images

সারাদেশ

ডানলপের নীলকুঠি, অভিশপ্ত কালের সাক্ষী

জেলা প্রতিনিধি

২৭ এপ্রিল ২০২২, ০৯:০১ এএম

১২ কক্ষের অবশিষ্ট কিছু ধ্বংসাবশেষ। পরিত্যক্ত দেয়ালে চারদিকে জন্মেছে বুনো ঘাস ও লতাপাতা। তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে ৪০ ফুটের উঁচু একটি চিমনী। দেখতে কিছুটা মঠ আকৃতির। মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা এই চিমনী ও ধ্বংসপ্রায় কক্ষগুলো জানান দিচ্ছে দুইশ বছর আগের ইতিহাসে শোষণের এক করুণ চিত্র। এটিই হচ্ছে ইংরেজদের শাসন আমলের সময়কার নীলকরদের কৃষক নির্যাতনের অভিশপ্ত ডানলপের নীলকুঠি। 

মাদারীপুর জেলা শহর থেকে ১০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে সদর উপজেলার ছিলারচর ইউনিয়নের আউলিয়াপুর গ্রামে এই নীলকুঠিটির অবস্থান। বর্তমানে এটি জরাজীর্ণ, ধ্বংসপ্রায়। তবে সরকারের সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ ফলে এটি হয়ে উঠতে পারে সম্ভাবনাময় একটি পর্যটন কেন্দ্র।

জানা যায়, ১৭৫৭ সালের পলাশী যুদ্ধের কয়েক বছর পরে, ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লবের পরে সেখানে বস্ত্রশিল্পে নীলের চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। ১৭৭৭ সালের পরপরই অধিক লাভের আশায় বাংলায় আসেন নীলচাষের জন্য বেশ কয়েকজন নীলকর। এর মধ্যে তৎকালীন বৃহত্তর ফরিদপুরের অংশ, বর্তমান মাদারীপুর সদর উপজেলার ছিলারচর ইউনিয়নের আউলিয়াপুর এলাকায় আসেন ইংরেজ নীলকর ডানলপ। 

এখানকার মাটি নীলচাষের উপযোগী হওয়ার ডানলপ তার বিশ্বস্ত লোক, হিন্দু জমিদার কালী প্রসাদ নামে এক ব্যক্তির মাধ্যমে ১২ একর জায়গায় গড়ে তুলেন নীলকুঠি। এসময় এখানে আশেপাশের কৃষকদের অমানুষিক নির্যাতনের মাধ্যমে বাধ্য করা হতো নীলচাষে। এই অমানুষিক নির্যাতনের ফলে একসময় এই অঞ্চলের মানুষের মাঝে তৈরি হয় তীব্র ক্ষোভ। যার ফলে ১৮৪৫ সালে ঐতিহাসিক ফরায়েজি আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা হাজী শরীয়তউল্লাহ্ ও তার ছেলে পীর মহসীনউদ্দীন (দুদু মিয়া) নির্যাতিত কৃষকদের নিয়ে গড়ে তুলেন শক্তিশালী লাঠিয়াল বাহিনী। 

হাজী শরীয়তউল্লাহ মারা যাওয়ার পরে এই লাঠিয়াল বাহিনীর হাল ধরেন দুদু মিয়া। পরে ১৮৪৫ সালের ৫ ডিসেম্বর দুদু মিয়ার নেতৃত্বে তার লাঠিয়াল বাহিনী ও ডানলপের ডানলপ বাহিনীর সঙ্গে আউলিয়াপুর নীলকুঠি হতে ৩ কিলোমিটার অদূরে ‘রণখোলা' নামক স্থানে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে ডানলপ বাহিনীর শোচনীয় পরাজয় হওয়ায় নীলকর ডানলপ পালিয়ে ফরিদপুরে যান। পথে বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলার মুকসুদপুরের আলফাডাঙ্গার বুরাইচ ইউনিয়নের মীরগঞ্জে এলাকায়, আলফাডাঙ্গার গোপালপুরের ‘কৃষক জাহেদ শেখ’ এর রামদার আঘাতে ঘোড়াসহ  নিহত হয়। ওইদিনেই দুদু মিয়ার লাঠিয়াল বাহিনী মাদারীপুরের আউলিয়াপুরের নীলকুঠিতে ভাঙচুর চালিয়ে ধ্বংস করে দেয় নীলকুঠির চুল্লি। তবে অক্ষত থাকে ৪০ ফুট উচ্চতার চুল্লির চিমনী, যা এখনও রয়েছে। 

নীলচাষ ইতিহাসের এই কৃষক নির্যাতনের ভয়াবহ ইতিহাসের সাক্ষী নীলকুঠিটির জায়গা সংরক্ষণের অভাবে বেদখল হয়ে গেছে প্রায়। চুল্লির চিমনিটিও ধ্বংসের মুখে। সরকারের রক্ষণাবেক্ষণের ফলে জায়গাটি হয়ে উঠবে পর্যটনকেন্দ্র। দ্রুত সংরক্ষণ করা না গেলে একসময় হারিয়ে যাবে এই প্রাচীন অভিশপ্ত ঐতিহ্য। 

সম্প্রতি সরেজমিনে নীলকুঠিতে গিয়ে দেখা যায়, চারদিকে ঘেরা লতাপাতায় পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে নীলকুঠিটি। তবে ১২ একর জমির বেশিরভাগই দখল করে স্থানীয়রা তুলেছে বসতঘর। ১২ কক্ষের ধ্বংসাবশেষগুলো কোনো রকমে টিকে আছে। দেয়াল থেকে খসে পড়ছে ইট। পাশে থাকা চুল্লির চিমনিটি বেহাল দশায় পরিণত হয়েছে। জায়গাটিতে চড়ছে বেশ কিছু গরু, ছাগল।

স্থানীয় বাসিন্দা মোক্তার হোসেন বলেন, ‘এ জায়গাটি মাদারীপুরের ঐতিহাসিক একটা জায়গা। এ জায়গাটি বলে দেয় তখনকার দিনের ডানলপ বাহিনীর নির্যাতনের নির্মম ইতিহাস। তবে এখন তেমন কিছুই অবশিষ্ট নেই, সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে গেছে। অনেক লোকজন আসলেও এখন তেমন কিছু দেখতে পায় না। এখানে ১২ একর জমি আছে। সরকার যদি এটি সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেয়, তাহলে আগামী প্রজন্ম জানতে পারবে এই ইতিহাস। আমরা চাই এখানে একটি পর্যটন কেন্দ্র করা হোক।’

মাদারীপুর সরকারি কলেজের ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. নাদিরুজ্জামান বলেন, ‘ছিলারচর ইউনিয়নে অবস্থিত নীলকুঠি মাদারীপুর তথা ব্রিটিশ ভারতে দরিদ্র কৃষকদের ওপর অত্যাচারের এক নীরব সাক্ষী। মাদারীপুরবাসী দুদু মিয়ার নেতৃত্বে এই নীলকুঠির ডানলপসহ সকলকে পরাজিত করে এবং মাদারীপুরকে নীলকুঠি কেন্দ্রিক অত্যাচার থেকে মুক্ত করেন। সাহসী মাদারীপুরবাসীর এই পদক্ষেপ ইতিহাস হয়ে আছে আজও। তাই মাদারীপুরের এই ঐতিহ্যকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষসহ সকলের কাছে এই কুঠির ইতিহাস রক্ষার্থে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি।’

সংরক্ষণের বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক ড. রহিমা খাতুন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘মাদারীপুরের ছিলারচরে যে নীলকুঠিটি আছে, তা আমরা সংরক্ষণ করার জন্য এক প্রকল্প হাতে নিয়েছি। জায়গাটিতে পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। ওখানে যারা অবৈধভাবে বসবাস করছে তাদের তালিকাও করা হচ্ছে।'

এইচই