জেলা প্রতিনিধি
১২ আগস্ট ২০২৪, ০৯:২৬ পিএম
বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে নাজিম উদ্দিন (১৭)। গ্রামের স্কুল থেকে চলতি বছর এসএসসি পাশ করে গত ১৬ জুলাই কলেজে ভর্তি হয় নাজিম। এর দুদিন পরই রাজধানীর উত্তরা এলাকায় বাবা-মায়ের কাছে চলে যায় নাজিম। দেশ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে তখন উত্তাল। সেখানে গিয়েই শিক্ষার্থীদের সাথে আন্দোলনে যোগ দেয় নাজিম।
তবে বিজয়ের মুহূর্তে গত ৫ আগস্ট বিকেলে উত্তরা পূর্ব থানার ভেতর থেকে ছোঁড়া পুলিশের গুলিতে নিহত হয় নাজিম। গুলিটি নাজিমের বাম চোখের ভেতর দিয়ে ঢুকে মাথার পেছন দিয়ে বের হয়ে যায়।
রাতেই তার লাশ গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনার বারহাট্টা উপজেলার ভাটগাঁও গ্রামে নিয়ে আসা হয়। পরদিন সকাল ১০টায় বসত ঘরের সামনেই নাজিমকে দাফন করা হয়।
নাজিম উদ্দিন নেত্রকোনার বারহাট্টা উপজেলার ভাটগাঁও গ্রামের রুস্তম আলীর ছেলে। রুস্তম আলীর এক ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে নাজিম উদ্দিন ছোট। দরিদ্র রুস্তম আলীর থাকার ভিটে ছাড়া আর কোন জমিজমা নেই। রোজগারের জন্য ১০-১১ বছর আগে পরিবারসহ এলাকা ছেড়ে ঢাকা চলে যান রুস্তম আলী। রাজধানীর উত্তরা আজমপুর এলাকায় গিয়ে স্ত্রসহ একটি ফ্যাক্টরিতে কাজ শুরু করেন। ছেলে পড়াশোনার জন্য পাশ্ববর্তী গ্রামে নানার বাড়িতে থেকে যায়। নানার বাড়িতে থেকেই চালিয়ে যাচ্ছিল পড়াশোনা।
নাজিম স্থানীয় চিরাম তাহেরা মান্নান স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে চলতি বছর বিজ্ঞান বিভাগ থেকে ৪ দশমিক ৩৫ জিপিএ পয়েন্ট পেয়ে এসএসসি পাশ করে। পরে গত ১৬ জুলাই বারহাট্টা সরকারি কলেজে ভর্তি হয়ে দুইদিন পর বাবা-মায়ের কাছে রাজধানীর উত্তরা আজমপুর এলাকায় চলে যায়। সেখানে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সাথে আন্দোলনে যোগ দেয়।
নিহতের খবর পেয়ে সোমবার (১২ আগস্ট) বিকেলে বারহাট্টা উপজেলার ভাটগাঁও গ্রামে নাজিম উদ্দিনদের গেলে দেখা যায় ছেলের কবরের পাশে বসে অঝোরে কাঁদছেন তার বাবা রুস্তম আলী। পাশে দাঁড়িয়ে কান্না করছিলেন মা শিমুলা আক্তার ও বোন নাজমা আক্তার। এসময় প্রতিবেশীরা তাদের সান্তনা দিচ্ছিলেন।
নাজিমের বৃদ্ধ বাবা রুস্তম আলী কানে কম শোনেন তাই তিনি কারো কথার জবাব দিতে পারেন না। শুধু এক নাগারে বলে যাচ্ছেন-'আমার একটাই ছেলে আছিন। এইডাই আমার একমাত্র সম্বল। তারে গুলি কইরা মাইরা ফালাইছে। আমার আর কিছু বাকি রইল না। আমি এর৷ বিচার চাই।
নাজিমের মা শিমুলা আক্তার বলেন, জমিজমা নাই গরীব মানুষ ঢাকায় ফ্যাক্টরিতে কাজ করি। যা পাই তা দিয়ে নিজেরা খেয়ে দেয়ে চলি আর ছেলের পড়াশোনার খরচ চালাই। স্বপ্ন ছিল ছেলেটা পড়াশোনা করে একদিন সংসারের হাল ধরবে। পরিবারের অভাব দূর হবে। যখন কাজ করার শক্তি থাকবে না তখন ছেলে চাকরি করে আমাদের ভরণপোষণের দায়িত্ব নেবে। মুহূর্তে আমার সাজানো স্বপ্ন শেষ হয়ে গেল। এখন কি নিয়ে বাঁচবো। কে আমাদের দেখবে, কাকে বাবা বলে ডাকব।
মা শিমুলা আক্তার আরও বলেন, আন্দোলন চলার সময় ফ্যাক্টরি বন্ধ ছিল তাই সবাই বাসায় ছিলাম। জুলাইয়ে শেষ দিকে ঢাকায় এসে আমাদের না জানিয়ে শিক্ষার্থীদের সাথে প্রতিদিনই আন্দোলনে যেত নাজিম। গত ৫ আগস্ট দুপুরের দিকে বের হয়ে বাসা থেকে। বিকাল ৩টার দিকে মোবাইলে কল দিয়ে কোথায় আছে জানতে চাই। সে আমার কল রিসিভ করে বলে-মা চিন্তা কইরো না, একটু পরেই চলে আসতেছি। এটাই তার শেষ কথা ছিল। ৪টার দিকে আবার কল দেই তখন অন্য একজন তার ফোনটা রিসিভ করে জানায় নাজিমের গুলি লেগেছে। আমরা দৌড়ে যাই উত্তরা পূর্ব থানার সামনে। যাওয়ার পর লোকজন জানায় নাজিমকে ঘটনাস্থল থেকে আন্দোলনকারীরা হাসপাতালে নিয়ে গেছে। কতক্ষণ পর তার লাশ পাই।
বোন নাজমা আক্তার জানায়, ঝড়াজীর্ণ একটা ঘর আর ভিটে ছাড়া আমাদের কোন জমিজমা নেই। তাই ঘরের সামনে উঠানেই তাকে দাফন করা হয়েছে। নাজিমই ছিল পরিবারের একমাত্র ভরসা। পড়াশোনা করার প্রচুর ইচ্ছা ছিল তার। মৃত্যুতে সব ভরসা শেষ হয়ে গেল।
নাজিমের চাচা আরব আলী জানান, খুবই শান্ত ছেলে ছিল নাজিম। যে ক্ষতি হয়েছে তা কোনকিছুর বিনিময়ে পূরণ হবার নয়। আল্লাহ তাকে জান্নাত নসীব করুক।
প্রতিনিধি/একেবি