রাতে না ঘুমিয়ে বাবার অপেক্ষায় থাকে শিশু সিনহা

পাঁচ বছরের ছোট্ট শিশু সিনহা। তার বিশ্বাস বাবা দূরে কোথাও কাজে গেছেন। বাসায় ফিরবেন কয়েকদিন পর। কোলে তুলে নিয়ে আদর করবেন। কপালে চুমু দিবেন। দোকান থেকে নাস্তা কিনে দিবেন। মাদরাসায় নিয়ে যাবেন। রাতে বাবার বুকে মাথা রেখে ঘুমাবেন। সেই আশা নিয়ে প্রতিদিন রাতে অপেক্ষায় থাকে সিনহা। গভীর রাত পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়ে। 

সকালে উঠে আবারও বাবা বাবা বলে ডাক শুরু করেন। কিন্তু বাবার দেখা মেলে না। বাড়িতে সবাই আছে শুধু বাবা নেই। বাবা কই আছে সেটা জানেন না সিনহা। এই প্রতিবেদক যখন জিজ্ঞাসা করে ‘তোমার বাবা কই, মলিন মুখে ও ছল ছল চোখে সিনহা উত্তর দেয় জানি না।’

এভাবেই বাবার অপেক্ষায় কাটছে কোটা আন্দোলনের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত সবজি বিক্রেতা সাজ্জাদ হোসেনের মেয়ে সিনহার।

নিহত সাজ্জাদ হোসেনের বাড়ি রংপুর নগরীর কামালকাছনার শিক্ষাঙ্গন এলাকায়। রোববার (২৮ জুলাই) দুপুরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, চারিদিকে সুনসান নিরবতা। দুপুরে খাবার আয়োজনের ব্যস্ততা নেই। সবাই চুপচাপ। বিষন্ন মনে ঘরের মেঝেতে সবাই বসে আছেন। সাজ্জাদের বোনরা সবাই বাড়িতে অবস্থান করছেন। সবাই সাজ্জাদের মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে চিন্তিত। এখন কিভাবে সংসার চলবে, কি হবে সন্তানের ভবিষৎ। 

পরিবারিক সূত্রে জানা যায়, সাজ্জাদ সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ভ্যানে করে এলাকায় আদা, রসুন, পিয়াজ বিক্রি করতেন। ঘটনার দিন দুপুরে জুম্মার নামাজ আদায় করেন। বাড়িতে স্ত্রী না থাকায় হোটেলে ভাত খান। সাজ্জাদের পরিকল্পনা ছিলো পরের দিনের জন্য আদা, রসুন, পিয়াজ কিনে বাসায় রেখে সন্ধ্যায় শ্বশুর বাড়ি যাবেন। শ্বশুরবাড়িতে স্ত্রী-সন্তান কয়েকদিন আগে বেড়াতে গেছেন। তাদের নিয়ে বিয়ের দাওয়াত খেতে যাবেন তিনি। কিন্তু এক গুলিতেই সব শেষ। স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে দাওয়াত খাওয়া আর হলো না সাজ্জাদের। লাশ হয়ে ফিরলেন বাড়ি।

সাজ্জাদ গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন প্রথম এই সংবাদটি পান সাজ্জাদের দুলাভাই আলী হোসেন। এরপর আলী হোসেন সরাসরি সাজ্জাদের মোবাইল ফোনেই ফোন দেন। অপর প্রান্তে ফোন ধরতেই সাজ্জাদ, সাজ্জাদ বলে ডাকতে থাকেন আলী হোসেন। অপর প্রান্ত থেকে বলা হয়, সাজ্জাদ আর নেই। তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। মেডিকেলে লাশ রয়েছে। লাশ নিতে হলে প্রয়োজনীয় কিছু কাগজপত্র লাগবে। পরে আলী হোসেন শ্যালকের মৃত্যুর খবর তার মা ও ছোট ভাইকে জানান এবং শ্বশুর বাড়ি যান প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিতে। পরে মেডিকেল থেকে লাশ বাসায় নিয়ে আসেন এবং পরদিন সকাল ১০ টায় জানাযা শেষে দাফন করা হয়।

সাজ্জাদের দুলাভাই আলী হোসেন বলেন, গত ১৯ জুলাই শুক্রবার সাজ্জাদ হোসেন বিকেল সাড়ে ৪ টা থেকে ৫ টার মধ্যে কৈলাশ রঞ্জন উচ্চ বিদ্যালয়ের গেট দিয়ে সিটি বাজারে যাওয়ার পথে আকস্মিক পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষের মুখোমুখি পড়েন। অবস্থা বেগতিক দেখে একপর্যায়ে লুকাতে গিয়ে একটি গুলি পেটের বাম পাশে লাগে সাজ্জাদের। গুলিটি পেটের বাম পাশে ঢুকে ডান পাশ দিয়ে হাতের কনুই হয়ে বের হয়ে যায়। এসময় কয়েকজন তাকে উদ্ধার করে মৃত ভেবে রিকশায় করে বাড়ির পথে নিয়ে যেতে ধরে। এক পর্যায়ে সাজ্জাদ বলে উঠে আমি বেঁচে আছি। আমাকে বাঁচান। আমাকে মেডিকেল নিয়ে চলেন। এমন আঁকুতি শুনে পায়রা চত্বর থেকে রিকশা ঘুরিয়ে রংপুর মেডিকেল হাসপাতালে নিয়ে যান তারা। হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা সাজ্জাদকে মৃত ঘোষণা করেন। তখন সময় বিকেল সাড়ে ৫ টা।

সাজ্জাদের দুলাভাই আলী হোসেন আরো বলেন, সাজ্জাদরা ৩ বোন ২ ভাই। সাজ্জাদ ভাইদের মধ্যে বড়। সাজ্জাদের বাবা ইউসুফ আলী ৪ বছর হলো মারা গেছেন। সাজ্জাদ ৭ বছর আগে বিয়ে করেছেন নগরীর আনছারী মোড় এলাকায়। সিনহা নামে তার ৫ বছরের এক কন্যা সন্তান রয়েছে। বাড়ির পাশেই বিসমিল্লাহ মাদরাসায় প্লে শ্রেণিতে পড়েন সিনহা। স্ত্রী সন্তান, মা ও এক ভাগ্নিকে নিয়ে তার সংসার। ছোট ভাই বিয়ে করে আলাদা থাকেন। বোনদের সবার বিয়ে হয়েছে। তারা সবাই স্বামীর সংসারে। সাজ্জাদ কখনও রাজমিস্ত্রির কাজ করেন আবার কখনও সবজি বিক্রি করেন। তবে বেশ কিছুদিন ধরে তিনি সবজি বিক্রি করছেন। সংসারে অভাব থাকলেও সুখের অভাব ছিলো না তাদের।

নিহত সাজ্জাদের স্ত্রী জিতু বেগম জানান, ঘটনার দিন সন্ধ্যায় বাবার বাড়ি থেকে আমাকে নিতে যাওয়ার কথা ছিলো। আমাকে নিয়ে রাতে বিয়ের দাওয়াত খেতে যাওয়ার কথা ছিলো তার। সাজ্জাদের (স্বামীর) সাথে শেষ কথা হয় দুপুরের দিকে বলে জানান জিতু। সে সময় কথা হয়েছিলো, দুপুরে জুম্মার নামাজ পরে, একটু বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে পরের দিনের জন্য সবজি কিনে বাসায় রেখে তাদের নিতে যাবে। এটাই ছিলো তার সাথে শেষ কথা। প্রতিবেদকের সাথে কথা বলার সময় কান্নায় ভেঙ্গে পরেন সাজ্জাদের স্ত্রী জিতু। কেন বাজার গেলে সবজি কিনতে আর কেনই বা গুলি লাগলো। আমাদের ছেড়ে কই গেলে তুমি, মেয়েকে কি বুঝ দিবেন, আমার স্বামীতো কোন রাজনীতি করে না। সে তো কোটামোটা কিছু বুঝে না। কান্না করতে করতে বিলাপ করতে থাকেন জিতু। এসময় কয়েকবার জ্ঞান হারান সাজ্জাদের স্ত্রী। 

স্বাভাবিক হলে নিহত সাজ্জাদের স্ত্রী (জিতু) বলেন, এখন কি করে সংসার চলবে। কে মেয়েকে নাস্তা এনে দিবে। মাদরাসার খরচ কে দিবে। এমন নানান প্রশ্ন করেন প্রতিবেদককে। এসময় প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি চান সাজ্জাদের স্ত্রী জিতু। 

নিহত সাজ্জাদের মা ময়না বেগম বলেন, নিস্পাপ ছেলে আমার বাজার গেলো ব্যবসার সবজি কিনতে। লাশ হয়ে বাড়ি ফিরলো। সাজ্জাদের টাকায় আমাদের সংসার চলতো। এখন কিভাবে সংসার চলবে জানি না। কয়েকদিন থেকে প্রতিবেশীরা খাবার দিচ্ছে, তাই খেয়ে আছি। এভাবে আর কতদিন চলবে। নাতনিটা সবসময় বাবা বাবা বলে কাঁদে। আমার ছেলে তার মেয়েকে খুব ভালোবাসতো। বাবা কে ছাড়া সে কখনও ঘুমাতো না। বাবা নাই কয়েকদিন থেকে সে ভালো করে ঘুমায় না। এখন আমাদেরই বা কিভাবে সংসার চলবে। নাতনি আর বউমার কিভাবে চলবে জানি না। সবশেষ হয়ে গেলো। এসময় সাজ্জাদের মা প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করলে নাতনি আর বউমা কিছু করে খেতে পারবে। না হলে না খেয়ে মরতে হবে তাদের।

কোটা আন্দোলনের মধ্যে গত ১৯ জুলাই শুক্রবার বিকেলে রংপুর নগরীর সিটি বাজার সংলগ্ন কৈলাশরঞ্জণ উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান সাজ্জাদ হোসেন। পরের দিন শনিবার সকাল ১০ টায় বিসমিল্লাহ জামে মসজিদে জানাযা শেষে কৈলাশরঞ্জন উচ্চ বিদ্যালয় মাঠের পাশের কবরস্থান দাফন করা হয়।
 
প্রতিনিধি/একেবি