
সুতরাং ঠান্ডা মাথায় ভেবে-চিন্তে তালাকের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
জানতে চাইলে অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম বলেন, বিবাহবিচ্ছেদ দিন দিন বেড়ে যাওয়ার মূল কারণ হচ্ছে তথ্য প্রযুক্তির অবাধ প্রবাহ, ভারতীয় টিভি চ্যানেলের সিরিয়াল, পরকীয়া, অপরিণত বয়সে বিয়ে, পারিবারিক বন্ধনে দূরত্ব সৃষ্টির পাশাপাশি মানুষের মধ্যে শ্রদ্ধাবোধ কমে যাওয়া। এ থেকে পরিত্রাণের পথে এগোতে হবে।
শেরপুর জেলা রেজিস্টার কৃষিবিদ মো. নূর নেওয়াজ বলেন, আমরা শুধু বিবাহ রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করি। হোক সেটা বিবাহ অথবা তালাক। আমাদের এর বাইরে আর কোনো কাজ নেই। তবে প্রত্যেক কাজীই বিবাহ নিবন্ধনের সময় স্বামী এবং স্ত্রীর হক ও দ্বায়িত্ব কর্তব্যসমূহ উভয়কেই জানিয়ে দেয়। যেন তারা তাদের দাম্পত্য জীবনে নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে পারে। এ ছাড়াও বিয়ে সম্পন্ন করে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলারও পরামর্শ ও পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে সভা সেমিনার, কাউন্সিলিংয়ের পরামর্শও দেন তিনি।
মানবাধিকার কর্মী ও হিউম্যান রাইটস সোসাইটির চেয়ারম্যান আনোয়ার-ই-তাসলিমা প্রথা ঢাকা মেইলকে বলেন, বিভিন্ন এলাকায় বিবাহ বিচ্ছেদের পেছনে বড় কারণগুলো হলো দাম্পত্যজীবনে এক অপরের ছাড় দেওয়ার মনমানুষিকতার অভাব, সংসারে বনিবনার অভাব, যৌতুকের চাহিদা, বাল্যবিবাহ এবং বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক। ভরণপোষণের ব্যয় বহন করতে অসামর্থ্য অথবা অস্বীকৃতি, পারিবারিক চাপ, শারীরিক নির্যাতন, যৌন অক্ষমতা বা অনীহা ইত্যাদিও কারণেও তালাক হচ্ছে। তবে স্বামীর অনুপস্থিতিতে স্ত্রী বা স্ত্রীর অনুপস্থিতিতে স্বামী অন্য কারও সঙ্গে মেলামেশা এখন বিবাহ বিচ্ছেদের একটি বড় কারণ হয়ে পড়েছে। ধর্মীয় অনুশাসন, সামাজিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত হলে কমে আসবে তালাকের পরিমাণ।
প্রতিনিধি/ এজে