জেলা প্রতিনিধি
১৬ মে ২০২২, ১১:৩২ এএম
দেশের অন্যতম প্রধান ধান উৎপাদনকারী জেলা নওগাঁয় চলছে বোরো ধান কাটা এবং মাড়াইয়ের কাজ। তবে ঘরে ধান উঠলেও কৃষকের মনে নেই খুশির ছোয়া। এপ্রিল ও চলতি মাসের শুরু থেকে দফায় দফায় ঝড়-বৃষ্টিতে জেলার বোরো ফসলের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। এতে মাঠের বেশিরভাগ ধান ক্ষেত এখন পানির নিচে।
এসবের মধ্যে আবার দেখা দিয়েছে শ্রমিক সংকট। এমনিতেই গত বছরের তুলনায় এবার শ্রমিকের মজুরি গুণতে হচ্ছে প্রায় দ্বিগুণেরও বেশি। এতে করে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন নওগাঁর কৃষকরা। সঠিক সময়ে ঘরে ধান তোলা নিয়ে কৃষকের কপালে পড়েছে চিন্তার ভাঁজ। অনেকে বাধ্য হয়ে পরিবারের লোকজন নিয়ে কাটছেন ধান। কেটে রাখা বোরো ধান পড়ে থাকছে জমিতেই। ফলে শ্রমিকরাও এসব ভেজা ধান বহন করতে ঝামেলা পোহাচ্ছেন। আবার সঠিক সময়ে মাড়াই করতে না পেরে ধানেরও ক্ষতি হচ্ছে। অনেকে আবার বাড়তি পারিশ্রমিক দিয়ে ধান কেটে ঘরে তুলছেন। এর ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে লোকসান হবে বলে জানিয়েছেন কৃষকরা।
সদর উপজেলার তালতলী বিল, হাঁসাইগাড়ী বিল, গুটার বিল, চণ্ডিপুর, রানীনগর উপজেলার দাঊদপুর, খট্টেশ্বর, বিশা, কালিগ্রাম, আত্রাই উপজেলার মনিয়ারী ও কালিকাপুরসহ বিভিন্ন মাঠ ঘুরে দেখা যায়, গত মাসে জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া দুদফা কালবৈশাখী ঝড়ে হেলে পড়া ধানের ৯৫ শতাংশ পেকে গিয়েছে। ধান পাকলেও শ্রমিক সংকটের কারণে এখনও অনেক কৃষক জমির ধান কাটতে পারেননি। এখনও থেমে থেমে বৃষ্টি হওয়ায় অনেক মাঠের নিচু জমিতে পানি জমে আছে। পানি জমে থাকায় ধান থেকে আবারও নতুন করে ধানগাছ জন্ম নিচ্ছে। এসব হেলে পড়া ভেজা ধান কাটতে স্থানীয় শ্রমিকদের মাঝে অনীহা দেখা দিয়েছে। মাঠে মাঠে নারী-পুরুষসহ সব বয়সী মানুষকে ভেজা ধান ডাঙায় তুলতে দেখা গেছে। দফায় দফায় বৃষ্টিতে অসহায় হয়ে পড়েছেন জেলার কৃষকেরা।
কৃষকরা বলছেন, মৌসুমজুড়ে কয়েক দফা বৃষ্টির কবলে পড়ায় যাদের ধান কাটা সম্ভব হয়নি, তাদের জমিতে ভিজে যাওয়া ধানে এখন চারা গজিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া শ্রমিক সংকটে ধান কাটতে পারেননি চাষিরা। এসব ধান তারা ভালোভাবে ঘরে তুলতে পারবেন কিনা, তা নিয়ে যেমন শঙ্কা রয়েছে, তেমনি শঙ্কা রয়েছে ভালো দাম পাওয়া নিয়ে। এছাড়াও যেখানে গত বছর বিঘাপ্রতি ধান কাটতে ২-৩ হাজার টাকা খরচ হলেও এ বছর জেলার বাইরে থেকে কৃষি শ্রমিক না আসায় স্থানীয় শ্রমিকদের বিঘাপ্রতি ৫-৬ হাজার টাকা মজুরি দিতে হচ্ছে।
সদর উপজেলার চন্ডিপুর ইউনিয়নের চুনিয়াগাড়ী গ্রামের কৃষক নকিম উদ্দিন বলেন, গত বছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় বোরো ধানের বাম্পার ফলন এবং ভালো দাম পেয়েছিলাম। তাই এ বছর ৩৪ হাজার টাকা খরচ করে চার বিঘা জমিতে বোরো ধান আবাদ করেছি। এরই মধ্যে ঝড়ে গাছ হেলে পড়ায় ২৫ শতাংশ ধান চিটা হয়ে গেছে। এখন জমির ধান সম্পূর্ণ পেকেছে। অথচ শ্রমিক সংকটের কারণে মাত্র এক বিঘা জমির ধান কাটতে পেরেছি। স্থানীয় শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তাদের সিরিয়াল পেতেও অনেক সময় লাগছে। যেকোনো সময় ঝড়-বৃষ্টি এসে এ ফসলের আরো ক্ষতি করতে পারে। কিন্তু বাড়তি টাকা দিয়েও এখন শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। দুই বছর করোনার কারণে প্রশাসনের সহযোগিতায় জেলার বাইরে থেকে কৃষি শ্রমিক আনা হয়েছিল। এবারও যদি তাদের আনার ব্যবস্থা করা যায় তাহলে আমরা ক্ষতির হাত থেকে রেহাই পাব।
একই উপজেলার হাঁসাইগাড়ী ইউনিয়নের কাঠখোর গ্রামের কৃষক সোহাগ হোসেন বলেন, গুটার বিলে ২০ বিঘা জমিতে বোরো ধানের আবাদ করেছি। এখানকার জমি এক ফসলি হওয়ায় প্রতি বছর বোরো মৌসুমের ওপর নির্ভর করে আমাদের চলতে হয়। বর্তমানে জমির সব ধান পেকেছে। শ্রমিক সংকটের কারণে বাধ্য হয়ে পরিবারের সদস্য এবং স্থানীয় শ্রমিকদের বাড়তি মজুরি দিয়ে ছয় বিঘা জমির ধান কাটা হয়েছে। গত বছর বিঘাপ্রতি ৩০-৩২ মণ করে ফলন পেয়েছিলাম। আর এবার ঝড়ে ধানগাছ হেলে পড়ায় বিঘা প্রতি ৮-১০ মণ কম ফলন পাচ্ছি। গত বছর বিঘা প্রতি ধান কাটতে আড়াই হাজার টাকা শ্রমিকদের পারিশ্রমিক দিতে হয়েছে। আর এবার ৫ হাজার টাকা দিয়েও সময়মতো শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না।
আত্রাই উপজেলার কালিকাপুর ইউনিয়নের ছোট কালিকাপুর গ্রামের কৃষক শহিদুল ইসলাম বলেন, সাড়ে ছয় বিঘা জমিতে বোরো ধান আবাদ করেছি। জমির ধান সম্পূর্ণ পেকে এক সপ্তাহ পার হলো। অথচ ধান কাটার কোনো কৃষি শ্রমিক নেই। প্রতি বছর ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, নীলফামারী জেলা থেকে এখানে কৃষি শ্রমিক আসত। তাদের বিঘা প্রতি ২ হাজার টাকা দিলেই ধান কেটে দিত। এবার তারা আসেনি। এজন্য ধান কাটা যাচ্ছে না। স্থানীয় শ্রমিকদের দিয়ে ধান কাটতে গেলে তারা বিঘাপ্রতি ৬ হাজার টাকা দাবি করছে। আবার তাদের শিডিউল নিতে হচ্ছে। এবার এমনিতেই ঝড়ে ফলন কম হয়েছে। এর মধ্যে যদি তাদের অতিরিক্ত টাকা দিয়ে ফসল ঘরে তুলি আমাদের লোকসান গুনতে হবে। এজন্য উপায় না পেয়ে বাইরের কৃষি শ্রমিকদের জন্য অপেক্ষা করছি। এভাবে বেশি দিন দেরি হলে বৃষ্টিতে ফসল পানিতে তলিয়ে যেতে পারে। তাই আমাদের দুশ্চিন্তার মধ্যে সময় কাটছে।
রাণীনগর উপজেলার কুনৌজ গ্রামের কৃষক নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘পাকিতে (৩৫ শতক) ১২ মণ বা ১৪ মণ ধান পাওয়া যায়। বর্গা করায় জমির মালিককে অর্ধেক দিতে হচ্ছে। ৬-৭ মণ ধান পেলে খরচ বেশি হয়ে যায়। এ সময় কামলাও পাওয়া যায় না। দিন প্রতি এক হাজার টাকা বা বিঘা প্রতি ছয় হাজার টাকা খরচে কামলা নিয়ে ধান কাটানোর ক্ষমতা আমাদের নেই। ধান কাটার জন্য সরকারিভাবে মেশিন পেলে আমাদের অনেক উপকার হতো।’
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শামছুল ওয়াদুদ বলেন, দুই দফা ঝড়-বৃষ্টিতে ফসল আক্রান্ত হওয়ায় এবার আমাদের বোরো ধানের ফলন কিছুটা কম হবে। জেলার সব মাঠের ৯৫ শতাংশ ধান পেকেছে। যেহেতু এখনও আবহাওয়া খারাপ তাই দেরি না করে দ্রুত ধান কেটে ফসল ঘরে তুলতে কৃষকদের প্রতিনিয়ত পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে আমাদের ৬৫ শতাংশ জমির ধান কাটা শেষ হয়েছে। শ্রমিক সংকটের কারণে এবার কৃষক ফসল ঘরে তুলতে একটু সমস্যায় পড়েছেন।
তিনি বলেন, প্রতি বছর পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, রংপুরসহ বিভিন্ন জেলা থেকে আমাদের এখানে বোরো মৌসুমে কৃষি শ্রমিক আসেন। এবার তারা আসতে পারেননি। কারণ একই সময় ওই অঞ্চলগুলোয় একসঙ্গে ধান পেকেছে। আমাদের এখানে বোরোর রেকর্ড পরিমাণ আবাদ হয়। তাই এ ফসল ঘরে তুলতে স্বাভাবিকভাবেই বাইরের শ্রমিকের প্রয়োজন বেশি পড়ে। শ্রমিক সংকট না থাকলে এতদিন প্রায় সব জমির ধানই কাটা শেষ হয়ে যেত।
লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, যেহেতু এখনও মাঠে ৩৫ শতাংশ ধান আছে তই এখনই বলা যাচ্ছে না লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে কিনা। তবে আগামী ১০ দিনের মধ্যেই মাঠের সব ধান কাটা শেষ হয়ে যাবে বলে মনে করেন তিনি।
উল্লেখ্য, চলতি বোরো মৌসুমে জেলায় ১ লাখ ৮৭ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে বড় অংশই জিরা, কাটারিভোগ, বিআর-২৮ ও বিআর-২৯ জাতের ধান। ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১২ লাখ মেট্রিক টন।
এএ