নিজস্ব প্রতিবেদক
০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:৫৪ এএম
স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় চট্টগ্রামে এক লাখ ৫৩ হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। যা কৃষি উৎপাদনসহ খাদ্য নিরাপত্তায় বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সংশ্লিষ্টদের মতে, জমিতে লাগানো আমন ধান ও বীজতলা একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। নতুন করে বীজতলা তৈরি করে চারা গজিয়ে চাষাবাদ করা আদৌ সম্ভব হবে কি না তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। ফলে কৃষি সেক্টরে মারাত্নক রকমের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।
শনিবার (৭ সেপ্টেম্বর) এসব তথ্য জানান চট্টগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আবদুচ ছোবহান। তিনি বলেন, চট্টগ্রামে ধানচাষের একটি বড় অংশ দখল করে থাকে আমন। প্রচুর ফলন আসে এই মৌসুমের চাষ থেকে। কৃষকেরা তাদের জমিতে একটু আগেভাগে আমন লাগিয়ে দ্রুত ফসল ঘরে তুলতে চান। এবারও প্রচুর জমিতে আমনের চাষ হয়েছিল চট্টগ্রাম কৃষি অঞ্চলের এলাকাগুলোতে। ফলে হাজার হাজার একর আমন চাষ সম্পুন্ন করে কৃষকেরা যখন উৎসবমুখরভাবে ঘরে ফিরলেন, তখনই ভয়াল বন্যা সব তছনছ করে দিল। অতিবৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি, মিরসরাই, হাটহাজারী, রাউজান, রাঙ্গুনিয়া এবং কুমিল্লা, নোয়াখালী ও ফেনী জেলার প্রত্যন্ত এলাকা ভয়াবহ বন্যা কবলিত হয়। এতে ঘরবাড়ি, গবাদি পশু, মাছসহ ব্যাপক ফসল ও প্রাণহানি ঘটে।
এই কৃষি কর্মকর্তা বলেন, ফেনী ও কক্সবাজার জেলা মূলত ধান উৎপাদন এলাকা। চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড, মীরসরাই, ফটিকছড়ি অঞ্চলেও প্রচুর ধানচাষ হয়ে থাকে। চট্টগ্রাম খাদ্য ঘাটতির একটি অঞ্চল। এখানে প্রচুর বাইরের লোকের বসবাস হওয়ায় এই অঞ্চলটিতে খাদ্য ঘাটতি রয়েছে। যা দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে এনে জোগান দিতে হয়।
বন্যায় শুধুমাত্র চট্টগ্রামেই প্রায় ৫০০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে উল্লেখ করে ওই কর্মকর্তা বলেন, আসলে টাকার অংকে এই ক্ষতি নিরূপণ করা যাবে না। একজন কৃষক তার সর্বস্ব খরচ করে চাষাবাদ করলেন। তা ধ্বংস হয়ে গেল। এখন নতুন করে আবার চাষ করার মতো অবস্থা ওই কৃষকের নেই। হয়তো দেখা যাবে জমিটি খালি পড়ে রয়েছে। কোনো ফসলই ওই জমি থেকে এই মৌসুমে আর পাওয়া যাবে না। এই ক্ষতির প্রভাব ব্যাপক বলেও তিনি মন্তব্য করেন। ফসলপ্রাপ্তি নিয়ে যে অনিশ্চয়তা তৈরি হল তা সামাল দেওয়া কঠিন হবে।
তবে আমরা কিছুটা আশাবাদী যে, চট্টগ্রামে আমন ধান কিছুটা দেরিতে লাগানো হয়। আগামী ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমন লাগানো যাবে। তবে চারার যেই সংকট তা কাটিয়ে ওঠা গেলে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা কিছুটা হলেও ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, বৃহত্তর চট্টগ্রামের কৃষি অঞ্চলে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ফেনী, নোয়াখালীসহ ৫টি জেলা, ৪২টি উপজেলা ও ৩টি মেট্রোথানার ১৪ হাজার ৪২৩ দশমিক ২২ বর্গকিলোমিটার আয়তনের বিস্তৃত এই অঞ্চল বন্যার পানিতে তলিয়ে যায়। এতে প্রায় দুই কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পুরোপুরি ডুবে নষ্ট হয়ে যায় এ অঞ্চলের প্রধান ফসল ধান, বিভিন্ন ফলমূল ও শাকসবজি।
এতে প্রায় এক লাখ ৫৩ হাজার ১০৩ হেক্টর জমির ফসল পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। এর মধ্যে শুধুমাত্র চট্টগ্রাম জেলার সীতাকুন্ড, মীরসরাই, ফটিকছড়ি, লোহাগাড়া, সাতকানিয়া, চন্দনাইশ ও বাঁশখালী উপজেলার ধানি জমিতে বন্যা মারাত্নকভাবে প্রভাব ফেলেছে। ওই সাত উপজেলায় বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে ১ হাজার ৯২২ হেক্টর সবজি বাগান। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আউশ ও আমন খেত। আমন ধানের উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রায় অর্জিত না হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
কৃষি অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে আমনের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে উল্লেখ করে বলেছেন, টাকার অংকে চট্টগ্রামে আমনের ক্ষতি ২৫২ কোটি টাকা উল্লেখ করে সরকারের কাছে রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এই ক্ষতি অপূরণীয় বলেও তারা মন্তব্য করেছেন। মাঠ কর্মকর্তারা জানান, আমনের ক্ষয়ক্ষতি এত ব্যাপক হয়েছে যে বহু কৃষকই নিঃস্ব হয়ে গেছেন।
কৃষি অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চট্টগ্রাম জেলায় এবার ১ লাখ ২ হাজার হেক্টর জমিতে আমন চাষ করা হয়। এর মধ্যে বন্যায় তলিয়ে গেছে ৪৩ হাজার ৫০০ হেক্টর জমির ফসল। তলিয়ে যাওয়া আমন ক্ষেতের মধ্যে ১৩ হাজার ৮৩১ হাজার হেক্টর জমির ধান সম্পূর্ণরূপে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চট্টগ্রামে এই বন্যায় মোট ১ লাখ ৬১ হাজার ৩৭১ জন কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যাদের অনেকেরই আর চাষাবাদ করার মতো সামর্থ নেই।
আবার চলতি মাসেই আউশ ধান ঘরে তোলার কথা ছিল কৃষকদের। কিন্তু বন্যায় তাও নষ্ট করে দিয়েছে। চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায় ৩৩ হাজার ১ হেক্টর জমিতে আউশের চাষ হয়েছিল। এর মধ্যে ৮ হাজার ৩৮৩ হেক্টর জমির ফসল পানিতে তলিয়ে নষ্ট হয়ে গেছে। এতে কোটি কোটি টাকার ফসলহানি হয়েছে বলেও কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
চট্টগ্রামে আমন এবং আউশ ধানের যে ক্ষতি হয়েছে তা খাদ্য ঘাটতির এই জেলাটিতে মারাত্নক রকমের প্রভাব ফেলবে বলে মন্তব্য করে বলা হয়েছে, এই ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে কৃষকদের বেশ বেগ পেতে হবে।
প্রতিনিধি/টিবি