images

সারাদেশ / জাতীয়

‘ঈদ আনন্দ’ নিয়ে আজ ঘরে ফিরছেন এমভি আবদুল্লাহর নাবিকেরা

নিজস্ব প্রতিবেদক

১৪ মে ২০২৪, ০৮:০০ এএম

‘ঈদ শেষ হয়েছে অনেক আগে। কিন্তু এবারের ঈদ বিষাদময় ছিল আমাদের কাছে। স্বামী জলদস্যুদের হাতে জিম্মি থাকলে ঈদের আনন্দ তো আর থাকে না মনে। আমাদের ঘরে ঈদ হবে আজ (মঙ্গলবার)। আমরা তাই সেমাই রেঁধেছি। নতুন কাপড় পড়বো। রেঁধেছি গরুর গোশতের কালো ভুনা। পুঁটি মাছের ফ্রাইও করেছি। এসব খুব পছন্দ করে আতিকুল্লাহ’— কথাগুলো নাবিক আতিকুল্লাহ খানের স্ত্রী মিনা আজমিনের। স্বামীকে বরণে নিজের সাজানো পরিকল্পনার কথা এভাবেই গড় গড় করে বলছিলেন তিনি। 

শুধু আতিকুল্লাহর স্ত্রী নন; জিম্মিদশা থেকে মুক্ত হয়ে আসা সেই ২৩ নাবিকের অন্য স্বজনরাও সাজিয়েছেন নানা পরিকল্পনা। জিম্মি ঘটনার ৬৩ দিন পর আজ বাড়ি ফেরা হবে তাদের। এর আগে সোমবার সন্ধ্যায় কুতুবদিয়া চ্যানেলে নোঙর করেছে ২৩ নাবিকসহ জিম্মি হওয়া সেই এমভি আবদুল্লাহ জাহাজ। আজ বিকেলে সদরঘাট জেটিতে তাদের বরণ করবেন স্বজনরা। নাবিকেরা তীরে এলে জেটিতে গিয়েই তাদের বরণ করবেন স্বজনদের অনেকে।

কেএসআরএম গ্রুপের প্রধান নির্বাহী মেহেরুল করিম বলেন, ‘গত ২৮ এপ্রিল দুবাই থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশে ছেড়ে আসা জাহাজটি সোমবার সন্ধ্যা ছয়টায় কুতুবদিয়া চ্যানেলে নোঙর করেছে। মঙ্গলবার বিকেলে জাহাজে থাকা নাবিকদের সদরঘাটের জেটিতে নামাবো আমরা। সেখান থেকে তারা যার যার বাড়িতে ফিরে যাবে। স্বজনদের কেউ যদি সদরঘাটে আসতে চায় আমরা বারণ করবো না। তবে বেশি মানুষ সেখানে ভিড় না করাটাই ভালো হবে।’

স্বজনদের অপেক্ষা যেন শেষই হচ্ছে না
সোমালিয়ার দস্যুদের হাতে জিম্মি থাকা অবস্থায় ছেলে আইনুল হকের চিন্তায় ঘুম আসত না মা লুৎফে আরা বেগমের। দস্যুদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার এক মাস পর আজ সন্তানের সঙ্গে দেখা হবে তার। লুৎফে আরা বেগম বলেন, ‘ছেলেকে কখন বুকে জুড়িয়ে নেব, সেই অপেক্ষায় আছি। তাকে ফিরে পাচ্ছি; এটাই সবচেয়ে বড় পাওয়া। ছেলের প্রিয় খাবার শুঁটকি ভর্তা, চিংড়ি মাছ রান্না করব।’ 

এক মাস আগেও চট্টগ্রাম নগরের আসকারদীঘির বাসায় লুৎফে আরা বেগমের দিন কেটেছে উদ্বেগ–উৎকণ্ঠায়। গত ১২ মার্চ ভারত মহাসাগর থেকে কেএসআরএম গ্রুপের এই জাহাজ জিম্মি করার পর তার উদ্বেগ শুরু হয়েছিল। জিম্মিদশা শুরু হওয়ার পর তখন মায়ের অপেক্ষা ছিল কখন ফোন আসবে ছেলের। আইনুল হক দস্যুদের ফাঁকি দিয়ে সপ্তাহে এক–দুবার মায়ের সঙ্গে কথা বলতেন। দুশ্চিন্তা করতে নিষেধ করতেন।

জিম্মিদশা থেকে নাবিকেরা মুক্তি পাওয়ার প্রায় এক মাস পার হতে চলেছে। এখন প্রতিদিনই হোয়াটসঅ্যাপে সন্তানের সঙ্গে কথা হয় মায়ের। তবু মায়ের মন মানে না। লুৎফে আরা বেগম বলেন, কখন দেখা হবে ছেলের সঙ্গে; অপেক্ষা যেন শেষ হতে চাইছে না। 

Jahaj1_20240513_193529964

আরেক নাবিক নুর উদ্দিনের স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌসের খুশির শেষ নেই। জান্নাতুল ফেরদৌস থাকেন চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলায়। তিনি বলেন, ‘আড়াই বছরের সন্তান সাদ বিন নুরকে নিয়ে মঙ্গলবার বন্দর জেটিতে যাব। অপেক্ষার প্রহর যেন কাটছে না। তবে এবারের অপেক্ষা আনন্দের, খুশির।’

জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, ‘গরুর মাংস খুব পছন্দ করেন নুরউদ্দিন। পছন্দ করে আমার হাতে বানানো কেকও। এই দুই খাবারের অনেক রকম মেন্যু থাকবে মঙ্গলবার রাতে। রান্না করবো বিভিন্ন পদের সেমাই ও পায়েস। এবারের ঈদে সেমাইও রান্না করিনি আমরা। ও ঘরে এলেই ঈদের আনন্দ করবো। কয়েকদিন বিশ্রাম নিয়ে করবো ঈদের শপিংও।’ 

অন্যরকম প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে জাহাজের আরেক নাবিক সাজ্জাদের পরিবার। নিকটাত্মীয় নুপুরের সঙ্গে আকদ অনুষ্ঠান করেই এমভি আবদুল্লাহ জাহাজে উঠেছিল সাজ্জাদ। কথা ছিল দুবাই থেকে জাহাজে ফেরার পর হবে তাদের বিয়ের অনুষ্ঠান। কিন্তু সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হওয়ায় সব ছক এলোমেলা হয়ে যায় সাজ্জাদ ও নুপুরের। উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় কাটতে থাকে তাদের দিন। সব উৎকণ্ঠার অবসান হচ্ছে আজ। সাজ্জাদ ঘরে ফিরবে। আর সে ফিরলেই বাজবে বিয়ের সানাই। এরই মধ্যে বিয়ের অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে রেখেছে দুই পরিবারের স্বজনরা। পছন্দ করে রেখেছে বিয়ের ক্লাবও। এখন দিনক্ষণ চূড়ান্ত করেই শুভ অনুষ্ঠানটা শেষ করতে চায় তারা।

সাজ্জাদের মা শামসাদ বেগম বলেন, ‘শুনেছি মঙ্গলবার ঘরে ফিরবে সাজ্জাদ। অনেকদিন পর আমার ছেলে আমাদের বুকে ফিরবে; তাতেই শোকরিয়া আমার আর কিছু দরকার নাই। সে খবর শুনে আমার মনটা শান্ত হয়ে গেল। এবার বাড়ি ফিরলেই জমকালো আয়োজনে ছেলের বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সেরে ফেলবো।’ 

সাজ্জাদের বড় ভাই মোস্তাক হোসেন বলেন, সাজ্জাদকে রিসিভ করতে আমরা স্ব-পরিবারে শহর থেকে আনতে যাবো। অনেকদিনের অপেক্ষার পর ভাই আমাদের মাঝে ফিরবে এতে পরিবারের সবাই অনেক খুশি।

জাহাজের অয়েল কর্মকর্তা শামসুদ্দিন শিমুলের স্ত্রী ফারজানা সুলতানা বলেন, সোমবার সন্ধ্যায় ভিডিও কলে সন্তানদের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। তার বাড়ি ফেরার কথা শুনে সবাই খুবই আনন্দিত। ঈদের আনন্দ বিরাজ করছে বাড়িতে। সাগরে জলদস্যুরদের হাতে জিম্মিদশার দীর্ঘদিনের কঠিন মুহূর্তের পর তিনি আমাদের মাঝে ফিরবেন এটা ভাবতেও আমাদের খুব আনন্দ অনুভব হচ্ছে। এই আনন্দ দিনের সময়টুকু জীবনে মধ্যে স্মরণীয় করে রাখতে বিশেষ আয়োজনের চিন্তাভাবনা আছে আমাদের।

উল্লেখ্য, গত ১২ মার্চ ভারত মহাসাগর থেকে কেএসআরএম গ্রুপের মালিকানাধীন এই জাহাজ ছিনতাই করেছিল সোমালিয়ার দস্যুরা। মুক্তিপণ দিয়ে ৩৩ দিনের মাথায় ১৩ এপ্রিল দিবাগত রাতে জাহাজটি মুক্ত হয়। এরপর জাহাজটি প্রথমে আমিরাতের আল-হামরিয়া বন্দরে পৌঁছায়। সেখানে পণ্য খালাস শেষে আরেকটি বন্দর থেকে চুনাপাথর বোঝাই করে চট্টগ্রামের পথে রওনা হয়েছিল জাহাজটি। এ হিসাবে আমিরাত থেকে ১৩ দিনের মাথায় জাহাজটি বাংলাদেশের জলসীমায় এসে পৌঁছাল।

এইউ