১২ মে ২০২৪, ১২:০৩ পিএম
সময়টা ১৯৯৬ সাল। সবে কৈশোরে পা দেওয়া ক্লাস সেভেনে পড়ুয়া রুনা আক্তারের বিয়ে হয় আসাদ মল্লিকের সাথে। সেই থেকে নিজের নামের সঙ্গে স্বামীর নাম জুড়ে হয়ে যান রুনা আসাদ। বছর পেরোতেই কোলজুড়ে আসে ফুটফুটে এক কন্যা সন্তান। যেন সোনায় সোহাগা সংসার তাদের। তবে এই সুখ বেশিদিন স্থায়ী হলো না।
১৯৯৯ সালে বিয়ের আড়াই বছরের মাথায় হঠাৎ করেই সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান স্বামী আসাদ মল্লিক। একমাত্র মেয়ের বয়স তখন মাত্র আঠারো মাস। সেই দুঃসহ স্মৃতি আজও তিনি বয়ে বেড়াচ্ছেন। তখন থেকে তার একমাত্র বন্ধু মেয়ে রিয়া। মেয়ের বয়স এখন ২৫। মেয়ে আর বৃদ্ধ বাবা-মাকে নিয়েই ২৫ বছর ধরে রুনার সংসার। স্বামীর প্রতি অগাধ ভালোবাসার নিদর্শন স্বরূপ দাপ্তরিক কাগজপত্রসহ সব ক্ষেত্রেই নিজেকে রুনা আসাদ নামেই পরিচয় দেন এখনো।
একাকী এই মা ঢাকা মেইলকে জানালেন একমাত্র সন্তানকে নিয়ে বেঁচে থাকার নানান বিড়ম্বনা থেকে শুরু করে তার সামগ্রিক সংগ্রামের কথা।
রুনা আসাদ বলেন, বিয়ের পর চাকরির সুবাদে আমার হাসব্যান্ড রাজধানীর উত্তরায় থাকতো। আর আমি থাকতাম ধামরাইতে। সপ্তাহান্তে তিনি ঢাকা থেকে বাড়িতে আসতেন। এসেই মেয়ে আর আমাকে নিয়ে মেতে থাকতেন পুরোটা সময়। মেয়েকে অনেক ভালবাসতেন, তাই সবসময় চাইতেন আমাদের ঢাকায় নিয়ে নিজের কাছে রাখতে। সে জন্য উত্তরায় ছোট্ট একটা ভাড়া বাসাও ঠিক করেছিলেন।
আমার এখনো মনে আছে, দিনটা ছিল বুধবার। তিনি ঢাকায় ফেরার সময় আমাকে বলে গিয়েছিলেন, ‘রুনা তুমি লাগেজ গুছিয়ে রেখো, আমি শুক্রবার এসে তোমাদেরকে আমাদের নতুন বাসায় নিয়ে যাব।’ এই ছিল তার সাথে আমার শেষ কথা। তারপর থেকেই আমার আর আমার মেয়ের অপেক্ষা শুরু, কবে আসবেন তিনি! কিন্তু তার আর ফেরা হলো না।
পাঁচদিন পর খবর পেলাম ঢাকার এক হাসপাতালের মর্গে পড়ে রয়েছে স্বামীর নিথর দেহ। পরে জানতে পেরেছি, যেদিন আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঢাকায় গিয়েছিলেন সেদিন বিকেলেই অফিস শেষে বাড়ি আসার জন্য রওয়ানা দিয়েছিলেন। কিন্তু পথিমধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন তিনি।
সে সময় মোবাইল ফোনের যুগ না থাকায় তার মৃত্যুর খবরটাও তাৎক্ষণিক জানতে পারিনি। এরপর থেকেই আমার জীবন সংগ্রাম শুরু। একা এই ছোট্ট মেয়েটাকে নিয়ে সমাজে টিকে থাকতে প্রতিনিয়তই লড়াই করতে হয়েছে আমাকে। যখন আমার হাসব্যান্ড মারা গেলো, তখন থেকেই আমার মা-বাবা আমার সঙ্গে ছিলেন, আজও আছেন। মায়ের কাছে বাচ্চাকে রেখে চাকরি করতাম। লোকেদের নানা কটু কথার তোয়াক্কা না করে প্রথমে একটা ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে চাকরি নেই। সেখানে দুই বছর চাকরি করার পর সাভার ইপিজেডে একটা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে পাঁচ বছর কাজ করি। সন্তানের কথা চিন্তা করেই আর বিয়ের কথা ভাবিনি। মেয়েকেই আমি আমার পুরোটা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। যেহেতু ওর বাবার ঘাটতি আমি কখনোই পূরণ করতে পারব না, তাই আমি চেয়েছি মাকে ও পুরোপুরি কাছে পাক।
একজন একা মায়ের সন্তানকে বড় করার লড়াই খুব কঠিন। কথা বলার এক পর্যায়ে কেঁদে ফেলেন রুনা আসাদ। তিনি বলেন, আমার মেয়েটা যখন ক্লাস ফোরে পড়ে তখন হঠাৎ একদিন রাস্তা পার হওয়ার সময় এক্সিডেন্ট করে মাথায় গুরুতর আঘাত পায়। আমি তখন অফিসে ছিলাম, তাই কিছুই জানি না। এদিকে আমার রিলেটিভ ও প্রতিবেশীরা মেয়েকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। আমি সন্ধ্যায় অফিস শেষে বাড়ি ফিরে এসে মেয়ের এই দৃশ্য দেখে তাৎক্ষণিক জ্ঞান হারাই। সেদিন সারা রাত মেয়েটাকে কোলে নিয়ে বসে থেকেছি আর ভেবেছি আজ মেয়েটাও যদি ওর বাবার মতো আমাকে ছেড়ে চলে যেত তাহলে আমি কি নিয়ে বাঁচতাম? তাই পরদিন সকালেই সিদ্ধান্ত নেই এক মুহূর্তের জন্যও মেয়েটাকে আর চোখের আড়াল করব না। তাই চাকরিটাও ছেড়ে দেই।

এরপর শুরু হয় টিকে থাকার আরেক সংগ্রাম। প্রথমে বাড়ির পাশের এক বিউটি পার্লারের আপার কাছে বিউটিশিয়ানের কাজ শিখি। এরপর ২০১১ সালে নিজের জমানো কিছু টাকা ও আত্মীয়স্বজনের সহযোগিতায় শুরু করি পার্লারের ব্যবসা। ছোট্ট একটি জায়গা ভাড়া নিয়ে মেয়ের নামে (রিয়া বিউটি পার্লার) খুলি একটা পার্লার হাউজ। সেই থেকেই আমার নিজের পায়ে দাঁড়ানো। এখন আল্লাহর রহমতে বেশ ভালো আছি। মেয়েটা অনার্স শেষ করেছে। কিছুদিন আগে মেয়েটাকে বিয়েও দিয়েছি।
মায়ের এই সংগ্রামী জীবনের কথা জানাতে গিয়ে মেয়ে আনমুন আসাদ রিয়া বলেন, আমরা তো জানি সন্তানের জন্য বাবা-মা দুজনের সাহচর্যই প্রয়োজন। কিন্তু দুজনের সেই কাজটা আমার মা একাই করে চলেছেন হাজারো প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে, সাহসে বুক বেঁধে। তিনি একাই আমার কাছে হয়ে উঠেছেন বাবা-মা দুই-ই। কাজটা ঠিক সার্কাসে দেখা সরু দড়ির ওপর দিয়ে চলার মতোই কঠিন। তাকে একাই কখনো বাবার মতো কঠোর হয়ে শাসন করতে হয়, আবার মায়ের মতো স্নেহ দিয়ে সেই দুঃখ ভুলিয়ে দিতে হয়। বাবার মতো সন্তানকে চেনাতে হয় বাইরের দুনিয়া। আবার মায়ের মতো পরিবারের ভেতরকার প্রয়োজনীয় শিক্ষা দিতে হয়, যাতে সন্তানের মধ্যে তৈরি হয় দায়িত্ববোধ। ছোট থেকে শত অভাবের মাঝেও আম্মু কখনোই আমাকে কোনো কিছুর অভাব বুঝতে দেননি। সব প্রতিকূলতার মাঝে কিভাবে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে হয় সেই শিক্ষাও দিয়েছেন আমাকে। তাই আমার মা-ই আমার কাছে আমার একমাত্র সুপারহিরো। আমার মা-ই আমার পুরো দুনিয়া।
প্রতিনিধি/একেবি