জেলা প্রতিনিধি
০২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৫:৪১ পিএম
‘সোনালী আঁশের দেশ বাংলাদেশ’ বলা হলেও বর্তমানে অর্থকরী ও জাতীয় সফল পাটের চাষ ঠাকুরগাঁওয়ে বিলুপ্তির পথে। যেখানে আগে ব্যাপকভাবে পাট চাষ হতো এ জেলায়। সেখানে এখন এর আবাদ হারিয়ে যেতে বসেছে। প্রকৃত চাষিরা প্রণোদনা না পাওয়ায় ও পাটের ফলন, জাগ দেওয়ার ব্যবস্থার অভাবে ও দামের কারণে গতবছরের তুলনায় এবার তিন ভাগের এক ভাগও পাট চাষ হয়নি, বলছেন কৃষকরা।
অন্যদিকে পাট অধিদফতর ও কৃষিবিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ক্রমান্বয়ে চাষ কমলেও কৃষকদের প্রণোদনার মাধ্যমে পাট চাষে আগ্রহ বৃদ্ধির কারা হচ্ছে। তবে অন্তরায় হিসেবে পাটের ন্যায্য মূল্য ও জাগ ব্যবস্থাপনাকে দায়ি করছেন তারা।

একটা সময় পাটের সোনালী দিন থাকলেও বর্তমানে এর চিত্র ভিন্ন। চলতি বছর পাটের মৌসুমে জেলায় দেখা যায়, ভালো মানের বীজ, পরামর্শ ও ক্ষেতের সঠিক পরিচর্যার অভাবে দিন দিন পাটের চাষাবাদ কমছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালকের তথ্য মতে, বিগত পাঁচ বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে জেলায় পাটের আবাদ হয়েছিল ৫ হাজার ৮৬০ হেক্টর জমিতে আর উৎপাদন হয়েছিল ১৩ হাজার ১৩৭ মেট্রিক টন কিন্তু ২০২৪ সালে আবাদ হয়েছে ৬ হাজার ১৭০ হেক্টর জমিতে ও পাট উৎপাদন হয়েছে মাত্র ১২ হাজার ৮৭৪ মেট্রিক টন। ১৯ সালের তুলনায় এ বছর ৩১০ হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ বেশি হলেও বিগত ১৯ সালের ফলন অনুযায়ী ২৬৩ মেট্রিক টন পাট কম উৎপাদন হয়েছে।

ঢাকা মেইলকে দেওয়া জেলা পাট উন্নয়ন কর্মকর্তার তথ্য মতে, জেলার পাঁচটি উপজেলার মধ্য শুধু চারটি উপজেলার ১০ হাজার ১৯৩ জন চাষিকে পাট চাষের জন্য প্রণোদনা প্রদান করা হয়েছে। এতে প্রত্যেককে ১ কেজি করে বীজ, ৬ কেজি ইউরিয়া, ৩ কেজি টিএসপি ও ৩ কেজি এমওপি সার ছাড়াও প্রশিক্ষণ বাবদ ৫০০ টাকা সম্মানিসহ, ৩০০ টাকা খাওয়া বিল, নাস্তা বাবদ ৮০ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। তাছাড়াও খাতা, কলম ও ব্যাগও প্রদান করা হয়। অন্যদিকে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর থেকেও ৩ হাজার ৬০০ জন কৃষককে প্রণোদনা হিসেবে বীজ ও সার প্রদান করা হয়েছে। প্রতি বছর হাজার হাজার কৃষককে পাট চাষ বৃদ্ধির জন্য প্রনোদনা হিসেবে বীজ, সার ও প্রশিক্ষণ প্রদান বাবদ কোটি কোটি টাকা ব্যয় করলেও এর কোনো উল্লেখযোগ্য সুফল দেখা যায়নি।

পাট চাষিরা বলছেন, কোনো ধরণের প্রণোদনা পাননি। এতে তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, পানির অভাবে দিন দিন পাট জাগ দেওয়া থেকে শুরু করে, পাটের রোগ বালাই ও খরচ বৃদ্ধি, সে তুলনায় ফলন ও দাম কম হওয়ার কারণে, গত বছরের তুলনায় এবার তিন ভাগের এক ভাগও জেলায় পাট চাষ হয়নি। গত বছর যারা পাট করেছিল তাদের অনেকে এবার কোনো পাট আবাদ করেননি। যারা করেছেন তারাও খুবই কম করেছেন। তাই এ সোনালী ফসলের চাষ বৃদ্ধি করার জন্য প্রকৃত কৃষকদের সরকারি সহায়তা প্রদানসহ পাটের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করার অনুরোধ জানান তারা।

মো. আনিসুর রহমান নামে পাট চাষি বলেন, ৫০ শতাংশের এক বিঘা জমিতে পাট চাষ করতে প্রায় ৩০-৩৫ হাজার টাকা খরচ হয়। বর্তমান পাটের বাজার দর অনুযায়ী পাট বিক্রি করে আমাদের পাট খড়ি গুলো টিকে না। খরচ অনুযায়ী আমরা ন্যায্য দাম পাই না। অন্যান্য বারের তুলনায় এবার পাটের দাম ও ফলনও কম। এ কারণে গতবার যারা পাট করেছিলেন তাদের অনেকেই এবার পাট চাষ করেননি। আর আমরা যারা প্রকৃতি পাট চাষি আছি তারা সরকারি সার বীজ থেকে শুরু করে কোনো ধরেণের সহযোগিতা পাইচ্ছি না। কৃষকরা যাতে আগামীতে পাট করতে আগ্রহী হয় তাই বর্তমান সরকারকে অনুরোধ করেন পাটের দাম বৃদ্ধি করে কৃষকদের ন্যায় মূল্য প্রদানের জন্য।

কৃষক আব্দুল হামিদ বলেন, আমি তো সরকারি কোনো সহযোগিতাও পাইনি। ঠাকুরগাঁওয়ে আগে ব্যাপক পাটের চাষ হতো। গতবছরের তিন ভাগের তুলনায় এবার এক ভাগও পাট চাষ করেনি কৃষকরা। এবার যা হয়েছে আগামীতে এটাও আর চাষ হবে না মনে হয়। গতবার আমি পাট করেছিলাম দেড় বিঘা এবার করেছি মাত্র ২৫ শতক। তাও পানির অভাবে ঠিকভাবে পাট পচাইতে পারি না। পাট কাটতে শুধু এবার খরচ গেছে ১৫ হাজার টাকা। এছাড়া তো সার-বিষ, পাট ধুয়ার খরচ আলাদা। পাট আবাদ করতে এবার খরচ লেগেছে অতিরিক্ত।

পাট চাষি হামিদুল রহমান বলেন, কিছু আগে ২ হাজার ৬০০-৭০০ টাকা পাটের মণ ছিল কিন্তু তা কমে এখন ২ হাজার ৫০০ টাকায় এসেছে। এতে বিঘা প্রতি প্রায় ১০ হাজার টাকা লস হচ্ছে।
মো. রশিদুল ইসলাম নামে আরেক পাট চাষি বলেন, গত বছর আমি এক বিঘা জমিতে পাট করেছিলাম। এবার আমি ১০ কাঠা জমিতে আবাদ করেছি। গেলবারের থেকে এবার আরও পাটের দাম কম। আমরা যারা পাট আবাদ করছি তারা ন্যায্য মূল্য পাচ্ছি না। এক বিঘা জমির পাট বিক্র হচ্ছে ২৫-৩০ হাজার টাকা আর খরচ হয়েছে ৩০-৩৫ হাজার টাকা। এভাবে তো আর পাট চাষ করা যায় না।

কৃষক সাইফুল ইসলাম বলেন, সরকারি ভাবে বলে পাট চাষিদের সার বীজ ও টাকা দেওয়া হয়। কই আমি তো কিছুই পাইনি। যারা পাট আবাদ করি আমরা যদি সহযোগিতা না পাই। তাহলে কারা পায়। আগামীতে সরকার পাট চাষিদের বিষয়ে পদক্ষেপ না নিলে ও সহযোগিতা না করলে পাটের আবাদ হয়তো উঠে যাবে। কেউ আর লস করে পাট আবাদ করবে না।

প্রণোদনার বিষয়ে জানতে চাইলে, জেলা পাট উন্নয়ন কর্মকর্তা অসীম কুমার মালাকার এর সদ উত্তর না দিয়ে ঢাকা মেইলকে বলেন, কৃষকদের তালিকা, কেনা-কাটা সহ প্রণোদনা প্রদানের কাজ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা করে থাকেন। কিন্তু তিনি আবার এউ বলেন যে, আমরা পাটের চাষ ও উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য প্রতিবছর কৃষকদের প্রশিক্ষণ, সার, বীজ ও সম্মানী ভাতা দিয়ে উদ্বুদ্ধ করি। আর দেশে পাট বীজের সংকট থাকায় ৯০ ভাগ বীজ আমাদের আমদানী করতে হয় ভারত থেকে। তাই আমরা ভালো মানের বীজ উৎপাদনের ব্যবস্থা গ্রহণ করি কৃষদের মাধ্যমে এবং তাদের সেই বীজ আবার আমরা প্রকল্পের আওতায় প্রতিকেজি ২০০ টাকা দরে ক্রয় করে নিই।

অন্যদিকে বন্ধ হয়ে যাওয়া পাট মিল ও ক্রয় কেন্দ্র গুলো পুনরায় চালু করার দাবি জানান স্থানীয় চাষি থেকে শুরু করে পাট ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা।
এদিকে প্রতিবছর পাটের আবাদ ক্রমান্বয়ে কমে যাওয়ার কথা বলে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক মো. আলমগীর কবির ঢাকা মেইলকে বলেন, পাটের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রতিবছরের ন্যায় এবারও কৃষকদের প্রণোদনা প্রদান করা হয়েছে। কৃষকদের রিবন রেটিং পদ্ধতিতে পাট পচানোর পরামর্শ প্রদানসহ কারিগরি সহায়তা প্রদান অব্যাহত আছে। বন্ধ পাট কল গুলো চালু করা। ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত ও উন্নত প্রযুক্তি মাধ্যমে পাট পচানোর কারিগরি সহায়তা এবং কৃষকদের আর্থিক সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে পাটের হারানো সেই সোনালী দিন ফেরানো সম্ভব। এছাড়াও আগামীতে অধিকতর স্বচ্ছতার মাধ্যমে কৃষকদের তালিকা প্রণয়ন। অ্যাপসভিত্তিক ও ওয়েবসাইডে তালিকা প্রকাশ করার ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও বলেন তিনি।
প্রতিনিধি/ এজে