images

সারাদেশ / লাইফস্টাইল

মায়ের জন্যই সাগরিকা এখন দেশসেরা ফুটবলার

১২ মে ২০২৪, ০৫:০৫ পিএম

প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চল ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈল উপজেলার রাঙ্গাটুঙ্গি গ্রামের বাসিন্দা আনজু বেগম। টানাপোড়েনের সংসারে এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে চলে সংগ্রামী জীবন। স্বামী কাজ করতেন ইটভাটায়। অভাবের কারণে ছেলে মেয়েকে মাধ্যমিকে পড়াতে পারেননি।

পড়িয়েছেন পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত। অর্থের অভাবে ছেলে পড়াশোনা বাদ দিয়ে বর্তমানে কাজ করছেন ইটভাটায়। আর মেয়ে সাগরিকা ছোটবেলা থেকেই ফুটবল অনুশীলন করতেন।

এতে বাবা মেয়েকে খেলতে নিষেধ করলেও মায়ের কারণে তার মেয়ে মোছাম্মাৎ সাগরিকা বর্তমানে খেলছেন জাতীয় নারী ফুটবল দলে। ইতিমধ্যে সাগরিকা নিজ দেশ ছাড়িয়ে সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম, ভুটান ও নেপাল দেশের মাটিতেও খেলেছেন। চ্যাম্পিয়নশিপের খেলায় সেরা খেলোয়াড় এবং সর্বোচ্চ গোলদাতার শিরোপা অর্জন করেছেন তিনি। এর পেছনে তার মাকে অনেক লড়াই ও সংগ্রাম করতে হয়েছে। শুনতে হয়েছে মানুষের নানা কটাক্ষ।

জেলা শহর থেকে প্রায় ৫৫-৬০ কিলোমিটার দূরে রাণীশংকৈল উপজেলার নন্দুয়ার ইউনিয়নের রাঙ্গাটুঙ্গি গ্রামে বাড়ি তাদের। পরিত্যক্ত ১০ শতাংশ জমির মধ্যে বাঁশ ও টিনের তৈরি বাড়িতে স্বামী ও দুই সন্তান নিয়ে বাস করতেন আনজু বেগম।

স্বামী আগে কাজ করতেন ইটভাটায় ও আর আনজু বেগম কাজ করতেন মানুষের বাড়িতে। সংসারে কোনো সময় খাবার জুটতো আবার কোনো সময় জুটতো না। এভাবে দুই সন্তানকে নিয়ে খুব অভাব অনটনে দিন কাটে তাদের।

এমন অবস্থায় তার স্বামী মো. লিটন রাণীশংকৈল ও হরিপুর মহাসড়কের পাশে বলিদ্বারা এলাকায় অন্যের জায়গায় একটি চায়ের দোকান দেন। স্বামীর পাশাপাশি তিনিও দোকানে সময় দেন। এরপরেও অভাব যেন তাদের পিছু ছাড়তে চায় না।

Thakurgon_M-Inner-1

এদিকে আগ্রহের কারণে মেয়ে সাগরিকা ছোটবেলা থেকেই ফুটবল খেলার অনুশীলন করতো রাণীশংকৈল ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ তাজুল ইসলামের হাত ধরে গড়ে উঠা রাঙ্গাটুঙ্গি ইউনাইটেড প্রমিলা ফুটবল একাডেমিতে।

মেয়ে মানুষ হয়ে ফুটবল খেলায় নানা কটাক্ষের শিকার হতে হয়েছে সাগরিকার বাবা-মাকে। মানুষের কটাক্ষ শুনে বাবা লিটন সাগরিকারকে ফুটবল খেলতে নিষেধ করেন। এক সময় বন্ধও করে দেন। কিন্তু নাছড়বান্দা সাগরিকা। মাকে ম্যানেজ করে লুকিয়ে খেলতে যেতেন তিনি। খেলার আগ্রহ দেখে মা আনজু তাকে খেলতে যাওয়ায় সহযোগিতা করতেন।

মা আনজু বেগম ঢাকা মেইলকে জানান, অনুশীলন করে সাগরিকা ঘরে ফিরে খাবার চাইলে ও কান্নাকাটি করলেও পুষ্টিকর খাবার তো দূরের কথা কোনো কোনো দিন তাকে একমুঠো খাবারও দিতে পারতেন না।

অজপাড়া গ্রাম থেকে উঠে আসা নেপাল ও ভুটানে অনূর্ধ্ব-১৭ নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ ফুটবল খেলায় নেপালের সঙ্গে পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশের পক্ষে গোল করে সমতা এনেছিলেন এই সাগরিকা। এছাড়া সিঙ্গাপুর ও ভিয়েতনামে অনূর্ধ্ব-১৭ নারী দলে খেলেছেন সাগরিকা। অনূর্ধ্ব-১৯ দলে খেলার সুযোগ পেয়েই চমকে দিয়েছেন। জোড়া গোলে জিতিয়েছেন দলকে। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলের একজন খেলোয়াড় হিসেবে বিভিন্ন লীগে খেলছেন।

Thakurgon_M-Inner-2

সাগরিকার এমন সাফল্যে যারা আগে নানা কটাক্ষ করতো তারাসহ এখন দেশবাসী তাকে নিয়ে গর্ব করে।সাফ জয়ী নারী ফুটবলার সাগরিকার মা আনজু বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে ঢাকা মেইলকে বলেন, মেয়ে ফুটবল খেলে বলে আশপাশের মানুষের নানা কথা আমাকে সহ্য করতে হয়েছে। আমি তাদের কথার কোনো জবাব বা উত্তর করতাম না। মুখ বুঝে সব সহ্য করে গেছি, আর মনে মনে ভেবেছি মেয়ে খেলায় ভালো কিছু করতে পারলে সেদিন তাদের কথার উত্তর দেব। মানুষের নানা কথায় একদিন আমার স্বামী মেয়ের খেলাধুলা বন্ধ করে দিয়েছিল। প্রায় ১ মাস কথা বলেনি মেয়ের সঙ্গে তিনি। আমি যতটা কষ্ট করেছি ও করছি আর অন্য কোনো নারী এত কষ্ট করতে পারতো না।

সাফ জয়ী ফুটবলার সাগরিকার বাড়ি জরাজীর্ণ এমন প্রতিবেদন বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে আসলে পরবর্তীতে জেলা প্রশাসক ও উপজেলার সংশ্লিষ্ট নির্বাহী কর্মকর্তা দুই কক্ষের একটি বাড়ি ও টয়লেট নির্মাণ করে দেন তাদের।

সাগরিকার বাবা মো. লিটন বলেন, আমি আগে কাজ করতাম ইটভাটায়। সেখানকার আয় দিয়ে আমার সংসার চলতো না। এভাবে আমি আমার ছেলে ও মেয়েকে পড়াশোনা করাইতে পারিনি। পরে একটা চায়ের দোকান দেই। দোকানের আয় দিয়েও কুলাই উঠতে পারছি না। তাই এখন ছেলেটাও কাজ করছে ইটভাটায়। আর মানুষের নানান কথায় মেয়াটাকে প্রথম দিকে ফুটবল খেলতে দিতাম না। তার পরেও সে লুকিয়ে লুকিয়ে খেলতে যেত। এমন করে সে আজকে এমন পর্যায়ে গেছে। এতে আলহামদুলিল্লাহ আমি খুশি ও গর্বিত। আর এখন এলাকার মানুষও তার সুনাম করছে। জেলা প্রশাসক ও ইউএনও আমাদের দুইটা পাকা রুম ও টয়লেট তৈরি করে দিয়েছেন। এখন থাকার ঘর হয়েছে ঠিকই কিন্তু যা আয় হয় তা দিয়ে সংসার চালানো দায়।

সাগরিকার সাফল্য ও মায়ের অবদানের কথা জানিয়ে ঢাকা মেইলকে রাঙ্গাটুঙ্গি ইউনাইটেড প্রমিলা ফুটবল একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক মো. তাজুল ইসলাম বলেন, মেয়েদের ফুটবল খেলা নিয়ে আমাদের ধর্মীয় নিদের্শনা আছে। সেই সুযোগ নিয়ে আমাদের গ্রাম অঞ্চলের মানুষ নেতিবাচক ও খারাপ কথা বলে। মানুষ নানা কথা সাগরিকার বাবাকে সব সময় লোকজন বলতো। সঙ্গতকারণে একদিন সাগরিকার বাবা তার খেলা বন্ধ করে দিয়েছিল। পরবর্তীতে সাগরিকাকে নিয়ে তার মা আমার কাছে ও তার দায়িত্ব আমাকে দেন। সাগরিকার খেলায় তার মায়ের সমর্থন ছিল। আর আমাদের এলাকার অনেক মেয়ে এখানে অনুশীলন করে খেলা শিখে। সব মিলিয়ে পরে সেই বাঁধাগুলো আর বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি।

তিনি আরও বলেন, সাগরিকার সাফল্য সত্যি আনন্দের বিষয়। এমন দিনের জন্যই অপেক্ষায় ছিলাম। এখন ঢাকায় খেলা হলে আর সাগরিকা মাঠে থাকলে গোল হবেই। সে যেকোনো দলের হয়েই খেলুক না কেন। যেমন গত ৯ মে ঢাকায় নারী লীগ খেলায় একাই ৪টি গোল করেছে। এমন একজন খেলোয়াড়ের নাম যখন উঠে আসে আর সাগরিকার মুখে যখন শোনে তার বাড়ি ঠাকুরগাঁও ও সে রাঙ্গাটুঙ্গি ফুটবল একাডেমিতে উঠে এসেছে। তার জন্যেই আমাদের ও আমার নাম আলোচিত হচ্ছে। অবশ্যই এটি খুশির বিষয়। আমার বিশ্বাস যে সে সুস্থ থাকলে আরও দেশের বাইরে যেতে পারে।

Thakurgon_M-Inner-3

২০১৬ সালে জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়া একই গ্রামের মেয়ে মুন্নি আক্তার আদরির মা মোছা. আমবিয়া খাতুন বলেন, ঠাকুরগাঁও থেকে সর্বপ্রথম আমার মেয়ে জাতীয় দলে খেলার সুযোগ পায়। খেলায় সেও চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ও ৩-৪ বার বিদেশেও খেলেছে। এখন তার বিয়ে হয়ে গেছে। তো তখন প্রথম প্রথম অনেক মানুষ অনেক ধরণের কথা বলতো। আমরা সেগুলোকে পাত্তা দেইনি। যখন মেয়ে ভালো কিছু করল তখন তারাই আবার সুনাম করে। তেমনি সাগরিকার বাবা মাকেও নানা কথা শুনতে হয়েছে। এখন সাগরিকা ভালো খেলছে। দোয়া করি সে যেন আরও উপরে যেতে পারে।

আনজু বেগম আরও বলেন, আমার মেয়ে আজকে আমাকে এই পর্যায়ে নিয়ে যাবে যা আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। আমি মানুষের বাসায় কাজ করে বেড়িয়েছি। আগে কেউ আমাকে চিন্তই না। এখন আমাকে আমার মেয়ের কারণে প্রায় সবাই চিনে। এতে আমি খুব খুশি ও গর্বিত।সাগরিকা যেন আরও ভালো কিছু করতে পারে এবং দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে পারে। তাই মেয়ের জন্য সবার কাছে দোয়া চান সংগ্রামী এই মা।

প্রতিনিধি/এসএস