১২ মে ২০২৪, ০৫:৪২ পিএম
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘নারী’ কবিতায় লিখেছেন, বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর। চট্টগ্রামে চার পরিবারে মিলেছে এমন চার নারী, যাদের গল্পে মিলেছে কবির এই চরণের চিরন্তন বাস্তবতা। যে পরিবারে সন্তানদের গুণে গুণান্বিত এই চার মা।
এর মধ্যে সন্তানদের মানুষের মতো মানুষ করে সফল মা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার বারখাইন ইউনিয়নের বীর মুক্তিযোদ্ধা আমির হোসাইনের স্ত্রী রোকেয়া বেগম। যিনি গত বছর ৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ এবং বেগম রোকেয়া দিবসে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামানের কাছ থেকে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ কার্যক্রমের আওতায় সফল জননী নারীর শ্রেষ্ঠ জয়িতার সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।
সফল জননী রোকেয়া বেগম বলেন, যুদ্ধের সময়ে অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যায় আমার। বিয়ের কয়েক বছর পর জীবনে নেমে আসেন ঝড়। অবুঝ সন্তানদের রেখে অল্প বয়সে মারা গেছেন স্বামী। বিগত বছরগুলো ছিলো সংগ্রাম আর দুঃখের, যা ভুলার মত নয়। নিজে পড়াশোনা করতে পারিনি, তাই সব সময় চেয়েছি, আমার সন্তানেরা যেন ঠিকমতো পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে। কখনো সন্তানদের ভালো কাপড় আর প্রাইভেট পড়াতে পারিনি। তবে পড়াশোনায় ঘাটতি যেন না থাকে, সেটা খেয়াল করতাম। এখন সন্তানেরা দেশের কাজে লেগেছে, সেটাই আমার জন্য আনন্দের। তাদের জন্য আমি কোনো দিন এমন সম্মান পাব, সেটা কখনো ভাবিনি।
রোকেয়া জানান, ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় ৬ষ্ঠ শ্রেণিsaতে পড়তেন তিনি। কিন্তু যুদ্ধের কারণে পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়। এর পাঁচবছর পর মারা যান তার বাবা। বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন বীর মুক্তিযোদ্ধা আমির হোসাইনের সঙ্গে। বিয়ের পাঁচ বছর পর তাদের ঘরে আসেন প্রথম কন্যা সন্তান। বছর না যেতেই মারা যায় সেই কন্যা শিশু। এরপর আবারও তাদের সংসার আলোকিত করে আসেন আরেক কন্যা শিশু। কিন্তু কিছুদিন পর সে শিশু টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। দুঃখ যেন তাকে পিছু ছাড়ছে না।
বিয়ের ঠিক ১৬ বছরের মধ্যে তাদের সংসারের জন্ম নেন এক ছেলে ও দুই কন্যা। এর কয়েক বছর পরই প্যারালাইজড রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান স্বামী বীর মুক্তিযোদ্ধা আমির হোসাইন। ছোট্ট তিন শিশুকে নিয়ে পড়তে হয় বিপাকে। আত্মীয় স্বজনদের সহযোগিতায় ঝাঁপিয়ে পড়েন জীবন যুদ্ধে। পরিবার ও তিন সন্তানের সব খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হতো তাঁকে। তাই নিজে কিছু করার চেষ্টা করি। বাড়িতে হাঁস-মুরগি, শাকস-বজির আবাদ করেও বাড়তি কিছু টাকা জোগাড়ের চেষ্টা করি। এই টাকা দিয়েই সন্তানদের লেখাপড়ার ও সংসারের খরচ মিটিয়েছি। অভাব থাকলেও সন্তানদের পড়াশোনা নিয়ে ছিলাম খুবই সিরিয়াস। আর তার ফলও মিলেছে হাতেনাতে।a
রোকেয়া বলেন, নিজে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করলেও তিন সন্তানকেই উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করার চেষ্টা ছিল বেশি। সেই সন্তানেরা এখন আলো ছড়াচ্ছে দেশের হয়ে। সংসারের অভাবের মধ্যে তিন সন্তানের মধ্যে দু’জনকে গড়ে তুলেছি বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডার হিসেবে। বড় মেয়ে আইরিন আকতার রাঙামাটি জেলা প্রশাসকের কার্যলয়ে রয়েছে রাজস্ব শাখার রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর হিসেবে। ছেলে মোহাম্মদ মঈনুল হোসেন চৌধুরী চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন শাখা) সিনিয়র সহকারী কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আর ছোট মেয়ে নাসরিন সোলতানা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসাপাতাল থেকে এসবিবিএস পাশ করে ৩৯তম বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডার ওসমানী মেডিকেল কলেজের রেডিওলজি বিভাগের এমডিএমএসে অধ্যায়নরত।
মায়ের এই সম্মাননা প্রাপ্তিতে নিজেদের অনুভূতি জানিয়ে বড় মেয়ে রাঙামাটি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে রাজস্ব শাখার রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর আইরিন আকতার ও ছেলে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন শাখা) সিনিয়র সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ মঈনুল হোসেন চৌধুরী বলেন, মাকে গর্বিত করার চেয়ে আনন্দের পৃথিবীতে আর কী হতে পারে! তবে বাবার মৃত্যুর পর মা যেভাবে ম্যাজিকের মতো আমাদের গড়ে তুলেছেন, সেটা ভাবলে এখন অসম্ভব মনে হয়। বাবা বেঁচে থাকলে আজ ভীষণ খুশি হতো। মায়ের কারণে আমরা একেকজন একেক জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছি, সেটা ভাবলেই আনন্দ লাগে। আর এই সাফল্যের পেছনে থাকা মাকে সফল মা হিসেবে পুরস্কৃত করেছে এবার জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ। সেটার জন্য আমরা গর্ববোধ করছি।
এদিকে বেকার স্বামীকে নিয়ে দুই সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পোমরা ইউনিয়নের গোচরা গ্রামের সফল মা ফেরদৌস আক্তার। তার দুই সন্তানের মধ্যে এক ছেলে নওশের ৪৬তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। আরেক ছেলে জামশেদ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সমুদ্র বিজ্ঞানে অনার্স পড়ছেন।
স্থানীয়রা জানান, ফেরদৌস আক্তার ছিলেন একজন গৃহিণী। স্বামী, সংসার, সন্তান সামলিয়ে নানা প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে তিনি এখন একজন সফল নারী উদ্যোক্তা। ২০২০ সালে করোনাকালীন সময়ে স্বামীর অনুপ্রেরণায় মাত্র ১০ কেজি মরিচের গুঁড়া দিয়ে অনলাইনে মসলার ব্যবসা শুরু করেন তিনি। যার আয় দিয়ে চলছে পরিবার ও সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ। তিনি একজন গর্বিত মা।
কিন্তু ফেরদৗস বেগমের ভাষ্য, গর্ববোধ করার মতো এখনো কিছুই তার অর্জন হয়নি। সন্তানেরা দেশের কাজে না লাগা পর্যন্ত নিজেকে একজন সফল মা হিসেবে দেখতেও রাজী নন তিনি। সন্তানের সাফল্যের জন্য তিনি বেচে থাকার লড়াই চালিয়ে যাবেন বলে জানান।
ফেরদৌস আক্তার চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন চট্টগ্রাম পলিটেকনিক্যাল কলেজে। পলিটেকনিক্যালে পড়াকালীন রাঙ্গুনিয়া উপজেলার সরফভাটা ইউনিয়নের লুৎফুল বারি পারভেজের সঙ্গে বিয়ের বেড়াজালে আটকে পড়েন ফেরদৌস আক্তার।
ফলে থমকে যায় তার শিক্ষাজীবন। তখন থেকেই তার স্বপ্ন জাগে উদ্যোক্তা হওয়ার। বৈবাহিক জীবনে তাদের দুই সন্তান রয়েছে। বর্তমানে স্বামী আর দুই সন্তানকে নিয়ে উপজেলার পোমরা ইউনিয়নের গোচরা গ্রামে সুখেই দিনতিপাত করছেন তিনি।
ফেরদৌস আক্তার জানান, ২০২০ সালের জুলাইয়ে করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় স্বামীর ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। দুই সন্তান নিয়ে কী করবেন কিছুই বুঝতে পারছিলেন না। ফেসবুক গ্রুপ ‘উই’-এর সন্ধান পেয়ে ব্যবসা শুরু করেন ফেরদৌস। মাত্র ১০ কেজি মরিচ কিনে সব প্রক্রিয়ার ভিডিও আপলোড দেওয়ার পর গ্রুপে ওই দিন ছয়জন মরিচের গুঁড়ার অর্ডার দেন।
প্রতিদিন মরিচ, হলুদ আর মসলার গুঁড়ার অর্ডার বাড়তে থাকে। ওই মাসেই বিক্রি হয় লাখ টাকার। এরপর থেকে ফেরদৌসকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। পরে ধনিয়া, মেজবানি মসলা, বিরিয়ানি মসলা, মাংসের মসলা, জিরা, বিন্নি চাল, শিমের বিচি, আতপ চালের গুঁড়ারও ভাল অর্ডার আসে। করোনার অতিমারি পাল্টে দিয়েছে তাঁর জীবন। এখন ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে সারাদেশে ফেরদৌসের নিয়মিত ক্রেতা পাঁচ হাজার জনের ওপরে।
গত দুই বছরে অনলাইনের মাধ্যমে প্রায় ২০ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি করেছেন এই নারী উদ্যোক্তা। নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে ধীরে ধীরে একজন সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে নিজ এলাকাসহ সারাদেশে পরিচিতিও লাভ করেছেন এ নারী। ফেরদৌস আক্তার এখন স্বপ্ন দেখছেন, একজন বড় উদ্যোক্তা হওয়ার এবং রাঙ্গুনিয়ায় আধুনিক একটি মসলা কারখানা স্থাপনের। সেই লক্ষ্যে নিরন্তর প্রচেষ্টা ও পরিশ্রম করে যাচ্ছেন তিনি।
ফেরদৌস আক্তার বলেন, ‘আমার প্রতিষ্ঠানের নাম ‘কুক মাসালা’। চট্টগ্রাম জেলার রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পোমরা ইউনিয়নের গোচরা গ্রাম থেকে আমি ‘উই’-এর (উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম) উদ্যোক্তা হয়ে কাজ করছি। আমার প্রতিষ্ঠান ‘কুক মাসালা’র প্রোডাক্ট দেশের ৬৪টি জেলায় ছড়িয়ে এখন বিদেশেও সুনাম অর্জন করেছে। ৬৪ জেলার মধ্যে ঢাকার উত্তরা ও মিরপুর থেকে সবচেয়ে বেশি অর্ডার আসে। হাটহাজারীর মিষ্টি মরিচের গুঁড়ার চাহিদা বেশি ক্রেতাদের।
উদ্যোক্তা জীবনে পরিবার থেকে ভালোই সাড়া পাচ্ছেন জানিয়ে ফেরদৌস বলেন, ‘পরিবারের সবাই আমাকে সাপোর্ট ও সহযোগিতা করেছে। বিশেষ করে আমার স্বামী পারভেজ আমাকে খুব সহযোগিতা করেছে। তবে রাঙ্গুনিয়ায় স্থানীয়ভাবে প্রথম শ্রেণির কুরিয়ার সার্ভিসগুলোর শাখা না থাকায় চট্টগ্রাম শহরে গিয়ে পণ্য ডেলিভারি দিতে হয় বলে জানান ফেরদৌস।’
ফেরদৌস আক্তার বলেন, শুরুতে আমি একজন নারী। এই পরিচয় দিতে একসময় দ্বিধা কাজ করত। কিন্তু এর সঙ্গে উদ্যোক্তা শব্দটি যোগ হয়েছে। আর আজ নারী উদ্যোক্তা পরিচয় দিতে আমার অহংকার এবং গর্ববোধ হয়। আমি এখন সফল মা হওয়ার অপেক্ষায়। আমার স্বপ্ন রাঙ্গুনিয়ায় ‘কুক মাসালা’ নামে একটা ফ্যাক্টরি স্থাপন করা। যাতে নিজের পাশাপাশি এলাকার মানুষদেরও কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়।
রাঙ্গুনিয়া উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা সোনিয়া সফি বলেন, ফেরদৌস আক্তার একজন সফল নারী উদ্যোক্তা এবং একজন সফল মাও। নারীদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে হলে অবশ্যই ফেরদৌসের মতো উদ্যোগী হতে হবে। ইচ্ছাশক্তি মানুষকে অনেক দূর নিয়ে যায়। তাঁর স্বপ্ন পূরণ হোক, এ প্রত্যাশা করি।
চট্টগ্রামের আরেক সফল মা শিখা দাশ চৌধুরী। তার গ্রামের বাড়িও চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায়। তবে বড় হয়েছে চট্টগ্রাম শহরের প্রাণকেন্দ্র জামাল খান লেনের পৈত্রিক বাড়িতে। বাবা সন্তোষ ভূষণ দাশ একজন আইনজ্ঞ, রাঙ্গুনিয়া কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কর্মকমিশনের সদস্য হিসেবেও তার পেশাগত জীবনকে বৈচিত্রময় করে তুলেছেন।
আর্থিকভাবে সচ্ছল পরিবারে জন্ম নেয়া শিখা শৈশব-কৈশোর পার করেছে অন্য দশটি সাধারণ বাঙালী মেয়ের মতো। সাত ভাই-বোনের মধ্যে শিখা চতুর্থ। মা রেণুকা প্রভাদাশ গৃহিণী। শিখা চট্টগ্রামের খাস্তগীর বালিকা বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা কৃতিত্বের সঙ্গে উন্নীত হলেও সে সময় অন্য এক বিপর্যয় পুরো সংসারকে বেসামাল করে দেয়। হঠাৎ তার মমতাময়ী মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। এক সময় মানসিক ভারসাম্যও হারিয়ে ফেলেন। তখন বাবাই মোটামুটি সংসার আর পেশাগত জীবনকে সামাল দিয়ে অসুস্থ স্ত্রীসহ সন্তানদের দেখাশোনা করতেন।
সাত সন্তানকেই সন্তোষ দাশ উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। শুধু তাই নয় প্রত্যেকেই স্ব-স্ব কর্মক্ষেত্রে সফল হয়েছেন। শিখা উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ১৯৮০ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজতত্ত্ব বিভাগে (সম্মান) ভর্তি হন। ১৯৮১ সালে বাবার পছন্দ করা পাত্রের সঙ্গে শিখার বিয়ে হয়ে যায়। সে তখন মাত্র দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। সাবসিডিয়ারি পরীক্ষা দেয়ার আগে। স্বামী নীতিশ চৌধুরী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন বিভাগে স্নাতক-স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করে ঢাকায় চলে যান। সাভারের গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালে যোগদান করেন কেমিস্ট হিসেবে। ১৯৮২ সালে শিখা এক সন্তানের মাও হয়ে যায়।
এরই মধ্যে শিখার শিক্ষাজীবনে হরেক রকম টানপোড়েন শুরু হয়। লেখাপড়া প্রায়ই বন্ধ হওয়ার উপক্রম। একান্ত সুহৃদ সহপাঠীরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। নিজের অক্লান্ত পরিশ্রম আর অনমনীয় মনোযোগ এক সময় স্বামী-সন্তান আর সংসার নিয়েই সাবসিডিয়ারি পাস করে যায়।
পরবর্তীতে স্নাতক পরীক্ষার জন্যও প্রস্তুতি নিতে থাকে। ঢাকা এবং চট্টগ্রাম করতে করতে প্রায়ই দুই বছর কেটে যায়। স্বামীও ফ্রান্সে চলে যান উচ্চতর ডিগ্রী পিএইচডি অর্জনের লক্ষ্য নিয়ে। ফলে পরের কয়েক বছর স্থায়ীভাবে চট্টগ্রামের বাবার বাড়িতে থাকতে শুরু করে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ হয়। পরবর্তীতে বিএড ডিগ্রীও সম্পন্ন করেন। স্বামী ফিরে আসলে আবারও সাভারের গণস্বাস্থ্যের আঙিনায়। শিক্ষা জীবনের অনেক মূল্যবান ধাপ পার করে শিখার পরবর্তী লক্ষ্য কোন সরকারী কর্মকান্ডে নিজেকে সম্পৃক্ত করা। তখন অবধি সরকারি চাকরিতে পিএসসি কার্যক্রমের মাধ্যমেও পেশাগত জীবন শুরু করা যেত। শিখা পিএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৮৯ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তা হিসেবে পরিবার পরিকল্পনা অফিসে যোগদান করেন।
বাংলাদেশের বিভিন্ন উপজেলায় প্রায়ই ২০ বছর বদলির পালাক্রমে এক জায়গা থেকে অন্য কোন স্থানে থাকতে হয়েছে। চাকরি জীবনের পালা বদলের অস্থির সময়ে জন্ম নেয় দ্বিতীয় সন্তান ধীমান। দুই সন্তানকে শুধু পৃথিবীর আলো দেখানোই নয় দেশের ভাবী প্রজন্ম হিসেবে যোগ্যতম আসনে বসানো প্রত্যেক বাবা-মায়ের নৈতিক দায়বদ্ধতা। সে কর্তব্যও সুষ্ঠুভাবে পালন করেছে শিখা এবং নীতিশ বাবু।
শিখাকে যখন চাকরির কারণে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য স্থানে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে তখন সন্তানদের সার্বিক দেখাশোনার দায় ভাগ পড়েছে বাবার ওপর। তিনিও তার সমস্ত প্রচেষ্টা এবং মমত্ববোধে ছেলে এবং মেয়ের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তারা দেশের সুযোগ্য নাগরিক হিসেবেও বেড়ে উঠেছে। মেয়ে নিশি ঢাকার হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা বিজ্ঞানে ডিগ্রী অর্জন করে তার পেশাগত জীবনকেও সুষ্ঠু ভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন।
ছেলে ধীমান বুয়েট থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ ক্যারোলিন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর গবেষণায় নিয়োজিত। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থায়নে পড়াশানার সুযোগ পান। কর্মজীবনের শেষ প্রান্তে এসে শিখা এখন পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরে (কাওরান বাজার অফিস) উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে তার পেশাগত জীবন চালিয়ে যাচ্ছেন।
এখনও তাকে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় পরিবার পরিকল্পনার যথার্থ প্রয়োগ নিয়ে কর্মক্ষেত্রের দায়িত্ব পালন করে যেতে হয়। সেমিনার, সম্মেলন এবং বিভিন্ন কর্মশালার মাধ্যমে আজও সাধারণ মানুষকে বোঝাতে হয় জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারলে ছোট দেশের ওপর যে পরিমাণ চাপ তৈরি হবে তাতে ভবিষ্যত প্রজন্মকে একটি বাসযোগ্য পৃথিবী উপহার দেয়া কঠিন হবে।
শিখা যেভাবে তার জীবনের সমূহ লড়াইকে মোকাবেলা করে শিক্ষা জীবনকে ভেসে যেতে দেয়নি একইভাবে পেশাগত জীবনকেও দারুণভাবে মোকাবেলা করছে। মাতৃত্বের অকৃত্রিম মহিমায় সন্তানদেরও যথার্থ পথে চালিয়ে নিতে কষ্ট হয়নি। সন্তানরাও কর্মজীবী মায়ের অনেক সীমাবদ্ধতাকে মেনে নিয়ে নিজেদের সামনে চলার পথকে এগিয়ে নিয়েছে। সফলও হয়েছে তারা।
শিখার জীবনে এসেছে পরম শান্তি আর তৃপ্তি। একজন সফল সরকারি কর্মকর্তা অবসরের কাছাকাছি সময়ে এসে ভাবতে পারে কর্মক্ষেত্রে কখনও অন্যায় সুযোগ-সুবিধা নেননি সংসার কিংবা সন্তানদের কারণে। আবার সন্তানরাও তৈরি হয়েছে বাবা-মার পছন্দ অনুযায়ী। সংসার এবং সফলভাবে পেশাগত জীবন চালিয়ে নেয়া সত্যিই এক বড় চ্যালেঞ্জের বিষয়। যাকে অতিক্রম করা অনেক মেয়ের পক্ষে সম্ভব হয় না। আর যারা পারে তারা সত্যি দৃষ্টান্তই শুধু নয় তার চেয়েও বেশি নারী হিসেবে নয়, মানুষ ভেবে নিজেকে জোর কদমে সামনে এগিয়ে নেওয়া।
চট্টগ্রামের আরেক সফল মা উম্মে হাবিবা ফারজানা। তিনি একজন বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তা। পাহাড়সম প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে তিনি আজ সফল। তার এ সফলতার পেছনে অনুপ্রেরণা তিনি নিজেই। প্রায় চার বছর পড়ালেখা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার পরও শুধু দৃঢ় মনোবল আর পরিশ্রমের কারণেই সফল এই তরুণী।
৩৭তম বিসিএসের মাধ্যমে প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন ফারজানা। এস এম মাহবুবুর রহমান ও বিলকিস খানম দম্পতির বড় সন্তান ফারজানা ছোট থেকেই ছিলেন দৃঢ়চেতা ও আত্নবিশ্বাসী। চট্টগ্রামের নৌবাহিনী স্কুল এন্ড কলেজ থেকে ২০০৫ সালে এসএসসি ও ২০০৭ সালে এইচএসসি সম্পন্ন করেন ফারজানা।
এইচএসসি পাশের পর ভর্তি হন দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে। ক্যাম্পাসের রঙিন দিনগুলোর স্বাদ বুঝে উঠতে না উঠতেই অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়াকালেই মা-বাবার ইচ্ছায় বেসরকারি কর্মকর্তা মনিরুল ইসলামের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। মাত্র উনিশ বছর বয়সে বিয়ের পরে সাংসারিক বাস্তবতায় রঙিন জীবন কিছুটা ফ্যাকাসে লাগতে থাকে পড়াশোনা, সংসার, শ্বশুরবাড়ির সবকিছু সামলে হাঁপিয়ে উঠতে উঠতে। তবে একসময় আত্নবিশ্বাস দিয়ে জয় করেন সবকিছু।
মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষার সময় আট মাসের গর্ভবতী ছিলেন হাবিবা। কন্যার জন্মের পরই শুরু হয় তার প্রকৃত জীবন সংগ্রাম। সন্তান হবার পরে প্রায় কারো সাহায্য ছাড়াই একা বড় করে তুলতে থাকেন মেয়ে মানহা ইসলাম শাইরাকে। সেসময়টা সবকিছু সামলে প্রচণ্ড মানসিক চাপের মধ্য দিয়েও সন্তানের উপর প্রভাব পড়তে দেননি তিনি।
ফারজানার বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নেবার পেছনে অনুপ্রেরণা তিনি নিজেই। রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবারের প্রতি দায়বদ্ধতা সর্বোপরি একজন সচেতন নাগরিক হিসেবেই তার সিভিল সার্ভিসে যোগ দেয়ার ইচ্ছা। সেজন্য চলমান জীবন সংগ্রামের মধ্যেই নিজেকে নতুন করে গুছিয়ে চার বছর পর শুরু করেন পরীক্ষার প্রস্তুতি।
বিসিএসের প্রস্তুতির সময় স্বামী মো. মনিরুল ইসলামের অবদানকে স্মরণ করেছেন বার বার। সংসার সামলে ফারজানার পড়ার সময় ছিলো খুব কম। তাই রাত সাড়ে এগারোটা থেকে শুরু করে অনেক রাত পর্যন্ত চলতো তার প্রস্তুতি। এভাবেই অংশ নেন ৩৭তম বিসিএসে। এটাই ছিলো তার প্রথম বিসিএস। প্রিলিমিনারি পরীক্ষার সময় চিকেন পক্সে আক্রান্ত হন ফারজানা ও তার মেয়ে। অসুস্থ অবস্থায়ই পরীক্ষায় অংশ নেন তিনি। মেধাবী ফারজানা সফল হন বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষায়।
লিখিত পরীক্ষার আগে পড়ালেখার সুযোগ পেয়েছেন মাত্র দেড় মাস। সেসময় স্বামী-মা ও বোনের কাছ থেকে বেশ সহযোগিতা পেয়েছেন তিনি। লিখিত পরীক্ষায় সফলতার পর ভাইভাতেও সফল হন ফারজানা। সুপারিশপ্রাপ্ত হন বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে। তার এ সফলতায় আপ্লুত তার পরিবার ও স্বজনরা। আর নিজস্ব পরিচিতি তৈরি হওয়ায় আপ্লুত ফারজানাও।
নারীদের উদ্দেশ্যে প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত উম্মে হাবিবা ফারজানা বলেন, সফলতার জন্য নারীদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আত্নবিশ্বাস। আমি মানুষ, আমি একটা আলাদা সত্তা। আমাকে আমার লক্ষ্যে পৌঁছতে হবে। আর এজন্য যা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তা হলো পরিশ্রম। সে বিষয়ে কখনোই পিছপা হওয়া যাবে না।
প্রতিনিধি/একেবি